ঢাকা, সোমবার   ২৫ নভেম্বর ২০২৪

নাগরিকত্ব আইন: দিল্লিতে রুখে দাঁড়ানো নারীরা

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ১০:২৭, ৭ জানুয়ারি ২০২০ | আপডেট: ১০:৫৮, ৭ জানুয়ারি ২০২০

ভারতের রাজধানী দিল্লিতে গত ৩১ ডিসেম্বর ছিল একশো বছরের মধ্যে সবচেয়ে ঠাণ্ডা রাত। কিন্তু তা শাহিন বাগের নারীদের দমাতে পারেনি। মোটা কম্বল, হাতে গরম চায়ের মগ আর প্রতিরোধের গান গেয়ে গেয়ে তারা একটি সড়কে তাঁবুর নীচে অবস্থান নিয়ে ছিলেন, যেখানে তারা গত ১৫ ডিসেম্বর থেকে রয়েছেন।

এর কয়েক মিনিট পরেই নতুন বছরের সূচনা হয়েছে, তখনও তারা ভারতের জাতীয় সংগীত গাইছিলেন।

গত ১১ ডিসেম্বর থেকে আইনটি কার্যকর হয়েছে, যেখানে পাকিস্তান, বাংলাদেশ এবং আফগানিস্তান থেকে আসা অমুসলিমদের নাগরিকত্ব দেয়ার বিধান রাখা হয়েছে।

ভারতীয় জনতা পার্টি নেতৃত্বাধীন সরকার বলছে, এটা সেসব দেশ থেকে পালিয়ে আসা ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা দেবে।

কিন্তু সরকারি এসব বক্তব্য ভারতীয় মুসলমানদের কমই আশ্বস্ত করতে পারছে, যাদের অনেকেই আশঙ্কা করছেন যে, এই আইনটি তাদের জন্য বৈষম্যমূলক হবে। এমনকি হয়ত তাদেরকে সেসব দেশে ফেরত পাঠানো বা বন্দিশিবিরে পাঠানোর মতো ঘটনাও ঘটতে পারে।

‘আমি খুব কমই একা বাসার বাইরে বের হয়েছি,’ বলছেন ফিরদাউস শাফিক, আন্দোলনকারীদের একজন। ‘সবসময়ে আমার ছেলে বা স্বামী আমার সঙ্গে থেকেছে, এমনকি যখন আমি কাছাকাছি মার্কেটেও গিয়েছি। সুতরাং প্রথম এখানে যখন এলাম, সেটা একটু কষ্টকরই ছিল।’

‘কিন্তু আমি এটা বোধ করছিলাম যে, আমার প্রতিবাদ করা উচিত।’

অ্যাক্টিভিস্টদের মতে, ফিরদাউস শাফিকের মতো শাহিন বাগের মতো আন্দোলন গড়ে তোলা বেশ ব্যতিক্রমী।

দিল্লিভিত্তিক মুসলমান নারী ফোরামের প্রতিষ্ঠাতা সায়েদা হামিদ বলছেন, ‘এই নারীরা অ্যাকটিভিস্ট নন।’

বরং তারা সাধারণ মুসলমান নারী। তাদের অনেকেই গৃহিণী, যারা এই আন্দোলনের একেবারে মধ্যে দাঁড়িয়ে গেছেন।

‘এই প্রথমবারের মতো তারা জাতীয় কোনও ইস্যুতে সামনে এগিয়ে এলেন, যা ধর্মীয় বাধা ভেঙ্গে দিয়েছে। আমি মনে করি এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। যদিও এর সঙ্গে মুসলমানদের শিকার বানানোর একটা বিষয় জড়িত আছে, কিন্তু তারপরেও ইস্যুটি আসলে উদার দৃষ্টিভঙ্গির একটা বিষয়।’

যখন আন্দোলন শুরু হয়, তখন কতজন নারী সেখানে উপস্থিত ছিলেন, সেটা বলা কঠিন, কিন্তু সংখ্যাটি খুব তাড়াতাড়ি বেড়েছে।

তারা প্রথম বাইরে বেরিয়ে আসেন ১৫ ডিসেম্বর রাতে-যখন দিল্লির জামিয়া মিল্লিয়া ইসলামিক ইউনিভার্সিটির ছাত্রদের একটি বিক্ষোভ পুলিশের সঙ্গে সহিংসতার মধ্য দিয়ে শেষ হয়। বিশ্ববিদ্যালয় জানিয়েছে যে, পরে পুলিশ অনুমতি ছাড়াই ক্যাম্পাসে প্রবেশ করে কর্মী এবং শিক্ষার্থীদের লাঞ্ছিত করেছে। ওই রাতের পর বিক্ষোভটি সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে।

যখন অনেক বিক্ষোভকারী এসেছেন এবং চলে গেছেন, কেউ কেউ সহিংসতায় নিহত হয়েছে, তখন শাহিন বাগের বিক্ষোভকারীরা সেখানেই শান্তিপূর্ণভাবে অবস্থান নিয়ে রয়েছেন।

কিন্তু এটা যেহেতু পূর্ব দিল্লি এবং নদীয়ার সীমান্তে, একটি উপশহর এবং যাতায়াতের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, ফলে অনেকেই এই বিক্ষোভে খুশি নয়।

স্থানীয় একজন দোকানদার বলছেন, ‘এটা আমাদের ব্যবসায় ক্ষতি করছে।’

নয়ডার একজন বাসিন্দা বলছেন, এর ফলে তাকে এখন কাজে যেতে হলে দ্বিগুণ পথ ঘুরে যেতে হয়।

বিক্ষোভকারীরা বলছেন, তারা কারও জীবনযাপনে সমস্যা তৈরি করতে চান না, শুধু শান্তিপূর্ণ অবস্থান নিয়ে থাকতে চান।

তবে অনেক দোকানদার এই বিক্ষোভের সঙ্গে একাত্মতা জানাতে সামনে এগিয়ে এসেছেন- অনেকে বিক্ষোভকারীদের খাবারদাবারও দিচ্ছেন।

আসলে বিক্ষোভ যত বড় হচ্ছে, সারা শহর থেকে মানুষ এসে এর সঙ্গে যোগ দিচ্ছেন, যাদের মধ্যে রয়েছে রাজনৈতিক বক্তা থেকে শুরু করে শিক্ষার্থীরা।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন বিক্ষোভকারী বলছেন, ‘আমরা এটা নিশ্চিত করতে চাই যে, এই আন্দোলনটি সহিংস হবে না। আমাদের বিরুদ্ধে শক্তি খাটাতে আমরা পুলিশকে কোনও সুযোগ দিতে চাই না।’

শাফিক যোগ করছেন, ‘সরকারের কারণেই আমরা বিক্ষোভ করতে বাধ্য হয়েছি। যদি আমরা আতাদের নাগরিকত্ব প্রমাণ করতে ব্যর্থ হয়, হয় আমাদের আটক কেন্দ্রে পাঠানো হবে নাহলে দেশ থেকে বের করে দেয়া হবে। সুতরাং আমাদের অধিকার নিয়ে আন্দোলন করতে হলে এখনি করা উচিত।’

তার এই বক্তব্য আরো অনেকের, যারা আশঙ্কা করছেন যে, সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন তাদের নাগরিকত্বকেই ঝুঁকিতে ফেলতে পারে, যদি সেটা জাতীয় নাগরিকপঞ্জির সঙ্গে মিলিয়ে প্রয়োগ করতে শুরু করা হয়।

এর কারণ হলো, নাগরিকপঞ্জীতে বাসিন্দাদের নাগরিকত্বের প্রমাণ দিতে হয়। কিন্তু অমুসলমানদের কাগজপত্র না থাকলেও তারা অন্য দেশের ধর্মীয় সংখ্যালঘু হিসাবে নিজেদের দাবি করতে পারবেন। কিন্তু কাগজপত্র না থাকলে একজন মুসলমান সেই সুযোগ পাবেন না। ফলে তাকে আটক করা হতে পারে বা অন্য দেশে পাঠিয়ে দেয়া হতে পারে।

যদিও সরকার বলছে যে, এখনি দেশজুড়ে নাগরিকপঞ্জি তৈরির কোনও পরিকল্পনা তাদের নেই, কিন্তু বিক্ষোভ চলছে। অনেক নারী এই আন্দোলনে এতটাই নিবেদিত যে, তারা তাদের কাজকর্মও বাদ দিয়ে দিয়েছেন।

দিনমজুরির ভিত্তিতে কাজ করেন রিজওয়ানা বানি। তিনি বলছেন, এখানে দিন রাত থাকার কারণে তার আয় রোজগার হচ্ছে না, কিন্তু তিনি তারচেয়েও বেশি ভয় পাচ্ছেন আইনটি তার নিজের এবং পরিবারের কতটা ক্ষতি করতে পারে, সে জন্য।

‘আমরা জানি না কোথায় এবং কার কাছে ওসব কাগজপত্র পাওয়া যাবে, যা আমাদের নাগরিকত্ব প্রমাণ করতে পারবে। শুধু ধর্মের কারণে আমাদের আলাদা করে ফেলা হচ্ছে। আমরা তো আসলে প্রথমে ভারতীয়, তারপরে হিন্দু অথবা মুসলমান।’

এই বিক্ষোভে যোগ দিয়েছেন সব বয়সী নারী।

‘আমি কখনোই এই দেশে ছেড়ে যাবো না এবং একজন ভারতীয় হিসেবে নিজেকে প্রমাণ করতে করতে মারাও যেতে চাই না,’ বলছেন সত্তর বছর বয়সী আসমা খাতুন, যিনি কয়েকদিন ধরেই এই বিক্ষোভ স্থানে রয়েছেন।

‘এটা শুধু আমার একার কথা নয়- আমার পূর্বপুরুষ, আমার ছেলেমেয়ে, আমার নাতিনাতনি- সবাই ভারতীয়। কিন্তু আমরা সেটা কারো কাছে প্রমাণ করতে চাই না।’

বিক্ষোভকারীরা বলছেন, মুসলমানদের লক্ষ্যবস্তু করে এই আইনটিকে তারা দেখছেন, কিন্তু এটা আসলে সবার জন্যই হুমকি।

বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী হুমাইরা সায়েদ বলছেন, ‘আইনটি সংবিধানের লঙ্ঘন। এটার মাধ্যমে হয়ত এখন মুসলমানদের লক্ষ্যবস্তু করা হচ্ছে, কিন্তু আমরা নিশ্চিত, পর্যায়ক্রমে অন্য সম্প্রদায়ের মানুষদেরও লক্ষ্যবস্তু বানানো হবে।’

‘একজন মুসলমান হিসেবে আমি জানি, এখানে আমার ভাইবোন, অন্য সম্প্রদায়, অন্য সবার জন্য আমাকে থাকতে হবে।’

সূত্র: বিবিসি

একে//


Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি