ব্রিটেনে ৭০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচন আজ
প্রকাশিত : ০৮:৪৩, ১২ ডিসেম্বর ২০১৯ | আপডেট: ০৮:৪৩, ১২ ডিসেম্বর ২০১৯
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ব্রিটেন এমন নির্বাচনের মুখোমুখি আর হয়নি বলে বলা হচ্ছে। এর কারণ আজ বৃহস্পতিবারের সাধারণ নির্বাচনের ফলাফলের ওপর দেশটির ভবিষ্যতের অনেক কিছু নির্ভর করছে।
ব্রেক্সিট অর্থাৎ ব্রিটেনের ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন ত্যাগের প্রশ্নে প্রায় তিন বছর ধরে পার্লামেন্টে যে অচলাবস্থা তৈরি হয়েছিল, তার পরিপ্রেক্ষিতে গত দু’বছরের মধ্যে এটি দ্বিতীয় সাধারণ নির্বাচন।
দেশটির প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনের কনসারভেটিভ পার্টি সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে সরকারে ফিরবে বলে আশা করছে। অন্যদিকে, জেরেমি করবিনের নেতৃত্বাধীন লেবার পার্টি ব্রেক্সিটের পরিবর্তে তাদের নানা ধরণের রাষ্ট্রীয় কল্যাণমূলক কর্মসূচিকেই তাদের প্রচারণায় প্রাধান্য দিচ্ছে।
ব্রিটেনের সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটার ২০১৬’র গণভোটে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন ত্যাগের পক্ষে রায় দেয়। তার আগের কয়েক দশক ধরে ব্রিটেন এবং ইইউর অর্থনীতি এবং বাণিজ্য অত্যন্ত ঘনিষ্ঠভাবে সংযুক্ত ছিল।
তাই গণভোটের পরই কথা ওঠে যে ইইউ ত্যাগ করার ফলে যাতে অর্থনীতি ও ব্যবসা-বাণিজ্যের কোন ক্ষতি না হয়, দু-অংশের জনগণ চাকরিবাকরি থেকে শুরু করে বিভিন্ন ক্ষেত্রে যেসব সুবিধা ভোগ করতেন সেগুলোতে কোনও ছেদ যেন না পড়ে- তাই ব্রেক্সিট কীভাবে হবে তা আগে থেকেই একটা চুক্তির ভিত্তিতে স্থির করে নিতে হবে।
বর্তমান প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন এবং তার আগে প্রধানমন্ত্রী থেরেসা মে এ রকম চুক্তি করে এসেছিলেন ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের সঙ্গে। কিন্তু তা তারা পার্লামেন্টে পাস করাতে পারেননি। কারণ কনসারভেটিভ পার্টির একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছিল না, তাদের কোয়ালিশন অংশীদার ওই চুক্তিকে সমর্থন করেনি এবং চুক্তিটি যে লেবার পার্টিসহ অন্য বিরোধীদলগুলোর সমর্থন পাবে - তাও হয়নি।
ফলে থেরেসা মে তিনবার এবং বরিস জনসন একবার পার্লামেন্টে তুলেও তাদের ব্রেক্সিট চুক্তি পাস করাতে পারেননি।
পার্লামেন্টে সৃষ্টি হয় ব্রেক্সিটকে কেন্দ্র করে নজিরবিহীন তিক্ততা ও বিভক্তি, এবং অচলাবস্থা। ব্রেক্সিট হবে কি হবে না- এই অনিশ্চয়তায় ব্যবসাবাণিজ্যে তৈরি হয়েছে স্থবিরতা।
অনেকে বলছেন, ব্রিটেনে রাজনীতিবিদদের ওপর জনগণের আস্থাই কমে যাচ্ছে। কনসারভেটিভ এবং লেবার দু’দলই ব্রেক্সিট চাইছে ভিন্ন ভিন্ন ভাবে।
এ অবস্থার সমাধানের জন্যই নতুন এই নির্বাচন দেয়া হয়েছে- যাতে কোনও একটি দল সুস্পষ্ট সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে এসে ব্যাপারটাকে সামনে এগিয়ে নিতে পারে।
এর একটি কারণ ব্রেক্সিট, অপরটি হলো এ নির্বাচনের পটভূমি- যে নজিরবিহীন তিক্ততা, বৈরিতা এবং বিভক্তির প্রেক্ষাপটে এ নির্বাচন হচ্ছে।
বলা হচ্ছে, ব্রেক্সিট হবে কি না বা কীভাবে হবে তা নির্ধারিত হবে এ নির্বাচনে। ব্রেক্সিট যদি হয়, তাহলে তা ব্রিটেনের সমাজ ও অর্থনীতিতে এক যুগান্তকারী পরিবর্তন নিয়ে আসবে। কিন্তু যারা ব্রেক্সিটের বিরোধী তারা বলছেন, এর পরিণতিতে যুক্তরাজ্য ভেঙে যেতে পারে- কারণ স্কটল্যান্ড এবং উত্তর আয়ারল্যান্ডে ব্রেক্সিটের বিরুদ্ধে জোর জনমত আছে।
অন্যদিকে, ব্রেক্সিটের প্রতিক্রিয়া পড়বে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের ওপরও। অনেকের মতে, ইইউর ঐক্যও হুমকির মুখে পড়তে পারে। এক কথায় গোটা ইউরোপেই অনেক সুদূর প্রসারী পরিবর্তন আসতে পারে এবং এগুলো সবই ঘটতে পারে ব্রেক্সিটের কারণে।
আর এ নির্বাচনের পরিণতিতে ব্রেক্সিট যদি না হয়- তাহলে অনেকের মতে ব্রিটেনে এক গভীর রাজনৈতিক সংকট দেখা দেবে। জনগণের একাংশের মধ্যে গুরুতর বিভক্তি ও অবিশ্বাস সৃষ্টি হবে, রাজনৈতিক ব্যবস্থা ও রাজনীতিবিদদের প্রতি সৃষ্টি হবে জনগণের গভীর অনাস্থা। অনেকে সামাজিক সংঘাতের আশংকাও প্রকাশ করছেন। তাই বলা হচ্ছে এটা যুক্তরাজ্যের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচন।
ব্রেক্সিটকে নিয়ে সমাজে এবং রাজনীতিতে তৈরি হয়েছে তীব্র মতবিরোধ, তিক্ততা এবং বিভক্তি। ঘটেছে এমন সব ঘটনা যা ব্রিটেনে নিকট অতীতে দেখা যায়নি- বলেছেন অনেক রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক।
ব্রেক্সিটকে কেন্দ্র করে আদালতে মামলা হয়েছে। একটি দল ব্রেক্সিট বাতিল করাকে তাদের প্রধান নির্বাচনী অঙ্গীকার বানিয়েছে। পার্লামেন্টে বার বার ভোট করেও ব্রেক্সিট প্রস্তাব পাস করাতে না পেরে পদত্যাগ করেছেন পূর্বতন প্রধানমন্ত্রী থেরেসা মে।
বরিস জনসনও তার প্রস্তাব পাস করাতে পারেননি। এর পর তিনি পার্লামেন্ট স্থগিত করে দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু আদালতের রায়ে তার সে পদক্ষেপ খারিজ হয়ে পার্লামেন্ট আবার বসে।
লেবার ও কনসারভেটিভ উভয় দলেরই বেশ কিছু এমপি দল ছেড়েছেন। কেউ নতুন দল করেছেন, কয়েকজন প্রথম সারির রাজনীতিক রাজনীতি থেকে কার্যত বিদায় নিয়েছেন।
কয়েকজন প্রবীণ রাজনীতিবিদ প্রকাশ্যেই জানিয়েছেন, তারা এবার তাদের নিজস্ব দলকে ভোট দেবেন না- তারা ভোটারদেরকে অন্য দলের পক্ষে ভোট দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।
বহু এমপি বলছেন, তারা হত্যার হুমকি পেয়েছেন। সন্দেহ করা হয় যে ২০১৬ সালে জো কক্স নামে একজন এমপি খুন হওয়ার পেছনেও কারণ ছিল ব্রেক্সিট।
এরকম নানা নজিরবিহীন ঘটনা ঘটেছে গত তিন বছরে। এতে ব্রিটেনের রাজনীতিতে যে তিক্ততা এবং বিভক্তি তৈরি হয়েছে- তাও নজিরবিহীন।
নির্বাচনী প্রচারণার শুরু থেকেই জনমত জরিপগুলোতে দেখা যাচ্ছে যে প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনের কনসারভেটিভ পার্টি এগিয়ে আছে। তারা প্রধান বিরোধী দল জেরেমি করবিনের লেবার পার্টির চাইতে বিভিন্ন সময় অন্তত ৬ থেকে ১৫ পয়েন্টের বেশি ব্যবধানে এগিয়ে ছিল। কিন্তু একেবারে সর্বশেষ জনমত জরিপে দেখা যাচ্ছে এই ব্যবধান কিছুটা কমে এসেছে।
সবশেষ জরিপে দেখা যাচ্ছে, কনসারভেটিভ পার্টিকে ৪৩ শতাংশ এবং লেবার পার্টিকে ৩৩ শতাংশ ভোটার সমর্থন করছে বলে বলা হচ্ছে। তবে এসব জনমত জরিপ কতটা নির্ভরযোগ্য তা নিয়ে প্রশ্ন আছে। ব্রিটেনের ইতিহাসে এসব জনমত জরিপের ভবিষ্যদ্বাণী কখনও সঠিক হয়েছে, কখনও ভুলও হয়েছে।
নির্বাচনী বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ব্যবধান কমে আসার ফলে কনসারভেটিভ পার্টি সবচেয়ে বেশি আসনে জিতলেও সুস্পষ্ট সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পাওয়ার সম্ভাবনা এখন আগের চাইতে বেড়ে যাচ্ছে।
যদি ঝুলন্ত পার্লামেন্ট হয়, তাহলে যে অনিশ্চিত অবস্থা থেকে বেরুনোর জন্য এ নির্বাচন হচ্ছে - সেই একই অবস্থা ব্রিটেন আবার ফিরে আসতে পারে।
ব্রিটিশ পার্লামেন্টে নিম্নকক্ষে আসন সংখ্যা ৬৫০টি। স্পষ্ট সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেতে হলে কোনও একটি দলকে ৩২৬টি আসন পেতে হবে। তাই বরিস জনসন বা জেরেমি করবিন- দুজনেরই আসল লক্ষ্য হচ্ছে শুধু সবচেয়ে বেশি আসনে জেতা নয়- একটা স্পষ্ট সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়া।
তাই জনমত জরিপ যাই বলুক- আসলে কি হবে তা বোঝা যাবে বৃহস্পতিবার ভোটের ফল আসতে শুরু করার পরই।
সূত্র: বিবিসি
একে//
আরও পড়ুন