ঢাকা, সোমবার   ২৫ নভেম্বর ২০২৪

যুক্তরাষ্ট্র-ইরান সংঘাতে কে জিতলেন?

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ১৯:৩৭, ১০ জানুয়ারি ২০২০

দীর্ঘদিন দিন ধরে পারমাণবিক চুক্তি নিয়ে তুমুল উত্তেজনার মুখে আমেরিকার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের ধোয়া তুলে গত ৩ জানুয়ারি (শুক্রবার) ইরাকের রাজধানী বাগদাদে হামলা চালিয়ে হত্যা করা হয় ইরানের এলিট ফোর্স হিসেবে পরিচিত বিপ্লবী গার্ড কর্পসের (আইআরজিসি) এলিট ইউনিট ফোর্সের সাবেক প্রধান জেনারেল কাশেম সোলাইমানিকে। 

এর মধ্যদিয়েই দুই দেশ নতুন করে যুদ্ধের মুখোমুখি হয়। উত্তেজনা বাড়ে মধ্যপ্রাচ্যে। সোলাইমানির হত্যার জবাবে গত বুধবার (৮ জানুয়ারি) সকালে ইরাকের মার্কিন ঘাঁটিতে হামলা চালায় তেহরান।

সেখানে ৮০ জন নিহতের দাবি করে ইরান। যদিও যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে হামলা কথা স্বীকার করা হলেও নিহতের ব্যাপারে অস্বীকার করে মার্কিন প্রেসিডেন্ট। তবে, হামলার ছবি প্রকাশ পায় আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে। এ নিয়ে চলছে চুল ছেরা বিশ্লেষণ।  

ফলে মধ্যপ্রাচ্যে উদ্বেগের পাশাপাশি বিশ্ববাজারে নেমে আসে অস্থিতিশীলতা। আশঙ্কা দেখা দেয় তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের। প্রথম দিকে না হলেও ইরানের হামলায় সে আশঙ্কাকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে কয়েকগুণ। 

তাহলে চলমান এ সংকটে জিতল কারা? আর হারলোই বা কারা? মার্কিন ঘাঁটিতে হামলার পর আন্তর্জাতিক রাজনীতির ভবিষ্যৎ আর এর সমাধানে কি হতে পারে সেদিকে তাকিয়ে আছে বিশ্ববাসী। 

ইরান
ইরান পারমাণবিক শক্তিধর যুক্তরাষ্ট্রকে আঙুল দেখিয়ে চলার মূল শক্তি জোগাতেন প্রয়াত প্রভাবশালী নেতা কাশেম সোলাইমানি। মধ্যপ্রাচ্যে ইরানের যে বলয় ও শক্তিমত্তা তার সবটারই দাবিদার এই নেতার। 

অনেকে মনে করেন, দেশটির সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লা আল খামেনির পরিবারের কেউ না হলেও বেশ ঘনিষ্ট ছিলেন তিনি। তার কাজের ব্যাপারে একমাত্র তাকেই জবাবদিহি করা ও পরামর্শ নিতেন খামেনির কাছ থেকে। 

বলা হয়ে থাকে খামেনির পর দেশটির সর্বোচ্চ নেতা হলেন সোলাইমানি। খামেনি তাকে সন্তানতুল্য হিসেবে দেখতেন। তার মৃত্যু দেশটির জন্য এক অপূরণীয় ক্ষতি। কিন্তু একইসঙ্গে কিছু দিক দিয়ে সুলেইমানির হত্যাকাণ্ডে ইরান সরকার অপ্রত্যাশিতভাবে লাভবান হয়েছে।

সম্প্রতি তেলের মূল্যবৃদ্ধির কারণে দেশটিতে বিক্ষোভ দেখা দেয়। রাস্তায় নেমে আসে জনসাধারণ। বার্তা সংস্থা রয়টার্সে তথ্যমতে, বিক্ষোভ দমাতে ১৫০০ ব্যক্তিকে হত্যা করেছে সরকার। যদিও এখন পর্যন্ত এ বিষয়ে কোনো সরকারি হিসাব প্রকাশ পায়নি। 

কিন্তু অনেকের ধারণা, প্রকৃত হতাহতের সংখ্যা আরো বেশি হতে পারে। এ ছাড়া, ট্রাম্প ২০১৮ সালে ইরানের সঙ্গে আন্তর্জাতিক চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে সরিয়ে নেয়। দেশটির উপর আরোপ করে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা। সেসব নিষেধাজ্ঞায় ইরানের অর্থনীতিতে ধস নেমেছে।

এমতাবস্থায় সুলেইমানির হত্যাকাণ্ড জনগণের মনযোগ সরকারের প্রতি অসন্তোষ থেকে অন্যদিকে সরে গেছে। তার জানাজা ও দাফনে মানুষের ঢল দেখেই তার আভাস পাওয়া যায়। জীবিত থেকে সুলেইমানি যা পারেননি, খুন হয়ে তা পেরেছেন। ইরানের রাজনৈতিক অভিজাতদের এক করে দিয়েছেন। 

চরম সংকটের মধ্যে দেশকে ঐক্যবদ্ধ করেছেন। তার হত্যার প্রতিশোধে সারাদেশ ঐক্যমতে পৌঁছেছে। ইরাকে মার্কিন ঘাঁটিতে হামলা তারই ফসল। কিন্তু এখন ভবিষ্যতে আরো সহিংস পদক্ষেপ নিলে ফের গ্যাঁড়াকলে পড়তে পারে ইরান সরকার। অন্যদিকে, ইরান ও ইরাকের সামরিক শক্তিতে সুলেইমানির প্রভাব ছিল অদ্বিতীয়। শিয়াদের মধ্যেও তার প্রভাব ছিল ব্যাপক। তার হত্যাকাণ্ডে সরকারের হালকা পদক্ষেপ জনগণের মধ্যে অসন্তোষ জন্ম দেয়ার আশঙ্কাও রয়েছে।   

যুক্তরাষ্ট্র
সুলেইমানির হত্যাকাণ্ডে সবচেয়ে বড় লাভবান হচ্ছে ট্রাম্প প্রশাসন। পূর্বে একাধিক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ইরানি জেনারেলকে হাতের মুঠোয় পেলেও হত্যা করেনি। কিন্তু ট্রাম্প দাবি করেছেন, সুলেইমানি ইরাকে মার্কিন দূতাবাসে হামলার পরিকল্পনা করছিলেন, তাই তাকে হত্যা করা হয়েছে। 

এতে ইরানের সামরিক শক্তি ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। একইভাবে আগামী নির্বাচনে ট্রাম্পের ফের জয়ী হওয়ার সম্ভাবনা বেড়েছে বহুগুণ। মধ্যপ্রাচ্যে সৌদি আরব ও ইসরাইলের মতো মিত্রদের কাছে মার্কিন সামরিক বাহিনীর প্রভাব ও ক্ষমতার একটি শক্তিশালী বার্তাও পাঠিয়েছে সুলেইমানি হত্যাকাণ্ড।

ইরানের পাল্টা হামলার পর ট্রাম্পও কিছুটা মিইয়ে গেছেন। প্রথম দিকে তীব্র হুমকি দিলেও পরে সহিংসতা না বাড়ানোর পথ বেছে নিয়েছেন। এমনকি, কোনো শর্ত ছাড়াই তেহরানের সঙ্গে আলোচনায় বসতে রাজি আছেন বলে জানান তিনি। 

এমতাবস্থায় এই পথ অবলম্বনই তার প্রশাসনের জন্য সবচেয়ে ভালো অবস্থান। ফের সহিংসতা বেছে নিলে তার পরিণতি ভিন্ন হতে পারে। ইতিমধ্যে উচ্চকক্ষে তার বিরুদ্ধে অভিশংসনের বিচারকার্য ঝুলে আছে। এছাড়া, সুলেইমানিকে হত্যার পেছনে এখনো সন্তুষ্টজনক বিস্তারিত তথ্য দেয়নি তার প্রশাসন। যেকোনো মুহূর্তে ব্যাপক এই জয়, বিধ্বংসী পরাজয়ে রূপ নিতে পারে।

ইরাক ও শিয়া মিলিশিয়া বাহিনী
সুলেইমানির হত্যাকাণ্ড ইরাকে শিয়া মিলিশিয়াদের জন্য বড় আঘাত। কিন্তু ভিন্ন দিক বিবেচনায়, এটা তাদের জন্য কিছুটা লাভজনকও। বিগত কয়েক মাস ধরে ইরাকে সরকার-বিরোধী বিক্ষোভ চলছে। বিক্ষোভ দমাতে কঠোর অবস্থান নিয়েছে সরকার। মোতায়েন করেছে শিয়া মিলিশিয়া বাহিনী। 

হতাহত হয়েছেন কয়েক হাজার বিক্ষোভকারী। দেশটিতে ইরানের প্রভাবের বিরুদ্ধে তীব্র অসন্তুষ্টি দেখা দিয়েছে। সুলেইমানির হত্যাকাণ্ড জনগণের মনে শিয়া মিলিশিয়াদের প্রতি ফের সহানুভ’তি জাগিয়ে তুলতে পারে। অন্যদিকে, সরকার-বিরোধী বিক্ষোভও স্তিমিত হয়ে পড়েছে। ফলে ইরাক সরকারের জন্যও এই ঘটনা লাভজনকই ধরা যায়।

ইসরাইল
ইরান ও ইসরাইলের শত্রুতা বহুদিনের। ইসরাইলের দৃষ্টিভঙ্গিতে ইরান তাদের ইহুদি রাষ্ট্রের জন্য হুমকি। একইসঙ্গে ইরান-সমর্থিত লেবাননের সশস্ত্র রাজনৈতিক দল হিজবুল্লাহ তাদের চিরশত্রু হিসেবে পরিচিত।

এদিকে, সুলেইমানির হত্যাকাণ্ড এটাও প্রমাণ করে যে, আমেরিকা ইরানকে দমিয়ে রাখতে ইচ্ছুক। ইসরাইল এটাকে ইতিবাচক হিসেবেই দেখবে। 

সৌদি ও আমিরাত
সুলেইমানির হত্যাকাণ্ড সংযুক্ত আরব আমিরাত ও সৌদি আরবের জন্য স্বস্তির ঘটনা। গত বছর ইরান নিয়ন্ত্রিত হরমুজ প্রণালীতে উভয় দেশের বাণিজ্যিক নৌযানই হামলার শিকার হয়। হামলা হয় সৌদির প্রধান তেল স্থাপনায়ও। 

ইরান অবশ্য এসব হামলার দায় অস্বীকার করেছে। কিন্তু সৌদির দাবি ইরান এসব হামলার সঙ্গে জড়িত। হামলার পরপর ইরানের সঙ্গে সম্পর্ক স্থিতিশীল করার চেষ্টা করেছে। কিন্তু সৌদি আরব কঠোর পদক্ষেপের দাবি জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে।

ইউরোপ
ইরানের সঙ্গে ট্রাম্প চুক্তিভঙ্গের পর থেকে সেটি রক্ষার চেষ্টা করে যাচ্ছে ইউরোপীয় শক্তিগুলো। কিন্তু এখন পর্যন্ত তেমন সফল হয়ে ওঠেনি তারা। সুলেইমানি হত্যাকাণ্ড তাদের জন্য দুঃসংবাদই বটে। ইরান জানিয়েছে, তারা এই হত্যাকাণ্ডের কঠোর জবাব দেবে। পারমাণবিক চুক্তির শর্ত মানবে না।

এদিকে, বৃটেন জানিয়েছে তারা সুলেইমানির বিরুদ্ধে মার্কি অভিযান সম্পর্কে আগ থেকে জানতো না। এতে দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনা বৃদ্ধি পাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। 

একইদিকে আইএস বিরোধী যুদ্ধের জন্য ইরাকে নিয়োজিত রয়েছে ন্যাটো সদস্যগুলোর সেনারা। ইরান-যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যকার উত্তেজনার মাঝে সেখান থেকে সেনা প্রত্যাহার করে নিয়েছে একাধিক দেশ। এতে আইএস নতুন করে মাথাচাড়া দিয়ে উঠার সুযোগ পেতে পারে।

এদিকে ইরানের সীমান্তবর্তী আফগানিস্তানের হেরাত প্রদেশে মার্কিন ড্রোন হামলায় ৬০ জন নিহত হয়েছে। তালেবানের এক শীর্ষ কমান্ডারকে লক্ষ্য করে ওই হামলা চালানো হয় বলে দাবি করা হয়েছে। তবে হামলায় নিহতরা সবাই আফগান বেসামরিক নাগরিক।

আফগান প্রশাসনের মতে, ‘মার্কিন ড্রোন ব্যবহার করে ওই বিমান হামলা চালানো হয়।’

ফলে, সবকিছু বিশ্লেষণ করে বলা যায় মধ্যপ্রাচ্যে এই মুহূর্তে যুদ্ধের দামা শুরু পূর্ণাঙ্গ রুপ পেলে তা হবে যুক্তরাষ্ট্র-ইরানের জন্য ভয়াবহ। যার ফল ভোগ করতে হবে পার্শ্ববর্তী দেশগুলোকে। 

এআই/এসি
 


Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি