যেসব কারণে বিশ্বে এত জনপ্রিয় এরদোগান
প্রকাশিত : ১২:৩৪, ২৭ জুন ২০১৯ | আপডেট: ০০:১০, ২৮ জুন ২০১৯
মধ্যপ্রাচ্য, উত্তর আফ্রিকা এবং ফিলিস্তিনসহ ১০টি দেশে ২৫ হাজারের বেশি মানুষের উপর জরিপ চালিয়েছে বিবিসি।
জরিপের বিষয় ছিল, আরব দেশগুলোর জনগণ, আমেরিকা, রাশিয়া এবং তুরস্কের নেতাদের কতটা ইতিবাচক ভাবে দেখে ?
ফলাফলে দেখা গেছে, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের অবস্থান সবার নিচে এবং রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন দ্বিতীয় অবস্থানে। কিন্তু তাদের দুজনের সম্মিলিত গ্রহণযোগ্যতা তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোগানের ধারে-কাছেও নেই।
১১টি দেশের মধ্যে সাতটি দেশে ৫০ শতাংশের বেশি উত্তরদাতা এরদোগানের পক্ষে মতামত দিয়েছেন। প্রথম দেখায় এটা স্বাভাবিক মনে হতে পারে যে, আরব দেশের মানুষ তাদের মতোই মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ আরেকটি দেশ তুরস্কের নেতৃত্বের প্রতি সহানুভূতিশীল হবে।
কিন্তু ইতিহাস বলে ভিন্ন কথা। ২০১৮ সালের শেষ দিকে থেকে শুরু করে ২০১৯ সালের বসন্তকালে পর্যন্ত এ জরিপের সময়কাল ছিল। জরিপে তাদের কাছে নানা বিষয়ের উপর জানতে চাওয়া হয়েছিল।
কঠিন ইতিহাস :
তুরস্ক এবং আরব- এ দুটো ভিন্ন জাতি। তাদের ভাষাও আলাদা। তুরস্কের অটোম্যান সাম্রাজ্য কয়েকশ বছর ধরে মধ্যপ্রাচ্য এবং উত্তর আফ্রিকার একটি বড় অংশ শাসন করেছে। সে সময় তারা আরব দেশের জনগণকে অধিকার বঞ্চিত করেছে।
বর্তমানে আরব দেশগুলোর অন্যতম বিখ্যাত শহর হচ্ছে লেবাননের রাজধানী বৈরুত। এ জায়গাটির `মার্টার্স স্কয়ার` বা `শহীদ চত্বর` ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে আছে। তুরস্কের অটোম্যান শাসকদের দ্বারা আরব জাতীয়তাবাদীদের হত্যার স্মৃতি বহন করছে এই চত্বর। অটোম্যান সাম্রাজ্যের পতনের পরেও সম্পর্কের কোন উন্নতি হয়নি।
অটোম্যান সাম্রাজ্যেরে ভস্ম থেকে জন্ম নিয়েছে তুরস্ক প্রজাতন্ত্রের। ইস্তানবুলে খিলাফত বিলুপ্ত করে ধর্মনিরপেক্ষতার পথ বেছে নিয়েছে তুরস্ক প্রজাতন্ত্র। এই পরিবর্তন মধ্যপ্রাচ্যে ইসলামপন্থীদের বড় ধাক্কা দিয়েছিল। নতুন তুরস্কের গোড়াপত্তনের পর আরবি বর্ণমালা উঠিয়ে দেয়া হয় এবং ল্যাটিন বর্ণমালা চালু করা হয়। এর মাধ্যমে তুরস্ক পাশ্চাত্যমুখি হয়ে উঠার পরিষ্কার ইঙ্গিত দেয়।
তুরস্কের সেনাবাহিনী, যারা ধর্মনিরপেক্ষতায় ছিল প্রতিশ্রুতিবদ্ধ এবং যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ সহযোগী। ইসরাইলের সাথে সে অঞ্চলে যৌথ সামরিক মহড়া করতো তুরস্ক। কিন্তু সেসব দিন এখন আর নেই।
ইসরাইলের সমালোচক:
২০০২ সালে প্রেসিডেন্ট এরদোগানের জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টে পার্টি ক্ষমতায় আসার পর তুরস্কের সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক পরিচয় আবারো ইসলামের দিকে ঝুঁকে পড়ে। মুসলিম বিশ্বের সাথে ঐতিহাসিক সম্পর্ক পুনরায় জাগিয়ে তোলেন তিনি।
তুরস্কের অর্থনীতির স্বার্থে আরব দেশগুলোর সাথে ভালো বাণিজ্যিক সম্পর্ক গড়ে তোলার ইচ্ছে ছিল। বর্তমান তুরস্কে দেশটির সেনাবাহিনী পুরোপুরি বেসামরিক নেতৃত্বের নিয়ন্ত্রণে।
প্রেসিডেন্ট এরদোগান প্রকাশ্যে আমেরিকার সাথে দ্বিমত পোষণ করেন। ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুকে `একটি সন্ত্রাসী দেশের নেতা` হিসেবে টুইটারের মাধ্যমে উল্লেখ করেন এরদোগান।
ফিলিস্তিনের গাজায় ইসরাইলের অবরোধ নিয়ে কড়া সমালোচনা করেন তুরস্কের প্রেসিডেন্ট। গাজাকে একটি `উন্মুক্ত কারাগার` হিসেবে বর্ণনা করেছেন তিনি।
পর্যবেক্ষক মারওয়ান মুয়াশের মনে করেন, ইসরাইলকে নিয়ে এরদোগানের এসব বক্তব্য ফিলিস্তিন এবং জর্ডানে তাঁর ভক্ত বাড়িয়েছে।
তিনি বলেন, "এরদোগানকে দেখা হয় এমন এক ব্যক্তি হিসেবে যিনি ইসরাইল এবং আমেরিকার সামনে দাঁড়িয়েছেন এবং নিজ দেশের মানুষের অর্থনৈতিক উন্নয়ন করেছেন। কিন্তু অর্থনৈতিকভাবে তুরস্ক এখন ভালো অবস্থানে নেই। এরদোগান এখন কর্তৃত্ববাদী পথ বেছে নিয়েছেন।"
বিনয়ী সূচনা:
তুরস্কের একজন বিশ্লেষক ফেহিম তাসতেকিন, যিনি মধ্যপ্রাচ্যে পড়াশুনা করেন, মনে করেন ইসরাইলের সাথে প্রেসিডেন্ট এরদোগানের যে অচলাবস্থা সেটি বাস্তবে যা দেখা যাচ্ছে তার চেয়েও জটিল।
তিনি বলেন, "বাণিজ্যিকভাবে তুরস্ক এবং ইসরাইলের সম্পর্ক নীরবে এগিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু আরব দেশের জনগণ এবং তুরস্কের রাস্তায় এরদোগান আবির্ভূত হয়েছেন এমন একজন নেতা হিসেবে যিনি ইসরাইলের সমালোচনা করেন।"
"কোন পশ্চিমা নেতার মধ্যে তারা এ বিষয়টি লক্ষ্য করেন না"। এরদোগানের উঠে আসার গল্প তুরস্কের বহু মানুষকে আন্দোলিত করে। একটি ধার্মিক পরিবারে জন্ম নেয়া এরদোগান তুরস্কের ধর্মনিরপেক্ষ শাসক গোষ্ঠীকে চ্যালেঞ্জ করেছেন এবং তুরস্কের নীরব সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের পক্ষে কথা বলেছেন। ২০১১ সালে তথাকথিত আরব বসন্ত যখন তিউনিসিয়ায় শুরু হয় তখন বিক্ষোভকারীরা এরদোগানের পক্ষে স্লোগান দেন।
মিশরে অস্থিরতা:
"সুদানের ক্ষমতাচ্যুত প্রেসিডেন্ট ওমর আল বশিরের শাসনামলে দেশটি যখন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় থেকে বিচ্ছিন্ন ছিল, তখন দেশটিতে তুরস্ক বিনিয়োগ করেছিল। এজন্য সুদানের মানুষ কৃতজ্ঞ," বলছিলেন ফেহিম তাসতেকিন।
কিন্তু এই জরিপের ফলাফলে দিকে যদি গভীর মনোযোগ দেয়া যায়, তাহলে দেখা যাচ্ছে আরব বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল দেশ মিশরের মানুষ তুরস্কের নেতৃত্বকে নিয়ে সন্দেহ করে।
মিশরের মাত্র ১৫ শতাংশ মানুষ এরদোগানের পক্ষে। মিশরের প্রেসিডেন্ট আবদেল ফাত্তাহ আল সিসি এবং তুরস্কের নেতা এরদোগানের মধ্যে যে উত্তেজনা চলছে এটি তারই প্রতিফলন।
আরব ব্যারোমিটারের সিনিয়র গবেষক মাইকেল রবিনস মনে করেন, "তুরস্কের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তোলার আকাঙ্ক্ষা ব্যাপকভাবে কমে গেছে মিশর এবং লিবিয়ায়। এ দুটো দেশে ইসলামপন্থীদের বিপক্ষে মনোভাব তৈরি হয়েছে।"
হুসনি মোবারকের পতনের পর মিশরে প্রথমবারের মতো অনুষ্ঠিত অবাধ নির্বাচনে জয়ী হয়ে স্বল্প সময়ের জন্য ক্ষমতায় ছিল মুসলিম ব্রাদারহুড। এরদোগান ইসলামি ভাবধারা উঠে এসছেন। তাঁর চিন্তাধারার সাথে মিলে যায় মিশরের নির্বাচনের ফলাফল।
সে নির্বাচনের মাধ্যমে ইসলামপন্থী মুসলিম বাদ্রারহুড ক্ষমতায় আসে। কিন্তু মোহাম্মদ মুরসি সরকারের বিরুদ্ধে গণ আন্দোলনের পর সেনাবাহিনীর সহায়তায় ক্ষমতা দখল করেন জেনারেল সিসি। জেনারেল সিসির সাথে এরদোগানের বৈরিতার কোনো পাল্টা জবাব ছাড়া শেষ হয়নি।
মাইকেল রবিনসন বলেন, "মিশরে সরকার নিয়ন্ত্রিত গণমাধ্যমে তুরস্কের নেতাকে নেতিবাচকভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। সে জন্য মিশরে এরদোয়ানের খারাপ ফল হয়েছে জরিপে।"
"মিশরের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে এরদোগান পরিষ্কারভাবে একটি পক্ষ নিয়েছিলেন," বলেন ফেহিম তাসতেকিন। সে জন্য এরদোগান সম্পর্কে মিশরের মানুষের মতামত অনেক বেশি বিভক্ত।
মডেল দেশ:
শুধু মিশর এবং লিবিয়া নয়, ইরাকের ক্ষেত্রেও এটি হয়েছে। গোষ্ঠি সংঘাতে বিপর্যস্ত ইরাক। প্রেসিডেন্ট এরদোগান সুন্নি মুসলিমদের পক্ষ নিয়েছেন। এ কথা মনে রাখা দরকার যে একটা সময় পশ্চিমা দেশগুলো এরদোগানকে সম্পর্ক অনেক উচ্চ ধারণা পোষণ করত।
২০১১ সালে যখন আরব বসন্তের সূচনা হয় তখন সে অঞ্চলের ভবিষ্যৎ নিয়ে অনেকে উঁচু আশাবাদ ব্যক্ত করেছিলেন। পশ্চিমা সংবাদমাধ্যম তুরস্ককে একটি `মডেল দেশ` হিসেবে উপস্থাপন করেছিল।
সে বছর ফেব্রুয়ারি মাসে নিউইয়র্ক টাইমস মন্তব্য করেছিল যে তুরস্ক হচ্ছে একটি `শক্তিশালী গণতন্ত্রের` দেশ যেখানে প্রকৃতপক্ষে একজন নির্বাচিত নেতা আছে। এছাড়া তুরস্কের অর্থনীতি সমগ্র আরব অর্থনীতির প্রায় অর্ধেকের সমান বলে মন্তব্য করেছিল নিউইয়র্ক টাইমস। আট বছর পরে সে আশাবাদের সামন্য কিছু অবশিষ্ট আছে।
"আরব বিশ্ব এখনো তার দিকে তাকিয়ে আছে। কারণ তারা অন্য কোন মুসলিম নেতা দেখছেন না যিনি গণতন্ত্রের স্বপ্ন এবং ভালো ভবিষ্যতের মাধ্যমে তাদের অনুপ্রাণিত করতে পারেন," বলছিলেন ফেহিম তাসতেকিন।
অধিকাংশ আরব এখনো এরদোগানের সাথে আছে। এ বিষয়টিকে `মরিয়া হয়ে ওঠার প্রতীক` হিসেবে দেখছেন ফেহিম তাসতেকিন।
বিবিসি অবলম্বনে
এনএম
আরও পড়ুন