ঢাকা, মঙ্গলবার   ২৬ নভেম্বর ২০২৪

রক্ত বন্যায় শঙ্কায় ইদলিব: জানেন কার স্বার্থ কতটুকু?

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ২৩:১৫, ১১ সেপ্টেম্বর ২০১৮

সিরিয়াজুড়ে রুশ ও আসাদ বাহিনীর বিমান হামলায় পরাস্থ হয়ে বিদ্রোহীরা ইদলিব প্রদেশে ঘাঁটি গেড়েছে। অন্যদিকে কেবল ইদলিব ছাড়া অন্যসব প্রদেশের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে প্রেসিডেন্ট বাসার আল আসাদ বাহিনী। এখন কেবল ইদলিব দখল করতে পারলেই সিরিয়ায় ফের আসাদ রাজত্ব পুনঃপ্রতিষ্ঠা পাবে। এমন সমীকরণে জঙ্গিগোষ্ঠী আইএসসহ বিদ্রোহী গোষ্ঠী ফ্রি সিরিয়ান আর্মি ও আস শামসও আসাদ বাহিনীকে ছেড়ে কথা বলবে না। আবার তুর্কী বাহিনীও কুর্দী যোদ্ধাদের দমনের নামে ইদলিবে সামরিক অভিযান শুরু করবে। তাইতো বহুমুখী আক্রমণের শঙ্কায় ভুগছে ইদলিবের ৩০ লাখ বেসামরিক নাগরিক।

এমন সমীকরণে যুদ্ধ বন্ধে তেহরান সম্মেলনে যোগ দেন তুর্কী প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়্যিপ এরদোগান, ইরানি প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানি ও রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। তবে ভ্লাদিমির পুতিন তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইপ এরদোগোনের দেওয়া যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করায় ইদলিবের রক্তবন্যা এখন সময়ের ব্যবধান মাত্র। গত সপ্তাহ থেকেই ইদলিবে সিরিয়া এবং রুশ বাহিনীর মিলিত জোট বিমান হামলা শুরু করেছে।

২০১৫ সালে রাশিয়ার হস্তক্ষেপের পর থেকেই বাশার আল-আসাদ ধীরে ধীরে প্রায় সমগ্র সিরিয়াতে নিজের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে শুরু করেন। গত বছরের জুলাই মাসে আস্তানা সম্মেলনে ইরান, রাশিয়া ও তুরস্ক যে চারটি ডি-এস্কেলেশন জোনের ব্যাপারে একমত হয়েছিল, একে একে সেগুলোর তিনটিও দখল করে ফেলার পর এই মুহূর্তে ইদলিবই হচ্ছে বাশার আল-আসাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে থাকা সিরিয়ার একমাত্র উল্লেখযোগ্য এলাকা। আর তা দখল করতে পারলেই ফের রাজত্ব দখল হবে আসাদ বাহিনীর।

সিরিয়ার উত্তর-পশ্চিমে তুরস্কের সীমান্ত সংলগ্ন এলাকায় অবস্থিত ইদলিব আরেকটি কারণে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তা হলো, বাণিজ্যিকভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ‘এম ফাইভ’ হাইওয়ের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ পড়েছে ইদলিবের উপর। জর্ডান থেকে সিরিয়ার ভেতর দিয়ে তুরস্ক পর্যন্ত যাওয়া এই হাইওয়েটির একমাত্র ইদলিবের অংশটিই এখন পর্যন্ত আসাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে। এছাড়াও তুরস্কের সীমান্ত সংলগ্ন হওয়ায় সময়ের সাথে সাথে পার্শ্ববর্তী কুর্দি প্রধান আফরিনের মতো ইদলিবেও তুরস্কের নিয়ন্ত্রণ বৃদ্ধি পাওয়ার সম্ভাবনা আছে। আর তাই যত দ্রুত সম্ভব, যেকোনো উপায়ে এলাকাটির নিয়ন্ত্রণ নেওয়া আসাদ সরকারের জন্য এবং সেই সাথে তার পৃষ্ঠপোষক ইরান ও রাশিয়ার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

সিরিয়ায় কার স্বার্থ কতটুকু?

সিরিয়ার যুদ্ধ শুধু সরকারের সাথে বিদ্রোহীদের যুদ্ধ না, বরং একাধিক আন্তর্জাতিক শক্তির মধ্যে চলমান ছায়াযুদ্ধ। সম্প্রতি আবারও এর একটি বড় উদাহরণ দেখা গেছে তেহরান সম্মেলনে, যেখানে সিরিয়ার ইদলিব প্রদেশের ৩০ লাখ মানুষের ভাগ্য নির্ধারণের আলোচনায় সিরিয়ার সরকারের বা বিদ্রোহীদের কোনো প্রতিনিধি উপস্থিত ছিল না, ছিল ইরান, রাশিয়া এবং তুরস্কের প্রতিনিধিরা। এই মুহূর্তে এরাই সিরিয়ার প্রধান খেলোয়াড়, সেই সাথে কিছুটা কম হলেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবও আছে সিরিয়াতে। তেহরান সম্মেলন কার্যত ব্যর্থ হওয়ার পর ইদলিবে হয়তো শীঘ্রই শুরু হতে যাচ্ছে রাশিয়া ও ইরান সমর্থিত সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের বাহিনীর তীব্র আক্রমণ। চলুন তার আগেই জেনে নিই ইদলিবে কোন কোন দেশ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত এবং তাদের কার কী স্বার্থ।

এছাড়াও আমাদের পূর্ববর্তী একটি লেখায় যেরকম বলা হয়েছিল, ইদলিবের মধ্য দিয়ে জর্ডান থেকে তুরস্ক পর্যন্ত বিস্তৃত বাণিজ্যিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ ‘এম ফাইভ’ হাইওয়ের এবং আলেপ্পো হয়ে লাতাকিয়ায় অবস্থিত রাশিয়ার হুমাইমিম বিমান ঘাঁটি পর্যন্ত বিস্তৃত ‘এম ফোর’ হাইওয়ের অবস্থান হওয়ায় প্রদেশটির নিয়ন্ত্রণ নেওয়া আসাদের জন্য অত্যন্ত জরুরি। এছাড়াও সময়ের সাথে সাথে আফরিনের মতো ইদলিবেও তুরস্কের প্রভাব বৃদ্ধি পাওয়ার সম্ভাবনা আছে। সে কারণেও আসাদ যত দ্রুত সম্ভব ইদলিবের নিয়ন্ত্রণ নিতে মরিয়া।

তুরস্কে বর্তমানে সিরিয়ান শরণার্থীর সংখ্যা প্রায় ৩৫ লাখ। নতুন করে ইদলিবের শরণার্থীদের চাপ সহ্য করার মতো ক্ষমতা তুরস্কের নেই। সে কারণে তুরস্ক ইদলিবে বড় ধরনের কোনো অপারেশনের বিরোধিতা করে আসছে। তারা ইদলিবের আশেপাশে বিভিন্ন এলাকায় নিজেদের ১২টি নজরদারি সেনাচৌকিও স্থাপন করেছে। একইসাথে তারা আসাদ ও রাশিয়ার আক্রমণের মুখে নিজেদের অনুগত বিদ্রোহী গ্রুপগুলোরও যথাসম্ভব নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে চায়। সে উদ্দেশ্যেই সম্ভবত সম্প্রতি তারা ইদলিবের নিয়ন্ত্রণে থাকা সবচেয়ে শক্তিশালী জিহাদী সংগঠন হাইআত তাহরির শাম, যারা অতীতে আল-কায়েদার সাথে যুক্ত ছিল, তাদেরকে সন্ত্রাসী তালিকাভুক্ত করার মাধ্যমে অন্যান্য গ্রুপগুলোর সাথে তাদের পার্থক্য সৃষ্টি করার চেষ্টা করেছে।

ইরান
সৌদি আরব এবং ইরান মধ্যপ্রাচ্য জুড়ে একাধিক ছায়াযুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছে। সিরিয়া হচ্ছে তার সবচেয়ে বড় উদাহরণ। যদিও সৌদি আরব পরবর্তীতে সিরিয়া থেকে নিজেকে অনেকটাই গুটিয়ে নিয়েছে, কিন্তু প্রথমদিকে বিদ্রোহীদেরকে সমর্থন এবং সহযোগিতা করার ক্ষেত্রে সৌদি আরব এবং তাদের তৎকালীন উপসাগরীয় মিত্র কাতারের উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ছিল। মূলত সৌদি আরব এবং অন্যান্য উপসাগরীয় সুন্নী রাষ্ট্র সমর্থিত গ্রুপগুলো যেন সিরিয়ার নিয়ন্ত্রণ নিতে না পারে, সেজন্যই ইরান সিরিয়াতে হস্তক্ষেপ শুরু করে এবং বাশার আল-আসাদকে রক্ষায় সচেষ্ট হয়।


মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র
সিরিয়াতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান মিত্র কুর্দিরা। ইদলিব কুর্দি প্রধান এলাকা না হওয়ায় এবং মার্কিন বলয়ের বাইরে হওয়ায় সেখানে যুক্তরাষ্ট্রের তেমন কোনো আগ্রহ নেই। ইদলিবে বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে মাঝারি আকারের কোনো অপারেশন হলে সেখানে যুক্তরাষ্ট্র কোনো ধরনের বাধাও দেবে না, বরং তারা হয়তো কিছুটা খুশিই হবে। কারণ, ইদলিবের সবচেয়ে শক্তিশালী বিদ্রোহী গ্রুপ হচ্ছে হাইআত তাহরির শাম, যাদেরকে যুক্তরাষ্ট্র সন্ত্রাসী হিসেবে বিবেচনা করে। তাহরির শামের বেশ কিছু উচ্চপদস্থ নেতার উপর যুক্তরাষ্ট্র ড্রোন আক্রমণও করেছে।

তুরস্ক
সিরিয়ার বিভিন্ন এলাকায় তুরস্কের স্বার্থ বিভিন্ন ধরনের। তুরস্ক মোটের উপর বাশার আল-আসাদের পতন চায় এবং সে হিসেবে ফ্রি সিরিয়ান আর্মিকে অর্থ, অস্ত্র ও ট্রেনিং দিয়ে সাহায্য করে। আবার কুর্দিদের বিস্তার রোধ করার জন্য তুরস্ক সরাসরি সিরিয়ার অভ্যন্তরে একাধিক অপারেশনও চালিয়েছে। কিন্তু ইদলিব তুরস্কের জন্য ভিন্ন দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ। এর আগে যতগুলো শহরে যুদ্ধ হয়েছে, সেগুলো থেকে পালিয়ে বিদ্রোহীরা ইদলিবে বা বিদ্রোহীদের নিয়ন্ত্রিত অন্যান্য এলাকায় গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিল। কিন্তু ইদলিবই বিদ্রোহীদের নিয়ন্ত্রণে থাকা শেষ এলাকা হওয়ার কারণে এবার তাদের যাওয়ার আর কোনো জায়গা থাকবে না। তুরস্কের সীমান্ত সংলগ্ন হওয়ার কারণে ইদলিবের ৩০ লাখ মানুষের একটা বড় অংশই শেষপর্যন্ত জীবন বাঁচাতে তুরস্কের দিকেই যাত্রা করবে।


রাশিয়া:
লিবিয়ার গাদ্দাফির পতনের পর মধ্যপ্রাচ্যে ইরান এবং সিরিয়া ছাড়া পশ্চিমা বিরোধী কোনো শক্তিশালী রাষ্ট্রপ্রধান অবশিষ্ট নেই। তাই সিরিয়ার বাশার আল-আসাদকে রক্ষা করা রাশিয়ার নিজের স্বার্থে জরুরি ছিল। এছাড়াও ইউক্রেন সংকটের পর দেশীয় রাজনীতিতেও নিজের ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধারের জন্য এবং রাশিয়াকে সুপার পাওয়ার হিসেবে প্রমাণ করার জন্য পুতিনের সফল একটি অপারেশনের প্রয়োজন ছিল। এসব উদ্দেশ্যেই রাশিয়া ২০১৫ সালের শেষ দিকে এসে সিরিয়ার গৃহযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। রাশিয়ার হস্তক্ষেপের পর থেকেই মূলত বাশার আল-আসাদের ভাগ্য পরিবর্তিত হয়ে যায়।

এমজে/

 


Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি