ভারতে জৈন তরুণ-তরুণীরা কেন দলে দলে সন্ন্যাস বরণ করছে?
প্রকাশিত : ১৯:০৯, ৮ জুলাই ২০১৯ | আপডেট: ২৩:১৭, ৮ জুলাই ২০১৯
ইন্দ্রবদন সিংহির মেয়ে স্বাভাবিক সাংসারিক জীবন ত্যাগ করে সন্ন্যাসিনী হওয়ার দীক্ষা নিয়েছে। সেই উপলক্ষে বাড়িতে সেদিন একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন হয়েছিল । ঘর-সংসার ছেড়ে মেয়ে এখন চলে যাবে আশ্রমে। সন্ন্যাসিনী হয়ে সেখানেই থাকবে। সংসার জীবনের শেষ কদিনে আত্মীয় স্বজন, বন্ধুরা বাড়িতে এসে দেখা করে যাচ্ছেন মেয়ের সাথে।
২০ বছরের ধ্রুবি আর দশটি মেয়ের মত জীবন যাপন করতো। গান শুনতো। কাছের পার্কে ক্রিকেট খেলতো। বন্ধুদের সাথে রেস্তোরাঁয় খেতে যেত। কিন্তু সন্ন্যাস বরণের পর, সে আর তার বাবা-মাকে বাবা-মা বলে ডাকতে পারবে না। চুল কেটে ন্যাড়া হতে হবে। খালি পায়ে হাঁটতে হবে। খেতে হবে শুধু ভিক্ষা করে। তাও আবার সব খাবার খাওয়া যাবে না।
আরো কিছু কঠোর বিধিনিষেধ তাকে আজীবন মেনে চলতে হবে - গাড়ি চড়া যাবেনা, গোসল করা যাবে না।, ফ্যানের নিচে শোয়া যাবে না,মোবাইল ফোন ব্যবহার করা যাবে না। ধ্রুবি সিংহির পরিবার প্রাচীন জৈন ধর্মের অনুসারী। এখনও ভারতের এই ধর্মের ৪৫ লাখ অনুসারী রয়েছে। যারা এই ধর্মের আচার পালন করেন - তাদেরকে ধর্মগুরুর জারি করা কঠোর বিধিনিষেধের মধ্যে জীবন যাপন করতে হয়।
ইন্দ্রবদন সিংহি জানালেন, তাদের একমাত্র সন্তান ধ্রুবি ছোট থেকেই উচ্ছ্বল, বহির্মুখী ছিল। জিনস পরতো। টিভি রিয়েলিটি শোতে অংশ নেওয়ার আগ্রহ প্রচণ্ড আগ্রহ ছিল। কিন্তু গত পাঁচ বছর ধরে সে ধীরে ধীরে ধর্মের দিকে ঝুঁকছিল। তারপর সম্প্রতি স্বাভাবিক জীবন-যাপন থেকে মুক্ত হয়ে সন্ন্যাসী হওয়ার দীক্ষা নিয়েছে সে।
শুধু ধ্রুবি নয়, তার মতো শত শত জৈন তরুণ-তরুণী পার্থিব জীবন ত্যাগ করে সন্ন্যাস বরণ করছে। বছরে বছরে তাদের সংখ্যা বাড়ছে, এবং ছেলেদের চেয়ে মেয়েরা এই পথে বেশি যাচ্ছে। মুম্বাই বিশ্ববিদ্যালয়ে জৈন দর্শন পড়ান ড: বিপিন দোশী। তিনি বলেন, "আগে বছরে বড় জোর ১০ থেকে ১৫ টি দীক্ষা নেওয়ার ঘটনা ঘটতো।" কিন্তু তিনি জানান, গত বছর সেই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ২৫০। এ বছর সংখ্যা ৪০০ হতে পারে।
২০ বছরের তরুণী ধ্রুবি (বামে) সন্ন্যাস জীবনে দীক্ষা নিয়েছে
কেন এই আকর্ষণ ?
