আইএস যোগ দেওয়া সেই ব্রিটিশ স্কুলছাত্রী দেশে ফিরতে চান
প্রকাশিত : ২০:৩৪, ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ | আপডেট: ২০:৪৪, ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৯
দু`হাজার পনেরো সালে লন্ডনের যে তিন স্কুল-পড়ুয়া মেয়ে ইসলামিক স্টেট গোষ্ঠীর সঙ্গে যোগ দেবার জন্য ব্রিটেন ত্যাগ করেছিল, তাদের একজন শামিমা বেগম এখন বলছেন, তিনি যুক্তরাজ্যে ফিরে আসতে চান কিন্তু তার অতীত কর্মের জন্য তার কোনো অনুতাপ নেই।
দৈনিক টাইমসকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ১৯ বছর বয়েসী শামিমা বেগম বলেন, তিনি সিরিয়ায় থাকার সময় ডাস্টবিনে মানুষের কাটা মাথা পড়ে থাকতে দেখেছেন- কিন্তু এসব তাকে বিচলিত করেনি।
সিরিয়ার একটি শরণার্থী শিবির থেকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে শামিমা বেগম বলেন, তিনি নয় মাসের গর্ভবতী এবং এর আগে তার দুটি সন্তান হয়েছিল- কিন্তু দু`জনই মারা গেছেন।
তিনি বলেন, তার পেটের সন্তানটির জন্যই তিনি দেশে ফিরতে চান। শামিমা বেগম আরও বর্ণনা করেন, তার যে দুই বান্ধবী তার সঙ্গে সিরিয়া গিয়েছিলেন তাদের একজন বোমা বিস্ফোরণে মারা গেছেন। তৃতীয় জনের ভাগ্যে কি ঘটেছে তা অস্পষ্ট।
সিরিয়ায় যাবার জন্য লন্ডন ত্যাগের সময় বেথনাল গ্রিন একাডেমির ছাত্রী শামিমা বেগম ও আমিরা আবাসির বয়েস ছিল ১৫, আর খাদিজা সুলতানরা বয়স ছিল ১৬। লন্ডনের কাছে গ্যাটউইক বিমান বন্দর থেকে ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে তারা তিনজন তুরস্কের উদ্দেশ্যে উড়াল দেন।
তারা তাদের বাবা-মাকে বলেছিলেন, তারা একসঙ্গে কোথাও বেড়াতে যাচ্ছেন। তুরস্কে নামার পর তারা সীমান্ত পেরিয়ে সিরিয়ায় ঢোকেন। তখন সিরিয়া ও ইরাকের বিস্তীর্ণ অঞ্চল দখল করে রয়েছে আইএস।
ইসলামিকে স্টেটের স্বঘোষিত `খেলাফতের` রাজধানী রাক্কায় এসে তারা প্রথম একটি বাড়িতে ওঠেন। সেখানে তাদের সঙ্গে ছিল আরও কয়েকজন মেয়ে- যারা আইএস যোদ্ধদের বধূ হবার জন্য দেশ ছেড়ে এসেছিল।
শামিমা বলেন, "আমি একটা আবেদনপত্র দেই যে আমি ইংরেজিভাষী একজন যোদ্ধাকে বিয়ে করতে চাই- যার বয়েস ২০ থেকে ২৫ বছর বয়েসের মধ্যে।"
দশ দিন পর তার সঙ্গে ২৭ বছর বয়স্ক একজন ডাচ লোকের বিয়ে হয়- যে ধর্মান্তরিত হয়ে ইসলাম গ্রহণ করেছিল। তার পর থেকে শামিমা ওই ব্যক্তির সঙ্গেই ছিলেন, এবং দু`সপ্তাহ আগে তারা পূর্ব সিরিয়ায় আইএস গোষ্ঠীর শেষ ঘাঁটি বাঘুজ থেকে পালিয়ে যান। এ সময় শামিমার স্বামী সিরিয়ান যোদ্ধাদের একটি দলের কাছে আত্মসমর্পণ করে।
শামিমা এখন উত্তর সিরিয়ায় ৩৯ হাজার লোকের বাস এমন একটি শরণার্থী শিবিরে অবস্থান করছেন। টাইমসের সাংবাদিক এ্যান্টনি লয়েড তাকে প্রশ্ন করেছিলেন, রাক্কার জীবন যেমন হবে বলে তিনি আশা করেছিলেন- তা কি তেমনই ছিল? জবাবে শামিমা বলেন, "হ্যাঁ, ছিল। এটা ছিল একটা স্বাভাবিক জীবনের মতোই। তাদের প্রচারমূলক ভিডিওতে যেমন দেখানো হতো- তেমনই একটা স্বাভাবিক জীবন। মাঝেমধ্যে একটা-দুটো বোমা ফাটতো, কিন্তু তা ছাড়া...।"
তিনি বলেন, জীবনে প্রথমবার যখন তিনি মানুষের কাটা মাথা দেখেছিলেন, তাতে তিনি একটুও বিচলিত হননি। "সেটা ছিল যুদ্ধক্ষেত্র থেকে ধরে আনা একজন বন্দী যোদ্ধার মাথা,.. একজন ইসলামের শত্রু।" "আমার মনে হয়, সে যদি সুযোগ পেতো তাহলে সে-ও একজন মুসলিম নারীর ওই একই অবস্থা করতো।"
"আমি এখন আর সেই ছোট্ট ১৫ বছরের স্কুলের মেয়েটি নেই, যে বেথনাল গ্রিন থেকে পালিয়েছিল। এখানে আসার জন্য আমি দুঃখিত নই" - বলেন শামিমা।
তবে তিনি বলেন, সেখানে তিনি যে দমন-নিপীড়ন দেখেছেন তা তাকে `স্তম্ভিত` করেছে, এবং ইসলামিক স্টেটের `খেলাফত` শেষ হয়ে গেছে বলেই তার মনে হয়।
"আমি বড় কিছু আশা করছি না। তারা এখন (আইএস) এখন ছোট থেকে আরও ছোট হয়ে যাচ্ছে" বলেন শামিমা - "এবং সেখানে এত বেশি দমন-নিপীড়ন আর দুর্নীতি হচ্ছে যে আমি মনে করি তারা বিজয় পাবার উপযুক্ত নয়।"
তিনি বলেন, তার স্বামী এমন একটি কারাগারে আটক আছে যেখানে বন্দীদের ওপর নির্যাতন করা হয়। শামিমার সঙ্গী খাদিজা সুলতানার পরিবারের একজন আইনজীবী ২০১৬ সালে বলেছিলেন, তিনি একটি রুশ বিমান হামলায় নিহত হয়েছেন বলে মনে করা হয়।
শামিমা বেগম তার সাক্ষাৎকারে বলেন, একটি বাড়ির ওপর বোমা ফেলা হলে তার বান্ধবী নিহত হন। `ওই বাড়ির নিচে কিছু গোপন কার্যক্রম চলছিল` বলে তিনি উল্লেখ করেন।
তিনি বলেন, "আমি কখনো ভাবিনি এমনটা হবে। প্রথমে আমি বিশ্বাস করিনি, কারণ আমি সব সময়ই মনে করতাম যে যদি আমরা মারা যাই, তাহলে একসাথেই মরবো।" `আমি ভয় পাচ্ছি যে আমার বাচ্চাটা হয়তো অসুস্থ হয়ে পড়বে`
শামিমা বেগমের দুটি সন্তান হয়। এর মধ্যে দ্বিতীয়টি মারা যায় প্রথমে, আট মাস বয়সে। আর প্রথমটি মারা যায় এক বছর নয় মাস বয়সে। তাকে এক মাস আগে বাঘুজে কবর দেওয়া হয়। টাইমস জানাচ্ছে, অপুষ্টির কারণে প্রথম সন্তানটির অসুস্থতা খারাপ মোড় নিয়েছিল।
মিজ বেগম বলেন, তার দ্বিতীয় সন্তানকে তিনি একটা হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু সেখানে কোন অষুধ ছিল না, এবং যথেষ্ট ডাক্তার-নার্সও ছিল না।
তিনি আরও বলছেন, শরণার্থী শিবিরে থাকলে তার পেটের সন্তানটিও আগের বাচ্চাদের মতোই মারা যাবে- এ ভয় তার বাঘুজ ছাড়ার সিদ্ধান্ত প্রভাবিত করেছে।
শামিমা বেগম বলছেন, তার সন্তান যে কোন দিন ভূমিষ্ঠ হতে পারে, এবং এ জন্যই তিনি ব্রিটেনে ফিরতে চান- কারণ তিনি জানেন যে সেখানে তিনি অন্তত চিকিৎসা পাবেন।
"আমি দেশে ফেরার জন্য, এবং সন্তানকে নিয়ে নিরবে জীবন কাটানোর জন্য যে কোন কিছু করতে রাজী আছি"- বলেন তিনি।
ব্রিটেনের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বেন ওয়ালেস বলেছেন, শামিমা বেগমের ব্যাপারে তিনি আইনগত কারণে কোন মন্তব্য করবেন না। তবে তিনি বলেন, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ বা সমর্থন দিতে যে ব্রিটিশ নাগরিকরা সিরিয়া গেছেন - তাদের প্রস্তুত থাকতে হবে যে দেশে ফিরে এলে তাদের জিজ্ঞাসাবাদ ও তদন্তের সম্মুখীন হতে হবে এবং বিচারও হতে পারে।
তথ্যসূত্র: বিবিসি।
এসএইচ/
আরও পড়ুন