ঢাকা, সোমবার   ২৫ নভেম্বর ২০২৪

দিল্লিতে সহিংসতা, দায় কার?

মুহাম্মাদ শফিউল্লাহ

প্রকাশিত : ১৬:২৪, ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২০ | আপডেট: ১৬:৫৪, ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২০

দিল্লির সহিংসতায় নিহত মুদাচ্ছের খানের মৃতদেহের পাশে কান্না করছে তার ছেলে- সিবিএস নিউজ

দিল্লির সহিংসতায় নিহত মুদাচ্ছের খানের মৃতদেহের পাশে কান্না করছে তার ছেলে- সিবিএস নিউজ

ভারতে বিতর্কিত নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনকে (সিএএ) কেন্দ্র করে ছড়িয়ে পড়া সহিংসতায় মৃতের সংখ্যা বেড়ে ৪২ এ দাঁড়িয়েছে। আহত হয়েছেন অন্তত তিন শতাধিক। 

চলমান এ সহিংসতার ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছে জাতিসংঘ। এছাড়া এ সহিংসতার তীব্র নিন্দা জানিয়েছে ইসলামিক সহযোগিতা সংস্থা (ওআইসি)। সবশেষ ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির আহ্বানেও থামেনি এ সহিংসতা। 

উত্তর-পূর্ব দিল্লির সহিংসতা কবলিত এলাকা থেকে একের পর এক লাশ বেরিয়ে আসছে। পেট্রোলবোমা ছোঁড়া, গাড়িতে আগুন দিয়ে তান্ডবের পাশাপাশি এবার এসিড হামলার পথে নেমেছে বিক্ষোভকারীরা। মুস্তাফাবাদের বিভিন্ন স্থানে এসিডে অনেকের চোখ-মুখ, গোটা শরীর ঝলসে দেয়ার খবর মিলেছে। 

এর আগে সহিংসতার ঘটনায় দুইটি তদন্ত কমিটি করে ক্রাইম স্পেশালকে (অবরাধ বিভাগ) দায়িত্ব দিয়েছে দিল্লি পুলিশ। দিল্লি মূখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়াল মৃতদের ক্ষতিপূরণের পাশাপাশি আহতদের বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবা দেওয়া হচ্ছে। 

এদিকে দিল্লির সহিংসতার ঘটনা গুরুত্বের সঙ্গে প্রচার করছে দেশটির গণমাধ্যম। গণমাধ্যমগুলো এ ঘটনাকে কয়েকদিন ধরে প্রধান খবরে রেখেছে। 

সহিংসতা বেড়েই চলেছে- টাইমস অব ইন্ডিয়া

বাড়ছে লাশের সারি, বিচারপতিকে বদলি: 

দিল্লিতে সহিংসতায় লাশের মিছিল বড় হচ্ছে। উত্তর-পূর্ব দিল্লির দাঙ্গাকবলিত এলাকা থেকে একের পর এক লাশ বেরিয়ে আসছে। বৃহস্পতিবার পর্যন্ত চার দিনে ৪২ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। এছাড়া হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অনেকের অবস্থা আশঙ্কাজনক।

রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে উত্তর-পূর্ব দিল্লির ভজনপুরা, মৌজপুর, কারাওয়ালনগর, মুস্তাফাবাদসহ কয়েকটি এলাকা বিধ্বস্ত জনপদে পরিণত হয়েছে। মুস্তাফাবাদে নাগরিকত্ব সংশোধন আইন (সিএএ) বিরোধীদের ওপর এসিড হামলা করা হয়েছে। এতে চারজন দৃষ্টিশক্তি হারিয়েছেন।

বিচারপতি এস মুরলিধর- সংগৃহীত

দিল্লিতে সহিংসতার প্রতিবাদে তেলেঙ্গা রাজ্যসহ ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে বৃহস্পতিবার বিক্ষোভ হয়েছে। তবে পুলিশ বিক্ষোভকারীদের রাস্তায় দাঁড়াতে দেয়নি। খবর বিবিসি, রয়টার্স, আনন্দবাজার ও এনডিটিভির।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ভারত সফর চলাকালে দিল্লিতে সিএএ সমর্থক ও বিরোধীদের পাল্টাপাল্টি মিছিল থেকে সংঘর্ষ শুরু হয়।

অন্যদিকে সাম্প্রদায়িক সহিংসতার জন্য সরকার ও দিল্লি পুলিশের সমালোচনা করা সেই বিচারপতিকে মধ্য রাতেই বদলি করে দিল কেন্দ্রীয় সরকার। দিল্লি পরিস্থিতি নিয়ে সরকারের সমালোচনা করা ওই বিচারপতির নাম এস মুরলিধর। দিল্লি হাইকোর্ট থেকে তাকে পাঞ্জাব ও হরিয়ানা হাইকোর্টে বদলির বিজ্ঞপ্তি বুধবার রাতে ইস্যু করে কেন্দ্রীয় সরকার। 