জৈন সমাজের নেতারা বলছেন, প্রধানত তিনটি কারণে এটি হচ্ছে: তরুণ বয়সীরা আধুনিক জীবনের চাপে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ছে, আধুনিক প্রযুক্তির কারণে ধর্মের শিক্ষা, দর্শন নতুন প্রজন্মের কাছে সহজে পৌঁছুচ্ছে, এবং ধর্মীয় স্থানে সফরের সুযোগ তৈরি হওয়ায় অনেক তরুণ-তরুণী সন্ন্যাস জীবনের অভিজ্ঞতা নিতে আকৃষ্ট হচ্ছে।
ড. বিপিন দোশী বলেন, অতিমাত্রায় যোগাযোগ-নির্ভর যে সমাজ এখন তৈরি হয়েছে, তা অনেক মানুষকে প্রচণ্ড মানসিক চাপে ফেলছে। "ইউরোপে কী হচ্ছে, নিউইয়র্কে কী হচ্ছে, সাথে সাথেই আপনি তা দেখতে পারছেন। আগে প্রতিযোগিতা ছিল আপনি যে মহল্লায় বসবাস করেন, তার মধ্যেই সীমিত। এখন প্রতিযোগিতা পুরো বিশ্বের সাথে।"
ফলে, তিনি বলেন, ``পিছিয়ে পড়ার ভয়`` সবসময় মানুষকে তাড়া করছে। আপনি যখন সন্ন্যাস জীবনের জন্য দীক্ষা নিলেন, পার্থিব জীবন বর্জন করলেন, আপনার সামাজিক এবং ধর্মীয় মর্যাদা সাথে সাথে এমন পর্যায়ে উঠে গেল যে ধনী লোকজনও আপনার সামনে এসে মাথা নোয়াচ্ছে।
ফিজিওথেরাপিস্ট পূজা বিনাখিয়া গত মাসে সন্ন্যাসিনীর দীক্ষা নিয়েছেন। তিনি বললেন, তার জীবন পুরোপুরি বদলে গেছে। এর আগে ২৪ ঘণ্টা উদ্বেগের জীবন ছিল পূজার - পরিবারের জন্য উদ্বেগ, বন্ধুদের জন্য উদ্বেগ, নিজের চেহারা নিয়ে উদ্বেগ, পেশা নিয়ে উদ্বেগ। এখন আর তাকে ভাবতে হয়না বন্ধুরা, স্বজনরা তাকে নিয়ে কী ভাবছে, কী চোখে দেখছে।
দীক্ষা নেওয়ার কয়েকদিন আগে ধ্রুবির কথা ছিল তার গুরুই ``তার কাছে সব``। "তিনি আমার জগত। তিনি যা বলেন, সেটাই আমার কাছে শেষ কথা।" নতুন দীক্ষা নেওয়া সব জৈনরাই তাদের গুরুকে নিয়ে, গুরুর কথায় পাগল। ধর্মীয় গুরুরা তাদের শিষ্যদের কাছ শতভাগ আনুগত্য পান।
ড. দোশী বলেন, এই প্রবণতা সবসময় এরকম ছিলনা। "`আগে ধর্মীয় গুরুরা অনেক আত্মকেন্দ্রিক ছিলেন। তাদের নিজেদের আত্মার পরিশুদ্ধি নিয়েই মূলত তারা ভাবতেন। কিন্তু এখন এই ধর্মগুরুরা তরুণ যুবকদের কাছে ধর্মের বানী পৌঁছে দিতে অনেক তৎপর।"
"তারা (গুরুরা) ভালো কথা বলেন, নতুন প্রজন্মের কাছে তারা সহজ সাধারণ একটি জীবনের পথ তুলে ধরেন। তরুণ তরুণীরা তাতে আকৃষ্ট হচ্ছে।" ১০ বছর আগেও জৈনরা তাদের ধর্মীয় বইপত্র পড়তেন শুধু প্রাচীন অর্ধ মগধি এবং সংস্কৃত ভাষায়। কিন্তু এখন অনেক ধর্মীয় বইপত্র ইংরেজিতে অনুবাদ হয়েছে।
"জৈন ধর্মের ইতিহাস নিয়ে শর্ট-ফিল্ম হয়েছে। সোশাল মিডিয়ায় সেগুলো প্রচার করা হচ্ছে। ফলে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে আগ্রহ তৈরি হচ্ছে।"
মূলত হোয়াটসআ্যাপের মাধ্যমে ছড়ানো এসব শর্ট-ফিল্মে সন্ন্যাস জীবনকে অত্যন্ত ইতিবাচক হিসাবে তুলে ধরা হচ্ছে, ধর্ম গুরুদের `সুপারহিরো` হিসাবে দেখানো হচ্ছে। মুনি জিনভটশারিয়া বিজয় মহারাজাসাহেব নামে একজন জৈন ধর্মগুরু নিজে ইউটিউবে বেশ কিছু ভিডিও ছেড়েছেন। ইউটিউবে তার ফলোয়ারের সংখ্যা ১০ লাখেরও বেশি।
ধ্রুবি জানায় পাঁচ বছর আগে একটি আশ্রমে গিয়ে কিছুদিন থাকার পর থেকে সে সন্ন্যাস জীবনের প্রতি আকৃষ্ট হতে শুরু করে। ঐ আশ্রমে গিয়ে কিছুদিন থেকে যে কোনো জৈন, সন্ন্যাস জীবনের অভিজ্ঞতা নিতে পারে। সেখানে খালি পায়ে থাকতে হয়, বিদ্যুৎ নেই, গোসলের ব্যবস্থা নেই। আশ্রমে নির্ভার সহজ এই জীবনযাপনে আকৃষ্ট হচ্ছে অনেকে।
হিতেশ মোতা, যিনি মুম্বাইতে দীক্ষা অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন, বলেন আশ্রমে গিয়ে থাকাটা প্রশিক্ষণের মত কাজ করে। একেকজনের কয়েকবার করে আশ্রমে গিয়ে থাকার ব্যবস্থা করা হয়। "ফলে সন্ন্যাস জীবন সম্পর্কে ভীতি, আধুনিক জীবনযাপন ছেড়ে যাওয়ার ভীতি দূর হয়ে যায়।"
গত মাসে মুম্বাইয়ের কাছে নাসিক শহরে এক জৈন আশ্রমে ৬০০ জনের মত তরুণ তরুণী ধর্মীয় সফরে গিয়ে বেশ কিছুদিন ছিল। তাদের কয়েকশ পরে দীক্ষা নেওয়ার ইচ্ছা জানিয়েছে।
ভালো ছাত্র, স্কেটিং চ্যাম্পিয়ন। খেলাধুলো ছেড়ে, কয়েক সপ্তাহ স্কুল বাদ দিয়ে সে আশ্রমে গিয়েছিল। ক`দিনে ১৮ কেজি ওজন কমেছে। কিন্তু ঐ কিশোরের কথা - তার ``হৃদয় আলো দেখেছে``।
"আমার গুরু বলেছেন, এই পার্থিব জগত ভালো নয়। আমি পাপের জীবন থেকে দূরে যেতে চাই। আমি দীক্ষা নিতে চাই। গুরু বলেছেন যত তাড়াতাড়ি করা যাবে, ততই ভালো। আমি ১৫ বছর বয়সের আগেই দীক্ষা নেব।"
শত শত জৈন তরুণ তরুণী পরিবার ছেড়ে সন্ন্যাস জীবন বরণ করছে হেট দোশীর বাবা-মা তার ছেলের পরিবর্তনে গর্বিত। কিন্তু অনেক পরিবার শঙ্কিত। যেমন ধ্রুবির বাবা-মা কোনদিনই চাননি তাদের একমাত্র মেয়ে সন্ন্যাসিনী হয়ে যাক। আনুষ্ঠানিকভাবে পারিবারিক জীবন ত্যাগ করার দিনে ধ্রুবির বাবা মেয়েকে শেষবারের মত আলিঙ্গন করে বলেন, "দু বছর দেখ কেমন যায়। চাইলে তারপর ফিরে এসো।"
সূত্র, বিবিসি বাংলা
টিআর/
আরও পড়ুন