পুড়ছে আমাজন, তর্কে বিশ্বনেতারা
প্রকাশিত : ১৯:০০, ২৩ আগস্ট ২০১৯
একদিকে পুড়ছে আমাজন আর অন্যদিকে বিষয়টি নিয়ে তর্কে জড়িয়েছেন বিশ্বনেতারা। দাবানলের আগুন বিরতিহীনভাবে শেষ করছে এই আমাজানকে।
দক্ষিণ আমেরিকার আমাজন নদের পাশে প্রায় ৫৫ লাখ বর্গ কিলোমিটার জুড়ে গড়ে উঠেছে সুবিশাল রেইন ফরেস্ট আমাজন। পৃথিবীর ২০ শতাংশ অক্সিজেনের আমদানি হয় এ আমাজন থেকে। বিভিন্ন নাম না জানা মানব গোষ্ঠীর বাসস্থান, রয়েছে ১৬ হাজার প্রজাতির গাছগাছালি। কিন্তু ‘পৃথিবীর ফুসফুস’ খ্যাত এ আমাজন আজ বিপন্ন প্রায়। আগুনের লেলিহান শিখা ক্রমশ গ্রাস করছে ওই চিরহরিৎ বনভূমিকে।
আমাজনের এ অগ্নিকাণ্ডের বিষয়ে একে অপরের দোষ ধরতেই ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন বিশ্বনেতারা। আমাজনের আগুন নিয়ে বিশ্বব্যাপী নিন্দার ঝড় উঠার প্রেক্ষিতে ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট জায়ার বোলসোনারো স্বীকার করেন যে, কৃষকেরা অবৈধভাবে আগুন দিতে পারে, তবে এটি নিয়ে বহির্বিশ্বের ক্ষমতাধর দেশগুলোর নাক গলানোর প্রয়োজন নেই। ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাখোঁ এবং জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস এ বছর আমাজনে রেকর্ডসংখ্যক অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করে টুইট করার পর এভাবেই জবাব দিয়েছেন ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট।
ব্রাজিলের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা ইনপে’র সমীক্ষা সূত্রে জানা যায়, চলতি বছর আমাজন রেইন ফরেস্টে ৭২ হাজার ৮৪৩টি দাবানলের ঘটনা নথিভুক্ত হয়েছে। গত বছরের এই সময়ের তুলনায় যা ৮৩ শতাংশ বেশি এবং ২০১৩ সালের তুলনায় দ্বিগুণ।
আগুনের কারণে কুণ্ডলী পাকানো ধোঁয়ায় ঢাকা পড়েছে সূর্যের মুখ। এমনকি দুই হাজার ৭০০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত ব্রাজিলের সাও পাওলোর দুপুরের আকাশ যেন ‘রাতের চেয়েও অন্ধকার’ হয়ে উঠেছে আগুনের ধোঁয়ায়। ব্রাজিলের রোরাইমা প্রদেশ থেকে পেরুর আকাশেও হানা দিয়েছে ধোঁয়া।
মার্কিন মহাকাশ সংস্থা নাসার উপগ্রহ চিত্রেও ধরা পড়েছে আমাজনে ঘটতে থাকা ৯ হাজার ৫০৭টি নতুন দাবানলের চিত্র। আমাজনের আগুনের ওপর নজর রাখছে নাসা। আগুনের তীব্রতার ছবিও পাঠাচ্ছে নাসার একাধিক স্যাটেলাইট। তবে আগুনের থেকেও বিজ্ঞানীদের বেশি ভাবাচ্ছে আগুন থেকে সৃষ্টি হওয়া ধোঁয়া। প্রায় এক হাজার ৭০০ কি.মি দূরত্ব পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছে কালো ধোঁয়া।
ক্রান্তীয় অঞ্চলে হওয়ায় বছরের বেশিরভাগ সময় বৃষ্টিপাত হলেও জুলাই-আগস্ট মাসে আমাজনের আবহাওয়া কিছুটা শুষ্ক হয়ে ওঠে। তবে স্থানীয় পরিবেশবিদদের ধারণা, প্রাকৃতিকভাবে এ আগুন লাগেনি।
ব্রাজিলের ফেডারেল বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীদের একাংশ বলছেন, শুকনো বাতাসে দাবানল জ্বলে ওঠা অস্বাভাবিক কিছু নয়। তবে এক্ষেত্রে দাবানলের প্রকোপে আগুন লাগেনি বলেই মনে করছেন তারা। বিজ্ঞানীদের মতে, অনেক সময়ই চাষের জন্য জমি বা খামার তৈরি করতে ইচ্ছাকৃতভাবে জঙ্গলে আগুন ধরিয়ে দেন স্থানীয় গ্রামবাসীরা। এক্ষেত্রেও এমনটাই হচ্ছে কিনা তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।
জলবায়ু বিজ্ঞানী কার্লোস নোব্রে বলেছেন, গবাদিপশুর চারণভূমি হিসেবে জমি ব্যবহার করতে চাওয়া কৃষকেরা জায়গা পরিষ্কার করতে শুকনো আবহাওয়ার জন্য অপেক্ষা করেন। এ সময় বন দাহ্য হয়ে থাকে এবং খুব সহজেই তাতে আগুন লাগে।
খনিজ পদার্থের ভাণ্ডার এই আমাজন বন। খনিজ পদার্থের খোঁজে আমাজন বন লাগাতার সাফ করে খনন কাজ চালানো হয়। সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান বলছে, প্রতি মিনিটে একটি ফুটবল মাঠের সমান জঙ্গল কাটা হয় এখানে। ফলে স্বল্প বৃষ্টিপাতও আমাজনে আগুন লাগার অন্য একটি কারণ হতে পারে বলে ধারণা করছেন বিজ্ঞানীদের আর একটি অংশ। কার্বন ছাকনি হিসেবে পরিচিত চিরসবুজের এ জায়গা যে এই ঘটনার পর তার কার্যক্ষমতা হারাবে সে বিষয়ে নিশ্চিত গবেষকরা।