বুধবার বিচারপতি মুরলিধর বলেছিলেন, ‘আমরা আরেকটা ১৯৮৪-র মতো ঘটনা হতে দিতে পারি না দেশে।’ এ সহিংসতা নিরসনে কেন্দ্রীয় সরকার ও দিল্লি সরকার উভয়কেই একসঙ্গে কাজ করতে নির্দেশ দেন তিনি।

চার বিজেপি নেতা কপিল মিশ্র, অনুরাগ ঠাকুর, অভয় ভার্মা ও পরবেশ ভার্মার উস্কানিমূলক ভাষণের ভিডিওকে কেন্দ্র করে দায়ের হওয়া পিটিশনের শুনানিতে বিচারপতি মুরলিধর এ নির্দেশ দিয়েছিলেন। কেন ওই চার বিজেপি নেতার বিরুদ্ধে এফআইআর দায়ের করা হয়নি জানতে চেয়ে দিল্লির পুলিশ প্রধানকে প্রশ্ন করেছিলেন বিচারপতি মুরলিধর।

জবাবে কেন্দ্রের পক্ষে সলিসিটর জেনারেল তুষার মেহতা সঠিক সময়েই এফআইআর দায়ের হবে জানালে বিচারপতি পাল্টা প্রশ্ন করেছিলেন, ‘কোনটা সঠিক সময়, মিস্টার মেহতা? দিল্লি তো জ্বলছে।’ এরপর এফআইআর দায়ের না করার পরিণতি কঠোর হতে পারে বলেও সতর্কবার্তা দেন মুরলিধর।

সিএএ বিরোধীদের ওপর এর পক্ষের লোকেরা চড়াও হয়ে লুটপাট, ভাঙচুর এমনটি মসজিদে অগ্নিসংযোগকালেও দিল্লি পুলিশের নিষ্ক্রিয়তার অভিযোগ উঠেছে। দিল্লিতে সাম্প্রদায়িক সহিংসতায় পুলিশ ও বিজেপি সরকারের এই নীরবতাকে বড় লজ্জাজনক বলে মন্তব্য করেছেন কংগ্রেস নেত্রী প্রিয়াংকা গান্ধী।

পুলিশের ভূমিকা কী ছিল?:

দাঙ্গা চলার সময় গত সোম ও মঙ্গলবার পুলিশের সাহায্য চেয়ে প্রতি মিনিটে চারটি করে কল করা হয়েছে। এ তথ্য জানিয়েছে দিল্লি পুলিশের কন্ট্রোল রুম। গতকাল বৃহস্পতিবার এ-সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে হিন্দুস্তান টাইমস।

পুলিশের ভূমিকা ছিল বিতর্কিত- ইকোনমিক টাইমস

পুলিশ কন্ট্রোল রুমের তথ্য অনুযায়ী, দাঙ্গা কবলিত উত্তর-পূর্ব দিল্লি থেকে সোমবার প্রায় সাড়ে তিন হাজার জরুরি ফোনকল এসেছে। পরদিন মঙ্গলবার এ সংখ্যা পৌঁছায় সাড়ে সাত হাজারে। আগুন, ঘরবাড়ি ভাঙচুর, মারধরের খবর জানিয়ে দিল্লি পুলিশের কাছে সাহায্য চাওয়া হয়েছে এসব টেলিফোনের কলের মাধ্যমে।

পুলিশের এক শীর্ষ কর্মকর্তা জানিয়েছেন, ওই দু’দিনে প্রতি ঘণ্টায় ২২৫টি ফোন এসেছে। অর্থাৎ প্রতি মিনিটে চারটি। তবে দাঙ্গা থামানোর বিষয়ে পুলিশের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। ভিডিও ও ছবিতে দেখা গেছে, হামলার সময় বিজেপি নেতাকর্মীদের থামানোর কোনো চেষ্টা করেনি পুলিশ।

দিল্লি মসজিদে আগুন দিয়েছে কারা?:

দিল্লিতে কমপক্ষে তিনটি মসজিদে অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে। অপরদিকে বহু বাড়ি-ঘর এবং দোকান-পাটেও হামলা ও আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়েছে। দিল্লির সহিংসতায় দুর্বৃত্তদের সহযোগিতার অভিযোগ উঠেছে পুলিশের বিরুদ্ধে। 

প্রত্যক্ষদর্শীদের বরাত দিয়ে ওয়াশিংটন পোস্টের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সহিংসতা বন্ধের চেষ্টা না করে উন্মত্ত জনতার সঙ্গে যোগ দিয়ে জয় শ্রী রাম বলে স্লোগান দিচ্ছিল পুলিশ। একই সঙ্গে এলোপাতাড়ি গুলি চালিয়েছে তারা।

ওয়াশিংটন পোস্টের প্রতিবেদনের অংশ।

ফারুকিয়া নামের একটি ছোট মসজিদের দেখাশুনা করেন মোহাম্মদ আব্বাস (৮৫)। তিনি জানিয়েছেন, মঙ্গলবার বিকালে নামাজের পর একদল পুলিশ কর্মকর্তা মসজিদের ইমাম এবং তার ওপর হামলা চালায়। 

