ব্রেক্সিট কার্যকর, তবে শেষ নয় এখানেই
প্রকাশিত : ১৩:৫৪, ১ ফেব্রুয়ারি ২০২০
ব্রেক্সিট কার্যকরের মুহূর্তে লন্ডনের পার্লামেন্ট স্কয়ারে উৎসবে মেতে ওঠে এর সমর্থকরা
দীর্ঘ ৪৭ বছর সদস্য থাকার পর অবশেষে আনুষ্ঠানিকভাবে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ছেড়ে বের হয়ে গেল যুক্তরাজ্য। তিন বছর আগে এক গণভোটে ব্রিটিশ জনগণের দেয়া রায় অনুযায়ী স্থানীয় সময় শুক্রবার রাত ১১টায় (বাংলাদেশ সময় শনিবার ভোর পাঁচটায়) কার্যকর হয়েছে বহুল আলোচিত ব্রেক্সিট।
তবে, ব্রেক্সিট গল্পের এখানেই শেষ নয়। কারণ, ব্রেক্সিট পুরোপুরি কার্যকরে ১১ মাস ট্রানজিশন পিরিয়ড বা পরিবর্তনকাল হাতে নিয়েছে যুক্তরাজ্য। অর্থাৎ এই ১১ মাস যুক্তরাজ্যকে ইইউ’র নিয়ম-নীতি মেনেই চলতে হবে, সে সুবাদে আঞ্চলিক এ জোটটির সুযোগ-সুবিধাও ভোগ করবে যুক্তরাজ্যের নাগরিকরা।
এদিকে, ব্রেক্সিট মুহূর্তে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে গোটা যুক্তরাজ্য জুড়ে। বিবিসি জানিয়েছে, ঐতিহাসিক এই মুহূর্তটিতে যুক্তরাজ্যে যেমন উৎসব হয়েছে তেমনি এর প্রতিবাদে বিক্ষোভও হয়েছে। প্রায় ৩ হাজার কোটি ব্রিটিশ পাউন্ড ব্যয়ে চূড়ান্ত হয়েছে ইইউ প্রত্যাহার চুক্তি।
স্থানীয় সময় বুধবার (৩০ জানুয়ারি) ইউরোপীয়ান পার্লামেন্টে ৬২১-৪৯ ভোটে আনুষ্ঠানিকভাবে পাস হয় চুক্তিটি। ওই চুক্তি অনুযায়ী, শুক্রবার ২৮ সদস্যের অর্থনৈতিক জোটটি থেকে বের হয়ে গেল যুক্তরাজ্য।
ব্রেক্সিট কার্যকরের মুহূর্তে লন্ডনের পার্লামেন্ট স্কয়ারে উৎসবে মেতে ওঠে এর সমর্থকরা। অন্যদিকে, ব্রেক্সিটের প্রতিবাদে মোমবাতি মিছিল করেছে ইইউতে থেকে যাওয়ার পক্ষে ভোট দেয়া স্কটল্যান্ডের বাসিন্দারা।
এদিকে, ব্রেক্সিট কার্যকরের ঘণ্টাখানেক আগে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এক পোস্টে দেশকে ঐক্যবদ্ধ করে সামনে এগিয়ে নেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন। তিনি বলেন, ‘বহু মানুষের কাছেই এটি বিস্ময়কর প্রত্যাশার মুহূর্ত, তাদের আশঙ্কা ছিল হয়তো এটি কখনওই আসবে না’।
ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বলেন, গত ৫০ বছর ধরে ইইউ তার সর্ব শক্তি এবং প্রশংসনীয় গুণ নিয়ে যে পথে অগ্রসর হয়েছে তা এখন আর এই দেশের জন্য কার্যকর নয়। তিনি বলেন, ‘আজ রাতে এটা বলাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে, এটা কোনও কিছুর শেষ নয় বরং শুরু’।
অর্থাৎ যুক্তরাজ্যে এখন সবচেয়ে বেশি আলোচনা ট্রানজিশন পিরিয়ড বা পরিবর্তনকাল নিয়ে। পরিবর্তনকাল আসলে কী? কেন দরকার? এ নিয়ে সম্যক ধারণা দিয়েছে যুক্তরাজ্যের সংবাদমাধ্যম বিবিসি।
ট্রানজিশন পিরিয়ড
ব্রেক্সিট প্রক্রিয়ায় ট্রানজিশন পিরিয়ড হলো- ব্রেক্সিট পদক্ষেপ বাস্তবায়নের সময়কাল। এর মেয়াদ আগামী ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত। অর্থাৎ হাতে মাত্র ১১ মাস। এই সময়ে যুক্তরাজ্য থাকতে পারবে ইইউ’র কাস্টম ইউনিয়নেও (ইইউ’র প্রধানতম অংশ), থাকতে পারবে একক বাজারেও।
কাস্টম ইউনিয়নে থাকার অর্থ- ট্রানজিশন পিরিয়ড শেষ হওয়ার আগ পর্যন্ত বেশিরভাগ কার্যক্রমই চলবে আগের মতো, যেমন:
** ইইউভুক্ত দেশে যুক্তরাজ্যের নাগরিকদের গমনাগমন (ড্রাইভিং লাইসেন্স ও পেট পাসপোর্ট বিষয়ে নিয়ম-নীতি মেনে),
** অবাধে চলাচলের স্বাধীনতা (ইইউভুক্ত দেশে কাজ ও বাসের সুবিধাসহ),
** ইইউভুক্ত অন্য দেশগুলোর সঙ্গে যুক্তরাজ্যের বাণিজ্য (যা চলবে কোনও ধরনের বাড়তি কর বা নিরীক্ষা ছাড়াই)।
তবে, যুক্তরাজ্য স্বাভাবিকভাবেই ইউরোপিয় পার্লামেন্ট ও ইউরোপিয় কমিশনের মতো ইইউ’র রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে বাদ পড়ে যাবে। সদস্যপদ না থাকলেও যুক্তরাজ্যকে এই সময়ে ইউরোপিয় ইউনিয়নের আইন-কানুন মেনে চলতে হবে এবং যে কোনও আইনি বিষয়ে ইউরোপিয় বিচার আদালত যা বলবে, তা-ই শেষ কথা হবে।
এছারাও, ট্রানজিশন পিরিয়ড চলা পর্যন্ত ইইউ’র বাজেটে নির্ধারিত অর্থও যোগান দিতে হবে যুক্তরাজ্যকে।
ট্রানজিশন পিরিয়ড কেন জরুরি?
ট্রানজিশন পিরিয়ড এজন্য রাখা হয়েছে, যেন ইইউ ছাড়ার প্রশ্নে এই জোটের সঙ্গে যুক্তরাজ্যের নতুন সমঝোতার সুযোগ তৈরি হয়। আসলে দু’পক্ষের ভবিষ্যৎ সম্পর্ক কেমন হবে তা এই সমঝোতা সংলাপে ঠিক হবে বলেই আশা করা হচ্ছে।
যুক্তরাজ্য-ইইউ দু’পক্ষই ২৭ পৃষ্ঠার রাজনৈতিক ঘোষণায় তাদের ‘বড় লক্ষ্য’র কথা জানিয়েছে। পর্যবেক্ষকদের মতে, এই ‘বড় লক্ষ্য’ উভয় পক্ষেরই উদার দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশের ইঙ্গিত।
ট্রানজিশন পিরিয়ডে যা জরুরি
ব্রেক্সিটের ট্রানজিশন পিরিয়ডে ‘করণীয়’ তালিকায় শীর্ষে থাকবে যুক্তরাজ্য-ইইউ মুক্তবাণিজ্য চুক্তি। ট্রানজিশন পিরিয়ড পেরিয়ে যাওয়ার পর ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে যুক্তরাজ্য যদি কোনও ধরণের শুল্ক বা এ জাতীয় বাধা ছাড়া ব্যবসা-বাণিজ্য করতে চায়, তবে এই চুক্তিটি অপরিহার্য। যদিও মুক্তবাণিজ্য চুক্তি হলেই যুক্তরাজ্য ও ইইউ’র মধ্যকার ব্যবসা-বাণিজ্যে সব ধরণের যাচাই প্রক্রিয়াই উঠে যাবে না।
এক হিসাবে দেখা যায়, ২০১৮ সালে যুক্তরাজ্যের বাণিজ্য-আয় (পণ্য ও সেবা) ছিল ১ লাখ ৩০ হাজার কোটি পাউন্ড (১ পাউন্ড= ১.৩২ ডলার)। এর মধ্যে ইইউ থেকেই এসেছে ৪৯ শতাংশ।
আরও যেসব বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে
ট্রানজিশন পিরিয়ডে ইইউ’র সঙ্গে বাণিজ্যচুক্তি সংক্রান্ত আলোচনার পাশাপাশি যুক্তরাজ্য এ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র-অস্ট্রেলিয়ার মতো দেশগুলোর সঙ্গেও আলোচনা চালিয়ে যেতে পারবে।
তবে বাণিজ্য সংক্রান্ত বিষয়াদির পাশাপাশি ইইউ’র সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে আরও কিছু বিষয়ে যুক্তরাজ্যকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। যেমন- আইন প্রয়োগ, তথ্য বিনিময় ও নিরাপত্তা সংক্রান্ত বিষয়াদি; বিমান চলাচলের মান ও নিরাপত্তা; মৎস্য আহরণ, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সরবরাহ, ওষুধ সামগ্রীর লাইসেন্সসহ নিয়ম-নীতি ইত্যাদি।
এছাড়া এতোদিন ধরে ইউরোপীয় ইউনিয়নের আইনে অভিবাসন সংক্রান্ত বিষয়াদি পরিচালিত হলেও ভবিষ্যতে তা কীভাবে চলবে, সে বিষয়েও যুক্তরাজ্যকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
ট্রানজিশন পিরিয়ডের পর যুক্তরাজ্যে যেসব বিষয়ে পরিবর্তন আসবে তা তুলে ধরা হলো-
ইউরোপিয় পার্লামেন্টের সদস্যপদ হারানো
ইউরোপিয় পার্লামেন্টে যুক্তরাজ্য থেকে সদস্য ছিলেন ৭৩ জন। কিন্তু ট্রানজিশন পিরিয়ডেই তারা সদস্যপদ হারাবেন প্রভাবশালী এ জোটগত সংসদের।
ইইউ সামিটে আর নয়
ভবিষ্যতে যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী বিশেষ আমন্ত্রণ ছাড়া ইউরোপিয় ইউনিয়ন কাউন্সিল সামিটে অংশ নিতে পারবেন না। যুক্তরাজ্যের কোনও মন্ত্রীও এখন থেকে আর ইউরোপীয় ইউনিয়নের নিয়মিত বৈঠকে অংশ নিতে পারবেন না।
বাণিজ্যে উন্মুক্ত ‘বিশ্বদ্বার’
যুক্তরাজ্য ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য থাকার সময় যুক্তরাষ্ট্র বা অস্ট্রেলিয়ার মতো দেশগুলোর সঙ্গে আনুষ্ঠানিক বাণিজ্য আলোচনা করতে পারতো না। ট্রানজিশন পিরিয়ডেই যুক্তরাজ্য তাদের পণ্য ও সেবা বিক্রির জন্য নতুন নিয়ম ঠিক করতে বিশ্বের যে কোনও দেশের সঙ্গেই আলোচনা শুরু করতে পারবে।
পাসপোর্টের রঙ পরিবর্তন হবে
ব্রেক্সিট কার্যকরের মাধ্যমে ৩০ বছর পর পুরনো নকশার পাসপোর্টে ফিরে আসবে যুক্তরাজ্য। ঐতিহ্যবাহী নীল ও সোনালী রঙের নকশার এ পাসপোর্ট প্রথম ব্যবহার শুরু হয়েছিল ১৯২১ সালে। তবে বর্তমান যে পাসপোর্ট রয়েছে বৈধ থাকবে তাও।
ব্রেক্সিট কয়েন
ট্রানজিশন পিরিয়ডে প্রায় ৩০ লাখ বিশেষ কয়েন ছাড়া হবে, যেখানে লেখা থাকবে ‘পিস, প্রোসপারিটি অ্যান্ড ফ্রেন্ডশিপ উইথ অল নেশনস’ (সব দেশের সঙ্গে শান্তি, সমৃদ্ধি ও বন্ধুত্বের সম্পর্ক)।
জার্মানি কাউকে যুক্তরাজ্যে প্রত্যার্পণে বাধ্য থাকবে না
আগে সন্দেহভাজন অপরাধী কেউ যুক্তরাজ্য থেকে পালিয়ে গিয়ে জার্মানিতে আশ্রয় নিলে তাকে ফেরত পাঠাতে বাধ্য থাকতো জার্মানি। তবে ব্রেক্সিট কার্যকরের পর দেশটি আশ্রয়প্রার্থী কাউকে ফেরত পাঠাতে বাধ্য থাকবে না। কারণ, সে দেশের সংবিধান অনুযায়ী ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশ ছাড়া অন্য কোনও দেশের নাগরিককে প্রত্যার্পণের সুযোগ নেই।
এনএস/
আরও পড়ুন