ঢাকা, শনিবার   ২৩ নভেম্বর ২০২৪

যেভাবে টাক পড়ার লজ্জা জয় করলেন এই তরুণী

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ১০:৪৭, ৩০ আগস্ট ২০১৯ | আপডেট: ১০:৫০, ৩০ আগস্ট ২০১৯

বিশ্ব জুড়ে প্রায় ১৪ কোটির বেশি মানুষের অ্যালোপেসিয়া অর্থাৎ পূর্ণ অথবা আংশিক টাক রয়েছে। এর ফলে স্বাস্থ্যবান লোকজনের মাথা বা শরীরের চুল কমে যেতে শুরু করে। অনেক সময় সব চুল পড়ে যায়, এমনকি ভ্রু বা চোখের পাপড়িও পড়ে যায়।

১১ বছর আগে এমনই অ্যালোপেসিয়া রোগের শিকার হন লিলিয়া কুকুশকিনা নুগমানোভা নামক এক রাশিয়ান তরুণী। যে কারণে স্কুলে নানারকম বিদ্রূপের শিকার হতো সে।

এখন ২৮ বছরের লিলিয়া রাশিয়ায় একটি গ্রুপ তৈরি করেছেন, যারা এ রকম অভিজ্ঞতার শিকার ব্যক্তিদের সহায়তা করে। এ বিষয়ে লিলিয়া বলেন, 'যখন মানুষ আপনাকে দেখতে পান, তাদের প্রথম চিন্তা হয়- তার হয়তো ক্যান্সার অথবা দাদ হয়েছে।'

তিনি আরও বলেন, 'আমাকে বর্ণনা করতে হয়েছে যে, আমার চুল পড়ে যাবার সমস্যা রয়েছে এবং এটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। আমি মারা যাচ্ছি না, আমি ঠিক আছে আর এটা ছোঁয়াচেও নয়।'

লিলিয়া বলছেন, কিশোরী বয়সে পৌঁছানোর আগে তিনি বুঝতেও পারেননি যে, তিনি অন্যদের চেয়ে আলাদা।

তিনি বলেন, 'যখন আমার বয়স ১৭ বছর, তখন আমার সবচেয়ে কঠিন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে হলো। আমার স্কুলে ছেলেদের একটা দল ছিল। আমরা তাদের সঙ্গে বেশি মিশতাম না, তাই তারা সামাজিক মাধ্যমে একটি গ্রুপ তৈরি করে এবং তার নাম দেয়, 'মিস নুগমানোভা একজন নেড়া কুকুর।'

'তারা ভেবেছিল, আমি হয়তো খুব আহত হবো। সত্যি বলতে, সেটা খানিকটা হয়েছিও, কিন্তু আমি জানতাম, এটা আমার কোন ক্ষতি করতে পারবে না। ওটার কারণেই আমি একজন খারাপ মানুষ হয়ে যাবো না।'

লিলিয়া স্বীকার করেন যে, তার চেহারার বিষয়ে মেনে নেয়ার ব্যাপারটি তার জন্য কঠিন ছিল, কিন্তু ভাগ্যক্রমে, তিনি এখন ভালোই বোধ করেন।

নিজের ব্যাপারে লিলিয়ার মেনে নেয়ার বিষয়টি চূড়ান্ত ধাপে পৌঁছায় এ বছরের শুরুর দিকে, যখন তিনি তার সংগ্রাম নিয়ে একটি লেখা লেখেন এবং কোন পরচুলা ছাড়াই ফেসবুকে একটি ছবি পোস্ট করেন।

ওই ছবিটি দ্রুতই ছড়িয়ে পড়ে, যার সঙ্গে অনেক মানুষ তাদের টাক বা চুল পড়ে যাওয়ার অভিজ্ঞতা নিয়ে মন্তব্য করতে থাকেন।

এর আগ পর্যন্ত লিলিয়ার বন্ধু, সঙ্গী বা সহকর্মীদের অনেকে কখনও তাকে পরচুলা ছাড়া দেখেননি এবং তার অবস্থার ব্যাপারে কিছু জানতেন না।

এ বিষয়ে লিলিয়া বলেন, 'আমার পরচুলা অনেকটা আমার প্রতিরক্ষার মতো কাজ করতো। কিন্তু এটা অনেক সীমাবদ্ধতাও তৈরি করেছিল।'

তিনি বলেন, 'কিশোরী বয়সে আমি অনেক মজার কর্মকাণ্ডে অংশ নিতে পারিনি, কারণ আমার ভয় হতো যে, পরচুলাটা হয়তো পড়ে যাবে। আমি রোলার কোস্টার থেকে দূরে থাকতাম, সাতার কাটা বা ডাইভিং করার মতো ব্যাপারে কখনও যাইনি। যৌনমিলন নিয়েও আমার একই রকম আতঙ্ক ছিল।'

'ভেবে দেখুন, আপনার সঙ্গী জানেন না যে, আপনি পরচুলা পরে আছেন, আর যৌনমিলনের সময় সেটি খুলে পড়ে গেল....এটা তার জন্য ভীতিকর অভিজ্ঞতার হতে পারে।' -লিলিয়া বলছেন।

লিলিয়া এখনও মাঝেমধ্যে পরচুলা পড়েন কিন্তু তিনি এখন সেটাকে প্রয়োজনের তুলনায় একটি ফ্যাশনের অংশ হিসাবেই দেখেন।

গ্রহণযোগ্যতা
এ বিষয়ে লিলিয়ার বক্তব্য, 'আমি যদি আমার সেই কিশোরী বয়সকে পরামর্শ দিতে পারতাম, তাহলে বলতাম যে, পরচুলা নিয়ে চিন্তা বন্ধ করে আনন্দ করে নাও।'

যেসব মানুষ তাদের টাকের বিষয়ে উপেক্ষা করে আনন্দ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তাদের অনেকে অবশ্য অনলাইন আর অফলাইনে অপ্রীতিকর মন্তব্যের মুখোমুখিও হচ্ছেন।

তবে লিলিয়া স্বীকার করেন, নিজের চেহারার বিষয়টি মেনে নেয়া প্রথমদিকে কঠিন ছিল। 'অবশ্যই যেসব মানুষ টাক বা কেশ বিরলতার বিষয়টি সম্পর্কে জানে না, তারা হয়তো আমাকে দেখে ভয় পেতে পারে। অনেক সময় তারা নিষ্ঠুরও হয়।'

'তারা হয়তো বলতে পারতো- চুলসহ তোমাকে এতোটা ভালো লাগে না, বরং চুল ছাড়াই তোমাকে বেশি আকর্ষণীয় মনে হয়।'

"কিন্তু সত্যি বলতে কি, কীভাবে আমাকে প্রশংসা করতে হবে, সেটা না জানার জন্য মানুষকে দোষ দিতে চাই না। তারা যদি ভালো বোঝাতে চায়, তাহলেই যথেষ্ট।"

এই বিষয়ে আরও ভালোভাবে জানা এবং এ ধরণের আরও মানুষজনের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার পর লিলিয়া আরও আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠেছেন। লিলিয়া মনে করেন, এ নিয়ে মানুষের অযথা বিরূপতা দূর করতে হলে এই বিষয়ে সচেতনতা ছড়িয়ে দেয়া জরুরি।

তিনি বলছেন, কখনও কখনও তিনি বন্ধু এবং অপরিচিত মানুষের কাছ থেকেও এসব বিষয়ে প্রশ্ন শুনতে পান।

'একবার খুব ছোট একটি শিশু আমাকে রাস্তায় দেখতে পেয়ে জিজ্ঞেস করে, কেন আমার মাথায় চুল নেই। আমি বুঝতে পারছিলাম না যে, কীভাবে তাকে এটা ব্যাখ্যা করবো। সুতরাং আমি একটা তুলনা করার চেষ্টা করলাম যে, আমি হচ্ছি মানুষের মধ্যে লোমহীন বিড়াল।'

'আমার কোন চুল নেই, কিন্তু তার মানে এই নয় যে, অন্য সবার চেয়ে আমি ভালো অথবা খারাপ কোন মানুষ।'

অন্যদের সাহায্য করা
লিলিয়া বলছেন, চুল হারানোর সমস্যায় থাকা শিশু এবং তাদের অভিভাবকদের জন্য কটু মন্তব্য কঠিন একটা বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। আর তাই তিনি সহায়তা গ্রুপের মাধ্যমে তাদের সাহায্য করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।

'আমি জানি, যেসব শিশুদের টাক সমস্যা রয়েছে, তাদের বাবা-মা ভয় পান যে, তাদের মেয়েটির হয়তো বিয়ে হবে না বা ভালো চাকরি পাবে না। তারা ভয় পান যে, তাদের ছেলেটি হয়তো কটু মন্তব্যের শিকার হবে এবং নেতাদের মতো সম্মান পাবে না।'

যুক্তরাজ্যের স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের তথ্য মতে, দেশটিতে বর্তমানে টাক পড়া বা চুল হারানোর এমন কোন চিকিৎসা নেই, যা শতভাগ কার্যকরী। 

তবে চুল হারানোর মতো ঘটনায় কোন চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া চিকিৎসা নেয়ার ব্যাপারে সতর্ক করে দিচ্ছেন লিলিয়া।

তিনি বলেন, 'অনেক সময় অভিভাবকরা টাক পড়া বন্ধ করার চেষ্টা করেন এবং এমন সব পদ্ধতি বেছে নেন, যা শুনলে আমার শরীর ঠাণ্ডা হয়ে যায়। আমার বাবা-মাও সেই চেষ্টা করেছিলেন। আমরা লেজার প্রক্রিয়া এবং মাথার খুলির চামড়া পুড়িয়ে দেয়ার মতো পদ্ধতি চেষ্টা করেছিলাম। আমরা হরমোন ইনজেকশন দিয়েছিলাম, যা শিশুদের স্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব ফেলতে পারে। কিন্তু এসব না করার জন্য আমি সবাইকে পরামর্শ দেবো।'

লিলিয়া বলছেন, টাক পড়া নিয়ে সহায়তা গ্রুপের কাজ তার পেশাজীবন বদলে দিয়েছে। ব্যবস্থাপনা পেশা ছেড়ে তিনি এখন সামাজিক কর্মী হিসাবে কাজ শুরু করেছেন।

'যখন আপনি টাক পড়ার বা চুলহীনতার শিকার অন্য মানুষদের সঙ্গে মিশবেন, আপনি উপলব্ধি করবেন যে, এটার সঙ্গে মানিয়ে নেয়ার অনেক উপায় রয়েছে। সবচেয়ে জটিল ব্যাপারটি হলো, এটা আপনাকে একা একা করতে হবে না।'

লিলিয়া বলেন, 'বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলা ভালো, চিকিৎসকদের সঙ্গে কথা বলা যেতে পারে অথবা একটি সহায়তা গ্রুপে অংশ নেয়া, যেখানে যেসব মানুষরা এসব জটিলতা কাটিয়ে উঠেছেন, তারা আপনাকে পরামর্শ দিতে পারবেন।'

'আর এটা আমাকে সাহায্য করেছে, সুতরাং অন্যদেরও নিশ্চয়ই সহায়তা করবে।' যোগ করেন লিলিয়া। সূত্র- বিবিসি। 

এনএস/


Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি