কী আদায় করতে চায় ট্রাম্প?
প্রকাশিত : ১২:১০, ২৭ মে ২০১৯
ইরানকে কেন্দ্র করে মধ্যপ্রাচ্যে ক্রমশ উত্তেজনা বাড়ছেই। প্রতিনিয়ত যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের মধ্যে পাল্টাপাল্টি হুমকি ধামকি চলছে। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেন, ইরানকে এমন পরিণতি ভোগ করতে হবে যা আগে কখনো কাউকে করতে হয়নি। দেশটিকে একেবারে ধ্বংস করারও হুমকি দেন তিনি।
এদিকে ট্রাম্প প্রশাসনের ‘যুদ্ধবাজ’খ্যাত মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জন বোল্টন ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও পেন্টাগন ইরানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে যেতে ট্রাম্পকে অবিরাম উস্কানি দিচ্ছে। কুশীলবদের মধ্যে আরও রয়েছেন ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু, সৌদি বাদশাহ সালমান বিন আবদুল আজিজ ও ছেলে যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান।
অন্যদিকে ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ খামেনিও বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে যুদ্ধ হবে না ইরানের। তবে ইরান নিজ স্বার্থের বিষয়ে কোনো আপস করবে না।
ইরানের প্রেসিডেন্ট রোহানি বলেছিলেন, যুক্তরাষ্ট্রের সাথে যুদ্ধ হলে ইরানের বিজয় সুনিশ্চিত। ইরানের কাছে যুক্তরাষ্ট্র শোচনীয়ভাবে পরাজিত হবে।
বাকযুদ্ধের মধ্যেই মধ্যপ্রাচ্যে ১৫০০ সেনা পাঠাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। সেই সঙ্গে যুদ্ধবিমান, ড্রোন এবং অন্যান্য অস্ত্রশস্ত্রও মোতায়েন করা হবে বলে দেশটির পক্ষ থেকে জানানো হয়।
এর আগে উপসাগরীয় অঞ্চলে আরও একটি যুদ্ধজাহাজ এবং পেট্রিয়ট ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা মোতায়েন করছে যুক্তরাষ্ট্র।
ক্ষেপণাস্ত্র মোতায়েনের পক্ষে যুক্তি দেখিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা দফতর জানায়, ইরানের সঙ্গে যুদ্ধ বাঁধাতে চায় না যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু যে কোনো হামলা মোকাবেলায় পুরোপুরি প্রস্তুত থাকার কথা জানিয়েছে তারা। সেটি ছায়া যুদ্ধই হোক বা ইসলামিক রেভ্যুলেশনারি গার্ড বা নিয়মিত ইরানি বাহিনীর হামলাই হোক।
বিশ্লেষকরা বলছেন, ট্রাম্প প্রশাসন ইরানের বিরুদ্ধে আসলে কী করতে চায় তা স্পষ্ট নয়। একদিকে তারা বলছেন ইরানের সঙ্গে যুদ্ধ চান না। কিন্তু অন্যদিকে ইরানের সরকারের পতন ঘটিয়ে নতুন কাউকে ক্ষমতায় আনার ব্যাপারে তাদের উৎসাহ দেখা যাচ্ছে।
ইরানের বিরুদ্ধে এ হুমকির অন্যতম কারণ হতে পারে অস্ত্র বিক্রি। বিশ্লেষকরা এমনটাই মনে করেন। ইতোমধ্যে কংগ্রেসকে পাশ কাটিয়ে প্রায় ৮০০ কোটি ডলার মূল্যের অস্ত্র সৌদি আরবের কাছে বিক্রির সিদ্ধান্ত নিয়েছেন ট্রাম্প। এছাড়াও সংযুক্ত আরব আমিরাত ও জর্ডানের কাছেও অস্ত্র বিক্রি হবে।
আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, ট্রাম্প ইরানের ওপর চাপ সৃষ্টি করে মধ্যপ্রাচ্যে নিরঙ্কুশ ব্যবসায়িক আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে চান। পাশাপাশি ইসরাইল, সৌদিসহ তার মিত্রদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে চান।
তারা মনে করছেন, ট্রাম্প মধ্যপ্রাচ্যে নতুন যুদ্ধের ঝুঁকি নেবেন না। কারণ পরবর্তী মেয়াদে প্রেসিডেন্ট হতে চাইলে ট্রাম্পকে ‘যুদ্ধবাজ’ তকমা থেকে দূরে থাকতে হবে।
এদিকে ইরানের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র যে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে, তার ফলে ইরানের অর্থনীতি দিনে দিনে সঙ্কটে নিমজ্জিত হচ্ছে। এই নিষেধাজ্ঞার মূল উদ্দেশ্য যেন ইরান তাদের তেল অন্যদেশের কাছে বিক্রি করতে না পারে।
অপরদিকে যুক্তরাষ্ট্রের এই সমর প্রস্তুতিকে মোটেই ভালোভাবে নিচ্ছে না ইরান। তারা বলছে আমেরিকা ‘মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধ’ শুরু করেছে।
ইরান যুক্তরাষ্ট্রের এসব পদক্ষেপের পাল্টা হিসাবে হরমুজ প্রণালী বন্ধ করে দেবে বলে হুমকি দিয়েছে। বিশ্বে প্রতি বছর যত জ্বালানি তেল ব্যবহৃত হয়, তার এক পঞ্চমাংশ সরবরাহ যায় এই হরমুজ প্রণালী দিয়ে।
ইরানের ক্ষমতাধর একজন ধর্মীয় নেতা ইউসেফ তাবাতাবাই-নেজাদকে উদ্ধৃত করে আধা-সরকারি ইরানি সংবাদ সংস্থা ইসনা বলছে, ‘একটি ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতেই যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধ জাহাজের বহর ধ্বংস হয়ে যাবে।’
একটি নতুন কূটনৈতিক চুক্তির ব্যাপারে বাধ্য করতে কঠিন নিষেধাজ্ঞা দিয়ে ইরানের ওপর চাপ তৈরির পরিকল্পনা করছে যুক্তরাষ্ট্র।
যুক্তরাষ্ট্র চাচ্ছে, ইরান তাদের পারমাণবিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা পরিত্যাগ করাসহ ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচি বন্ধ করুক।
তাদের শর্ত হচ্ছে ইরানকে মধ্যপ্রাচ্যে তাদের প্রভাব বিস্তারের নীতি বন্ধ করতে হবে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, যুক্তরাষ্ট্রের জন্য ইরানকে নিয়ন্ত্রণে আনা বেশ কঠিন হবে। মধ্যপ্রাচ্যে ইরানের প্রভাব কমিয়ে আনাও সহজ হবে না।
এদিকে ইরানের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের লাগাতার নিষেধাজ্ঞা শর্তেও ইউরোপ ইরানের সাথে আগের চুক্তি বহাল রাখার পক্ষে রয়েছে। যেহেতু ইউরোপের অনেক প্রতিষ্ঠান ইরানে বিনিয়োগ করেছিল। এখন যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থানের কারণে ইউরোপ দুই ধরণের সমস্যায় পড়েছে।
একদিকে তাদের ইরানে বিনিয়োগ বাঁচাতে হবে। অন্যদিকে তাদের যুক্তরাষ্ট্রের সাথে ব্যবসা করতে হবে। তবে অনেক কোম্পানি ক্ষতি স্বীকার করে হলেও ইরানে ব্যবসা গুটিয়ে নিতে শুরু করেছে।
তবে রাশিয়া, চীন এবং ভারত মার্কিন নিষেধাজ্ঞার কাছে কী নতি স্বীকার করবে, সেই বিষয়টি এখনো স্পষ্ট নয়।
গত বছর প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প একতরফাভাবে ইরানের সঙ্গে সম্পাদিত পরমাণু চুক্তি থেকে বেরিয়ে যান। ২০১৫ সালে এই চুক্তিটি হয়েছিল।
ইরানের সঙ্গে বিশ্বের ক্ষমতাবান দেশগুলোর যে পরমাণু চুক্তি হয়েছিল, তার লক্ষ্য ছিল ইরান যেন পরমাণু অস্ত্র তৈরির কাজে তার পরমাণু কর্মসূচী ব্যবহার করতে না পারে।
এই চুক্তির অধীনে ইরান তার পরমাণু কর্মসূচী সীমিত করতে এবং আন্তর্জাতিক পরিদর্শকদের সেগুলো পরিদর্শন করতে দিতে রাজী হয়। এর বিনিময়ে ইরানের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা শিথিল করা হয়।
কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র পরমাণু চুক্তি থেকে বেরিয়ে গিয়ে নতুন করে ইরানের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে।
ইরানের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের লাগাতার নিষেধাজ্ঞার ফলে ইরানের অর্থনীতিতে সংকট তৈরি হয়েছে। ইরানি মূদ্রার মান পড়ে গেছে। তাদের মূদ্রাস্ফীতি বেড়ে গেছে। সেখানে জন অসন্তোষ বাড়ছে এবং অনেক বিদেশি বিনিয়োগকারী ইরান থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে।
এমএইচ/এমবি//
আরও পড়ুন