তিনি বলেন, ‘পুলিশ সদস্যরা তাকে দেশদ্রোহী বলে গালাগালি দিচ্ছিল।’ তার চোখের সামনেই ওই পুলিশ সদস্যরা মসজিদ ভাংচুর করেছেন এবং আগুন ধরিয়ে দিয়েছেন বলে উল্লেখ করেন তিনি। এরপরেই সেখান থেকে মোহাম্মদ আব্বাসকে একটি হাসপাতালে নেয়া হয়। সে সময় তার সারা শরীর রক্তাক্ত ছিল।

জাতিসংঘের উদ্বেগ:

স্থানীয় সময় বৃহস্পতিবার এক সংবাদ সম্মেলনে উদ্বেগ প্রকাশ করেন জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্তিনিও গুতেরেস। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ভারত সফরের আগের দিন রোববার থেকে শুরু হওয়া এ সহিংসতায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে জাতিসংঘ। দ্রুত শান্তি ফিরিয়ে আনার আহ্বান জানিয়েছেন এন্তোনিও।

ক্ষতিগ্রস্তদের অনুদানের ঘোষণা কেজরিওয়ালের:

দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়াল ঘোষণা দেন, নিহতদের প্রতি পরিবারকে ১০ লাখ টাকা করে দেওয়া হবে দিল্লি সরকারের পক্ষ থেকে। যারা নাবালক সন্তানদের হারিয়েছেন, তারা পাবেন পাঁচ লাখ টাকা। যাদের ঘরবাড়ি সম্পূর্ণ ভেঙে গিয়েছে তাঁদের পাঁচ লাখ টাকা দেওয়া হবে। এবং আহতরা রাজ্যের যে কোনও সরকারি হাসপাতালে বিনামূল্যে চিকিৎসার সুযোগ পাবেন।

দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়াল- সংগৃহীত

এছাড়া যাদের দোকান পুড়ে গিয়েছে তাদের দেওয়া হবে পাঁচ লাখ টাকা। ক্ষতিগ্রস্ত রিকশাচালকদের হাতে দেওয়া হবে ২৫ হাজার ও ই-রিকশাচালকরা পাবে ৫০ হাজার টাকা। যাদের গৃহপালিত পশুদের হারিয়েছে,তাঁরা পশুপিছু পাঁচ হাজার টাকা করে পাবেন। এবং যেসকল শিশু বা কিশোর-কিশোরীরা হামলার ফলে পরিবারের সকলকে হারিয়েছে, তারা পাবে ৩ লাখ  টাকা। 

হামলাকারীদের উদ্দ্যেশ্যে তিনি বলেন, ‘এই ঘটনায় যারা জড়িত প্রমাণিত হবে, তাদের কঠোর শাস্তি দেওয়া হবে। আর আম আদমি পার্টির কোনও সদস্য যদিও এতে জড়িত থাকে, তাহলে তার শাস্তি অন্যদের থেকে দ্বিগুণ করা হবে। জাতীয় নিরাপত্তার সঙ্গে কোনভাবে আপস করা হবে না।’

মোদির আহ্বানেও শান্ত হয়নি দিল্লি:

সহিংসতার চতুর্থ দিনে বুধবার শান্তি ও সৌভ্রাতৃত্ব বজায় রাখার অনুরোধ জানিয়ে জনগণের উদ্দেশে টুইট করেন নরেন্দ্র মোদী। টুইট বার্তায় তিনি লেখেন, ‘আমার ভাই ও বোনেদের দিল্লিতে শান্তি ও সৌভ্রাতৃত্ব বজায়ের আবেদন জানাচ্ছি। শান্তি ও সম্প্রীতি আমাদের দেশের কেন্দ্রীয় আবেগ।  দিল্লিতে শান্তি ও স্থিতাবস্থা ফিরিয়ে আনা এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।’

সহিংসতায় দিল্লি পুলিশের পেশাদারিত্বের অভাব নিয়ে ভারতের সুপ্রিমকোর্ট এবং দিল্লি উচ্চ আদালতের হতাশা প্রকাশের কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই এই টুইট করেন মোদি। মোদির আহ্বানের পরও বৃহস্পতিবার হামলা থামেনি। উত্তর-পূর্ব দিল্লির অবস্থা আগের মতোই ছিল। 

ভারতীয় সম্প্রচারমাধ্যম এনডিটিভি জানিয়েছে, কয়েকটি এলাকায় ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছে। দিল্লির জাফরাবাদ, মৌজপুর, চাঁদবাগ ও কারাবাল এলাকায় বিক্ষোভকারীদের দেখামাত্র গুলির নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়াও সহিংসতার কারণে গাজিয়াবাদে জেলা প্রশাসন উত্তর পূর্ব দিল্লি সংলগ্ন তিনটি সীমানা বন্ধ করে দিয়েছে।

এমএস/


Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি