‘হে পরবাসী বাঙালি সমালোচকগণ, যেখানে থাকেন তার কী হাল?’
প্রকাশিত : ২০:১৭, ২৫ এপ্রিল ২০২০
মহুয়া মৈত্র ভারতের লোকসভার একজন সদস্য। সম্প্রতি বাংলাকে নিয়ে একদল লোক বিদেশে থেকে এখানকার চিকিৎসা ব্যবস্থা নিয়ে বিষোদগার করেছেন। এ নিয়ে তারা একটি চিঠি লিখেছেন। তার এভাবেই উত্তর দেন মহুয়া-
চিঠির প্রতিলিপিটা দেখার পর থেকে বার বার সেই প্রবাদটার কথা মনে পড়ে যাচ্ছে- নিজের চরকায় তেল দেওয়া। নিজের চরকা যখন ঠিকঠাক চলে না, তখন অন্যেরটায় তেল দিতে যাওয়ার তো কোনও মানে বুঝি না!
খোলা চিঠিটা বেশ বড়। লেখা হয়েছে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে। লিখেছেন ১৪ জন প্রবাসী বাঙালি। করোনা মোকাবিলায় পশ্চিমবঙ্গ সরকারের ভূমিকার কথা উল্লেখ করে সেখানে অনেক কথাই লেখা হয়েছে। চিঠি থেকেই জেনেছি, পত্রলেখকদের ১১ জন আমেরিকা, ২ জন ইংল্যান্ড এবং এক জন জার্মানিতে থাকেন। ওঁদের কেউ চিকিৎসক। কেউ স্বাস্থ্য বিজ্ঞানী। কেউ বা স্বাস্থ্য পরিষেবা সংক্রান্ত কাজের সঙ্গে যুক্ত। তবে প্রতেক্যেরই জন্ম, বেড়ে ওঠা এবং পড়াশোনা এ রাজ্যে। এমনকি তাঁদের কারও কারও পরিবারের লোকজন এ রাজ্যে থাকেন।
গত ২২ এপ্রিল মুখ্যমন্ত্রীকে পাঠানো ওই ১৪ জন একটি চিঠিতে লিখেছেন- এ রাজ্যে করোনা-পরীক্ষা ভীষণ কম হচ্ছে। এবং ভুল তথ্য দেওয়া হচ্ছে করোনা আক্রান্তদের মৃত্যু নিয়ে। এর সঙ্গে রাজ্যের স্বাস্থ্য পরিষেবা নিয়ে আরও অনেক কিছুই তাঁরা লিখেছেন। রাজ্যের এ সব ‘তথ্য’ তাঁরা কী করে জেনেছেন? মূলত সোশ্যাল মিডিয়া, ব্যক্তিগত যোগাযোগের সূত্র এবং দেশ-বিদেশের বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম থেকে ওঁরা জেনেছেন বলে লেখা হয়েছে চিঠিতে।
আমি এই বিষয়ে দুটো টুইট করেছি। সে প্রসঙ্গে পরে আসছি। তার আগে বলে নেওয়া যাক, আমার জীবনের অধিকাংশ সময়ই কেটেছে বিদেশে। তার পর বিশেষ একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে দেশে ফিরে আসা। সকলেই যে তেমনটা করবেন বা পারবেন বা করা উচিত— এটা আমি কোনও ভাবেই মনে করি না। কারণ, এটা যাঁর যাঁর নিজস্ব পছন্দ এবং সিদ্ধান্তের ব্যাপার। কে কোন দেশে থাকবেন, কী কাজ করবেন- সে সব তো তাঁর একেবারেই ব্যক্তিগত। কিন্তু বিদেশে বসে দেশের সমালোচনা করলে সেটা আর ব্যক্তিগত থাকে না। আমাকে এটাও অবাক করেছে, সোশ্যাল মিডিয়া এবং ব্যক্তিগত যোগাযোগের সূত্রে এত কিছু ওঁরা জেনে গেলেন যে, সূত্র হিসেবে প্রচলিত সংবাদমাধ্যমকে একেবারে শেষ তালিকায় রাখলেন! কিন্তু সঠিক তথ্য জেনে সমালোচনা করলেন তো? একেবারে গ্রাউন্ড জিরোতে পৌঁছে যাঁরা কাজ করছেন, নিজের জীবন বিপন্ন করে যাঁরা কাজ করছেন তাঁদের অসম্মান করে ফেললেন না তো! আমি তো বিদেশে থাকার সময় কখনও নিজের দেশের সমালোচনার কথা ভাবতেই পারিনি।
আমি যে এলাকার সাংসদ, সেই নদিয়ায় কিন্তু চিকিৎসক থেকে নার্স, স্বাস্থকর্মী থেকে আশাকর্মী— সকলে একেবারে সামনের সারিতে থেকে যুদ্ধটা লড়ছেন। কোথাও এক চুল ফাঁক নেই। ছেড়ে দিন, নদিয়ার কথা— গোটা রাজ্যই আজ এই করোনা-যুদ্ধে যে ভাবে লড়ছে, বিদেশে থেকে তার আঁচ পাওয়া সম্ভব নয়। সমালোচনা করার আগে একটু ভাবুন!
ওই ১৪ জন যেখানে থাকেন, যে দেশগুলোকে তাঁরা স্বেচ্ছায় সাদরে গ্রহণ করে নিয়েছেন, সেখানকার দিকে তাকিয়েছেন ওঁরা? খবর নিয়েছেন? আমি তো আমেরিকার মতো করোনা পরিস্থিতি এত খারাপ ভাবে সামলাতে আর কোনও দেশকে দেখিনি। লকডাউন থেকে শুরু করে হাসপাতালের পরিষেবা— কী অবস্থা! স্বাস্থকর্মীরা পিপিই পাচ্ছেন না। ভেন্টিলেটর পাচ্ছেন না। চূড়ান্ত অব্যবস্থা। আর ইংল্যান্ড? তারাও তো তথৈবচ। একটা দেশের প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত করোনা আক্রান্ত! ভেবে দেখেছেন, কতটা অসচেতন হলে এটা হয়। পরে তো স্বীকারও করেছেন, তাঁর দেশে টেস্ট কম হয়েছে। অনেক কম হয়েছে। উন্নত দেশ। আমাদের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশ নয়। স্বাস্থ্য পরিকাঠামোয় একেবারে এক নম্বর। তার পরেও সেখানকার চিকিৎসা পরিকাঠামো কিন্তু করোনা মোকাবিলায় ব্যর্থ।
যাঁরা এ রাজ্যের পরিস্থিতি দেখে চিঠি পাঠালেন, তাঁরা কিন্তু ওই রকম একটা পরিস্থিতির মধ্যেই কাজ করছেন। তখন কিন্তু কোনও সমালোচনা করছেন না। অথচ এ রাজ্যে ‘এত খারাপ’ কাজ হচ্ছে বলে চিঠি লিখে ফেললেন। আরে পশ্চিমবঙ্গের কথা ছেড়েই দিলাম। গোটা ভারতের দিকে তাকান। কী ভাল কাজ করছে। আমাদের স্বাস্থ্য পরিকাঠামো ওই সব দেশের মতো নয়। জনসংখ্যাও বিপুল। সেই পরিস্থিতিতে আমরা কী করছি? গোটা বিশ্ব দেখছে।
পরিসংখ্যান কী বলছে?
আমেরিকায় প্রতি ১০ লাখ জনসংখ্যায় ২৬৭৯ জন আক্রান্ত, ১৫২ জনের মৃত্যু। ব্রিটেনে প্রতি ১০ লাখে ২০৩৪ জন করোনা আক্রান্ত, মৃত ২৭৬। আর সেখানে ভারতে প্রতি ১০ লাখে ১৭ জন আক্রান্ত, প্রতি ২০ লাখে ১ জনের মৃত্যু হয়েছে। এই হিসেবটা নিজেই সব কিছু বুঝিয়ে দিতে নিশ্চয়ই সক্ষম! তাই বলছিলাম কি, যে দেশকে সাগ্রহে গ্রহণ করে নিয়েছেন, সেখানেই নিজেদের মতো করে কাজ করুন না! অন্যের চরকা এখন থাক।
জানেন তো, পশ্চিমবঙ্গের চেয়ে গুজরাত বা মধ্যপ্রদেশের অবস্থা আরও অনেক অনেক খারাপ। আক্রান্ত এবং মৃত্যুর হিসেব দেখলেই তা বোঝা যায়। প্রবাসী গুজরাতি বা মধ্যপ্রদেশি কিন্তু কম নেই। বরং প্রবাসী বাঙালির থেকে অনেক বেশি। তাঁরা কিন্তু বিদেশে বসে নিজের দেশের বা রাজ্যের সমালোচনায় ব্যস্ত হয়ে পড়েননি। সোশ্যাল মিডিয়া দেখে ঝাঁপিয়ে পড়ে গোটা বিশ্বের সামনে নিজের রাজ্যকে টেনে নামিয়ে ছোট করার চেষ্টা করেননি। নিজের দেশের মানও খাটো করেননি। কিন্তু, প্রবাসী এই বাঙালিরা করলেন। আসলে এমনটা করলে হয়তো সাময়িক ভাবে হিরো হওয়া যায়। কিন্তু, যে দেশকে সাগ্রহে নিজের দেশ বানিয়েছেন, যেখানে নিজেরা থাকেন, সেই সব দেশে কী হচ্ছে, তা নিয়ে চিঠি লেখেননি কেন ওঁরা?
ওই প্রবাসী বাঙালিদের প্রতি আমার প্রশ্ন, অর্থনৈতিক ভাবে উন্নত দেশ হয়ে ইংল্যান্ড ও আমেরিকা, যে দেশগুলিকে আপনারা নিজেরা সাগ্রহে সাদরে গ্রহণ করে নিয়েছেন— সেখানে খুব খারাপ ভাবে করোনা মোকাবিলা করা হচ্ছে। সরকারের সংযোগ ব্যবস্থা খুবই খারাপ। পিপিই সরবরাহ করা হচ্ছে না, স্বাস্থ্যকর্মীরা চূড়ান্ত সঙ্কটে। সেই বাস্তবচিত্র তুলে ধরে এমন চিঠি কেন ইংল্যান্ডের স্বাস্থ্যসচিব বা মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বা স্টেট গভর্নরদের লেখেন না? উত্তরটা আমি জানি। এখানে হিরো হওয়া অনেক সোজা। তাই তো?
মনে রাখা উচিত, গড়িয়াহাট থেকে কিনে নিয়ে যাওয়া নতুন কুর্তা-পাজামা বা শাড়ি পরে অষ্টমীর দিন আমেরিকার কোনও ছোট শহরে প্রবাসীদের দুর্গাপুজোর মণ্ডপে বসে দেশের সমালোচনা করা আর এ রকম একটা বিশ্ব জুড়ে অতিমারির সময়ে নিজের রাজ্যকে হেয় করা এক জিনিস নয়। সূত্র: আনন্দবাজার
(লেখক কৃষ্ণনগর থেকে নির্বাচিত লোকসভার সদস্য)
এসি
আরও পড়ুন