এদিকে আমাজনে ভয়াবহ পরিস্থিতির জন্য ডানপন্থী প্রেসিডেন্ট জেইর বোলসোনারোর নীতিকে কাঠগড়ায় তুলেছেন পরিবেশবিদরা। চলতি বছরের জানুয়ারিতে ক্ষমতায় আসার আগে আন্তর্জাতিক হুঁশিয়ারির তোয়াক্কা না করেই আমাজন অঞ্চলকে চাষ ও খনিজ উত্তোলনের কাজে ব্যবহারের কথা বলেছিলেন তিনি। তার এ উদ্যোগের ফলে বন উজাড় হয়ে যেতে পারে আন্তর্জাতিক মহলের এমন উদ্বেগ দিনের পর দিন উপেক্ষা করে গেছেন বোলসোনারো। ফলস্বরূপ আমাজনে অন্তত ৭২ হাজার অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। মৃত্যু হয়েছে অনেক পশুপাখিরও।
প্রতিবছর ২’শ কোটি মেট্রিক টন কার্বন ডাই-অক্সাইড শোষণ করে এ বন। আর সে কারণেই বিশাল এই বন ‘পৃথিবীর ফুসফুস’ নামে পরিচিত। এছাড়া পৃথিবীর বেশিরভাগ নদীর উৎস আমাজন। এখানে রয়েছে ৪৫ লাখ প্রজাতির পোকামাকড়, বাস করে তিন শতাধিক উপজাতি।
অথচ অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এ বনই আজ হুমকির মুখে। প্রতিনিয়ত অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় এই বন পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে। এমনটা চলতে থাকলে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম হয়তো এই অরণ্যের কথা শুধু বইয়েই পড়বে। এখনই সচেতন না হলে পৃথিবীতে আর কোনো অরণ্যই থাকবে না।
আমাজন রক্ষায় সেখানকার স্থানীয় প্রশাসনের দায় সবচেয়ে বেশি। তবে আমরা যারা আমাজনের কাছাকাছি নেই তাদেরও অনেক দায় আছে।
বছরের এই শুষ্ক সময়ে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা নিয়মিত ও প্রাকৃতিক হলেও, পশু চারণভূমির জন্য বনাঞ্চল পরিষ্কার করতে কৃষকদের আগুন দেওয়ার প্রবণতা বেড়ে যাওয়াকেই দায়ী করছেন পরিবেশবিদরা।
সিএনএন'র এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আমাজন বন থেকে ২ হাজার ৭শ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত ব্রাজিলের সাও পাওলো। সেখানকার আকাশও ঘন কালো হয়ে আছে। সূর্যের মুখ ঢাকা পড়েছে। চারদিকে শুধু কুণ্ডলী পাকানো ধোঁয়া। সবুজ বনের ওপর দিয়ে লাল অগ্নিশিখা বয়ে বেড়াচ্ছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের স্যাটেলাইট প্রকল্প কোপের্নিকাস আগুনের ধ্বংসযজ্ঞের একটি ম্যাপ প্রকাশ করেছে। ব্রাজিল থেকে পূর্ব আটলান্টিক উপকূল পর্যন্ত ‘আগুন পথের’ চিহ্ন আঁকা হয়েছে। দেশটির অর্ধেক জায়গাজুড়েই এখন কালো ধোঁয়া। সেই ধোঁয়া পার্শ্ববর্তী পেরু, বলিভিয়া এবং প্যারাগুয়েতেও পৌঁছে গেছে।
আমজনে আগুন লাগা কোনো অস্বাভাবিক ঘটনা নয়, কিন্তু এবারের মতো আগুন আগে কখনও ছড়ায়নি। অগ্নিকাণ্ডের জন্য ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট দুষছেন বেসরকারি এনজিওগুলোকে। যদিও এনজিওরা দায়ী করছে ব্রাজিল সরকারের উন্নয়ন নীতিকে। এ ঘটনায় এরই মধ্যে প্রশ্নবাণে জর্জরিত হয়েছেন দেশটির পরিবেশ মন্ত্রী রিকার্ডো সালেস। জলবায়ু বিষয়ক এক অনুষ্ঠানে বক্তব্য দিতে মঞ্চে উঠলে তোপের মুখে পড়েন তিনি।
এদিকে আমাজনে বারবার আগুন লাগার ঘটনাকে বৈশ্বিক সমস্যা উল্লেখ করে, এর জন্য পুরো বিশ্ব হুমকিতে পড়বে বলে সতর্ক করেছেন ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাঁক্রো। এক টুইট বার্তায় তিনি বলেন, আসন্ন জি-টোয়েন্টি সম্মেলনে আমাজনের বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে তোলা উচিত। ভয়াবহ দাবানলের ঘটনায় পরিবেশবাদীদের পাশাপাশি বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষের মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেইসবুক ও টুইটারে।
এমএস/এসি
আরও পড়ুন