ঢাকা, মঙ্গলবার   ২৬ নভেম্বর ২০২৪

সশস্ত্র বাধার মুখেও সাংবাদিক হওয়ার স্বপ্ন দেখেন মেয়েটি

প্রকাশিত : ১৯:২৩, ২৬ জুন ২০১৯ | আপডেট: ২৩:২৯, ২৬ জুন ২০১৯

পাকিস্তানের বেলুচিস্তান প্রদেশের একটি গ্রামে কিছু সশস্ত্র পুরুষ কয়েক বছর ধরে মেয়েদের স্কুল ঘেরাও করে রাখে। যেন মেয়েরা স্কুলের ভিতরে প্রবেশ করতে না পারে। কিন্তু সেখানকারই এক মেয়ে সব বাধা পেরিয়ে অবশেষে বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি সম্পন্ন করেছেন। এখন তিনি প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন একজন সাংবাদিক হওয়ার জন্য। এক আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমকে তিনি তার সংগ্রামের গল্প শোনান।

কোয়েটার সরদার বাহাদুর খান উইমেন্স ইউনিভার্সিটির ছাত্রী নাঈমা জেহরি বলেন,‘আমি আমার শৈশব আতঙ্কে কাটিয়েছি। এখনও এটা নিয়ে ভাবলে আমার মেরুদণ্ড কেঁপে ওঠে।’ পাকিস্তানের বেলুচিস্তান প্রদেশের খুজদার জেলার জেহারি জামশার একটি উপজাতি গ্রামে বেড়ে ওঠেন নাঈমা। তিনি বলেন, ‘তার শৈশব একটি সময়ে হয়, যখন তার অঞ্চলে আইনহীনতা শিখরে ছিল।’

গণমাধ্যমের খবর জুড়ে শুধুই ছিল বেলুচ পুরুষদের ওপর লক্ষ্য করে বিভিন্ন পরিকল্পিত হামলা, অপহরণ ও হত্যার ঘটনা। ভয়, পক্ষপাত, এবং অস্ত্র ছিল সর্বত্র। বেলুচিস্তান পাকিস্তানের সবচেয়ে গরীব প্রদেশ। এটি বিচ্ছিন্নতাবাদী বিদ্রোহীদের এবং পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর মধ্যে দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধবিরতি সহ্য করেছে। এই প্রদেশের দূরবর্তী পাহাড়ি গ্রামগুলোতে, জনজীবন সাধারণত দুর্বিসহ, বিশেষ করে নারীরা ভুক্তভোগী সবচেয়ে বেশি বলে জানান নাঈমা। তিনি বলেন, ‘আমার শৈশব কেটেছে দারিদ্র্যের সাথে লড়াই করে। আমরা সাত ভাইবোন এবং আমার বাবা আমাদের ফেলে রেখে অন্য একজন নারীকে বিয়ে করেছিলেন। আমার মা শিক্ষিত ছিলেন না, তাই আমাদের মৌলিক চাহিদা মেটাতে পারিবারিক দান খয়রাতের উপর নির্ভর করতে হয়েছিল। শিক্ষা ছিল একটি বিলাসিতা, যা আমরা বহন করতে পারিনি।’

নাঈমার জন্য, শিক্ষা অর্জনই ছিল একটি সংগ্রামের মতো। ১০ বছর বয়স পর্যন্ত তিনি গ্রামে সরকার পরিচালিত মেয়েদের অবৈতনিক মানে বিনা খরচে পড়াশোনা করা যায় এমন একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়তেন। কিন্তু স্কুলটি বন্ধ করে দেয়া হয়। তিনি বলেন, ‘স্থানীয় ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর নেতা সমর্থিত দুষ্কৃতিকারীরা ২০০৯ থেকে ২০১৩ সাল স্কুলটি দখল করে রাখে।’ তারা মেয়েদের ওই স্কুলভবন থেকে দূরে রাখার জন্য স্কুলটির প্রবেশদ্বারে বড় ধরণের ব্যারিকেড দিয়ে রাখে। ঐ গণমাধ্যম স্বাধীনভাবে এ তথ্য নিশ্চিত করতে পারেনি। তবে বেলুচিস্তানে ঐ ধরনের পরিস্থিতি অস্বাভাবিক কিছু না বলেও মন্তব্য করে আন্তর্জাতিক এ গণমাধ্যমটি।

নাঈমা বলেন, ‘পুরো এলাকায় ব্যারিকেড দিয়ে ঘেরাও করা হয়েছিল। সেখানে সবসময় ছয় থেকে আটজন সশস্ত্র ব্যক্তি পাহারায় থাকতো। মনে আছে, ছোটবেলায় প্রতিদিন এমন দৃশ্যের পাশ দিয়ে হেঁটে যেতাম। সশস্ত্র ব্যক্তিরা সেখানে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আমরা ভয় পেতাম। আমি সবসময়ই ভয়ে থাকতাম যে তারা আমাকে যেকোনো সময় বুঝি গুলি করবে। ঐ ব্যক্তিরা শালওয়ার কামিজ অর্থাৎ ঢোলা পাঞ্জাবি আর ঢোলা পায়জামা পরে থাকতো। তাদের হাতে বন্দুক ছিল। তাদের মুখ সবসময় রুমাল দিয়ে ঢাকা থাকতো। শুধুমাত্র তাদের চোখ দেখা যেতো। আমি সম্পূর্ণরূপে ভেঙে ছিলাম। তারা বয়স কম ছিল, পূর্ণ জীবনী শক্তির দুজন মানুষ। আমি তাদের মৃত্যুর শোক অনেক দিনেও কাটিয়ে উঠতে পারিনি।’ কিন্তু এই দুর্ঘটনা, নাঈমাকে তার শিক্ষা চালিয়ে যেতে অনুপ্রেরণা যোগায়। মাধ্যমিক স্কুল শেষ করার পর তার স্কুলে যাওয়া বন্ধ হয়ে গেলেও, তিনি সেই বাধা তার পড়ালেখায় আসতে দেননি।

তোমাদের মেয়েদের স্কুলে পাঠিও না:

নাঈমা বলছেন, ‘সশস্ত্র পুরুষরা কখনোই বাচ্চাদের হুমকি দেয়নি।’ তবে তারা দুটি উদ্দেশ্য ধারণ করতো। প্রথমত, মেয়েদের শিক্ষা থেকে দূরে রাখা, যেন নৃগোষ্ঠী প্রধানের সশস্ত্র বাহিনী মেয়েদের স্কুল ক্যাম্পাসকে তাদের গোপন আস্তানা হিসেবে ব্যবহার করতে পারে। ‘মানুষের কাছে তাদের এটি পরিষ্কার বার্তা ছিল, আর সেটা হল আপনার মেয়েরা স্কুলে পাঠাবেন না।’ গ্রামের এর প্রভাব ছিল ভয়াবহ, বিপর্যয়কর। কেননা সরকারি শিক্ষকরা এমন পরিবেশে কাজ করার সাহস পেতেন না। নাঈমা এবং অন্য কয়েকজন মেয়েকে কাছাকাছি গ্রামের আরেকটি স্কুলে ভর্তি করা হয়, কিন্তু এটি ছিল শুধুই একটি আনুষ্ঠানিকতা।

বাবা মায়েরা তাদের মেয়েদের ওইসব স্কুলে পাঠাতেন বিনামূল্যে রান্নার তেল পাওয়ার জন্য। যা একটি আন্তর্জাতিক দাতব্য সংস্থা সরবরাহ করতো। যেন ওই এলাকায় মেয়েদের স্কুলে আসার হার বাড়ানো যায়- কিন্তু পড়ালেখা শেখানোর বিষয়টি কোন গুরুত্ব পেতো না। মেয়েরা তাদের উপস্থিতি রেজিস্টার খাতায় লিখে যার যার বাড়ি ফিরে যেতো। পড়ালেখার কিছুই হতো না। নাঈমা বলেন, ‘শিক্ষকরা একদিকে যেমন ভয়ে থাকতেন। আবার অনেকে আংশিকভাবে দুর্নীতিগ্রস্তও ছিলেন। আমাদের এই এলাকায় এমন অনেক স্কুলের কথা উল্লেখে আছে, যা শুধুই রয়েছে কাগজে কলমে। এসব স্কুলে শিক্ষকদের নিয়োগ দেয়া হয়, এবং এজন্য তারা নিয়মিত বেতনও পান। কিন্তু এসব স্কুল সম্পূর্ণরূপে অকার্যকর।’

এর মধ্যে, বেলুচিস্তান তার চিরাচরিত সহিংস রূপে ফিরে যায়। যার মূল্য দিতে হয় নাঈমার পরিবারকে। এক বছরের মধ্যেই নাঈমার দুই মামার অপহরণ ও মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। নাঈমা বলেন, ‘যে তার দুই মামা হঠাৎ করেই গায়েব হয়ে যান, এক মাস পর তাদের বুলেট-বিদ্ধ মরদেহ উদ্ধার করা হয়। আমার শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়ার মতো সাধ্য আমার পরিবারের ছিল না। তারা সবসময় গ্রামবাসীদের চাপে থাকতো।"

কারণ স্থানীয় মেয়েদের স্কুলে পড়াশুনা করার জন্য উৎসাহিত করা হয়নি, তিনি বলেন,‘হয় তারা মাদ্রাসায় পড়বে নাহলে বাড়ির কাজকর্ম করবে। এর বাইরে কিছু না। এ দিকে আশেপাশে ভণ্ডামিও কম ছিলনা। নারীদের শিক্ষার জন্য বাইরে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হতো না ঠিকই, কিন্তু ক্ষেতে চাষাবাদের কাজে পুরুষদের সাহায্য করার সময়, কোন বাধা নেই। যারা বাসায় থাকে, তারা সূচিকর্মের মাধ্যমে জীবিকা অর্জন করেন কিন্তু নারীরা এই কাজের জন্য কিছুই পেতো না। নারীদের কাজ থেকে উপার্জিত মজুরি পুরুষরাই দখল করে খরচ করতো।’

নাঈমা বাড়ি থেকেই তার পড়াশোনা চালিয়ে যান এবং প্রাইভেট ক্যান্ডিডেট হিসাবে পরীক্ষায় অংশ নেন। এভাবে যখন তিনি হাইস্কুল শেষ করেন, তখন কিছু সময়ের জন্য তার শিক্ষা বাধার মুখে পড়ে, কারণ তার ভাইরা এর বিরোধিতা করেছিল। কিন্তু তার মামাদের খুনের ঘটনা তাকে তার জীবনের নতুন উদ্দেশ্য খুঁজে নিতে সাহায্য করে। তিনি উল্লেখ করেন যে এসব ঘটনা নিয়ে গণমাধ্যমে সম্পূর্ণ নীরবতা ছিল, এবং এটি তার মনের উপর একটি দাগ ফেলে যায়।

তিনি বলেন, ‘বেলুচরা কি মানুষ না? তাদের জীবনকে কেন গণ্য করা হবেনা? আমি এতে অনেক দু:খ পেয়েছিলাম। মানুষ আর কবে বেলুচদের প্রতি তাদের সহানুভূতি ও সংবেদনশীলতা দেখাবে?’ এমন অভিজ্ঞতা থেকেই তিনি সাংবাদিকতাকে পেশা হিসেবে বেছে নিতে চান।

আমার মানুষদের গল্প বলতে চাই:

আন্তর্জাতিক মিডিয়াগুলোর বেলুচিস্তান থেকে রিপোর্ট করার অনুমতি নেই। যদি না তাদের কাছে কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে বিশেষ অনুমতি দেওয়া হয় যা তারা খুব কমই পায়। এই প্রদেশের সহিংসতার বিষয়ে যেকোনো প্রতিবেদন করার ক্ষেত্রে পাকিস্তানের মূলধারার সংবাদমাধ্যমের ওপরেও ছিল গোপন নিষেধাজ্ঞা।

নাঈমা যখন বেলুচিস্তানের একমাত্র মহিলা বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা জানতে পারেন, তখন তিনি তার পরিবারকে তার পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার বিষয়টি বুঝিয়ে বলেন। তার ভাইয়েরা এই প্রস্তাবের সম্পূর্ণ বিরোধিতা করেছিলেন। শুধুমাত্র একজন চাচা ও মামা তাকে সমর্থন দেন এবং এক বছরের জন্য তার পড়াশোনার ফি পরিশোধ করেন।

তারপরে, তার খরচ চালানোর মতো আর কেউ ছিল না। কোন ব্যবস্থাও ছিল না। এমন অবস্থায় তিনি দাতব্য সংস্থা ইউএসএইড- এর স্পন্সরকৃত স্কলারশিপের জন্য আবেদন করেন, যা যুক্তরাষ্ট্রের সরকারের পক্ষ থেকে দেয়া হয়। এখন তার শিক্ষা সম্পূর্ণরূপে চলছে।

নাঈমা বলেন, ‘আমি একজন সাংবাদিক হতে চাই, যেন আমি আমার মানুষ গল্প বলতে পারি, বেলুচিস্তানের মানুষদের আমি তোমাদের বলতে চাই যে আমি ভয় পাব না ... আমি সবসময় সত্যের সাথেই দাঁড়াবো।’

সূত্র: বিবিসি

এমএস/এসি

 


Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি