ঢাকা, শনিবার   ২৩ নভেম্বর ২০২৪

চীনের এত শক্তির উৎস কোথায়

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ১৯:৫৮, ২০ জুন ২০২০ | আপডেট: ২২:৫৯, ২০ জুন ২০২০

সম্প্রতি ভারতের সঙ্গে ঘটে যাওয়া ঘটনায় আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে এখন চীন। সোমবারের হামলায় ভারতের ২০ জওয়ান নিহত ও ৭৬ জন আহত হয়। এমন আচরণে ভারতও বিষ্মিত হয়েছে। চীনকে নিয়ে নতুন করে ভাবতে শুরু করেছে বিশ্ব। প্রশ্ন দেশটির এত শক্তির উৎস কোথায়? অনেকটাই বৃদ্ধাঙ্গুলী দেখিয়ে দিব্যি অবস্থানের জানান দিচ্ছে চীন।

চীনের অর্থনৈতিক ও সামরিক দিক বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, দেশটি বর্তমানে অনেক এগিয়ে। চীনকে এখন দ্বিতীয় বা তৃতীয় শক্তিশালী দেশ বলা হয়ে থাকে। এশিয়ার মধ্যে এ দেশের শক্তি অনন্য।

বিশ্ব অর্থনীতিতে ব্যাপক শক্তি নিয়ে আবির্ভূত হয়েছে চীন। ইউরো কে পাশ কাটিয়ে বিশ্ব বাণিজ্য বাজারে সর্বাধিক ব্যবহৃত মুদ্রার তালিকায় দ্বিতীয় স্থানে উঠে এল চীনা ইউয়ান। এমনটাই জানাল গ্লোবাল ট্রানজাকশন সার্ভিসেস অর্গানাইজেশন। অক্টোবরেই ইউয়ান এর মার্কেট শেয়ার প্রথাগত আর্থিক লেনদেন ক্ষেত্রে ৮.৬৬ শতাংশে পৌছল। যেখানে ইউরোর শতকরা হার ৬.৬৪। আর্থিক লেনদেনের ক্ষেত্রে বিশ্ব বাণিজ্য বাজার এখনও মার্কিন ডলার দ্বারা সর্বাধিক প্রভাবিত। মার্কিন ডলারের শেয়ার ৮১.০৮ শতাংশ। গ্লোবাল ট্রানজাকশন সার্ভিসেস অর্গানাইজেশন জানিয়েছে, চীন, হংকং,সিঙ্গাপুর,জার্মানি এবং অস্ট্রেলিয়া এই পাঁচটি জায়গায় অক্টোবরে ইউয়ানের ব্যবহার সবচেয়ে বেশি ছিল।

এশিয়ার সামরিক ও অর্থনৈতিক পরাশক্তি চীন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য রাশিয়ার মতোই এক বড় হুমকি হয়ে উঠছে। এমনকি চীনের তরফ থেকে হুমকিটা আরও বড়। যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষতি করার ক্ষমতাও এখন রাশিয়ার চেয়ে চীনেরই বেশি। কেননা রাশিয়ার ‘অন্তর্ঘামূলক তৎপরতার চেয়ে’ বিশ্বজুড়ে চীনের ‘গোপন অর্থনৈতিক ক্ষমতা’র প্রভাবটা অনেক বড় ও ব্যাপকতর। কয়েক বছর আগে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী গোয়েন্দাসংস্থা সিআইএর প্রধান মাইক পম্প এমন উদ্বেগের কথা জানান। চীনের অর্থনীতি রাশিয়ার অর্থনীতির চেয়ে অনেক গুণ শক্তিশালী। বিশ্বজুড়ে নিজের লক্ষ্যপূরণ ও প্রভাব তুলে ধরার যতোটা ক্ষমতা চীনা অর্থনীতির আছে ততোটা নেই রাশিয়ার। চীনের প্রভাব বিস্তার-ক্ষমতার দৌড়ের সঙ্গে এখন এর ক্রমবর্ধমান গুপ্তচরবৃত্তিও যোগ হয়েছে। এর মধ্যে মানব গুপ্তচর যেমন রয়েছে, তেমনি রয়েছে সাইবার গুপ্তচরবৃত্তিও। এসবের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রকে নানাভাবে কোণঠাসা করার পাঁয়তারায় মত্ত চীন। মাইক পম্পেওর মতে, চীনকে আর রাশিয়ার চেয়ে কম বিপজ্জনক মনে করার দিন শেষ। বরং যুক্তরাষ্ট্রের জন্য সবচেয়ে বড় এক মূর্তিমান আতঙ্কের নাম এখন চীন।  

যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় দেড় শ বছরের একচ্ছত্র আধিপত্যকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে শেষ পর্যন্ত শ্রেষ্ঠত্বের স্বীকৃতি আদায় করে নিয়েছে চীন। এটি সামরিক শক্তির নয়, অর্থনীতির। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ২০১৪ সালের জরিপ প্রতিবেদন অনুসারে চীন এখন অর্থনৈতিক শক্তিতে বিশ্বের এক নম্বর দেশ। 

অর্থনৈতিক পরাশক্তি হিসেবে চীনের এ উত্তরণ আলোড়ন সৃষ্টি করেছে বিশ্বজুড়ে। পিছিয়ে থাকা দেশগুলোর সামনে চীন আজ সমৃদ্ধি আর উন্নয়নের মডেল। আইএমএফের সাম্প্রতিক জরিপে চীনের অর্থনীতি বিশ্লেষণ করে আরও বলা হয়েছে, ১৮৭২ সাল থেকে যুক্তরাষ্ট্রই ছিল বিশ্বসেরা অর্থনীতি। এতকাল পরে এসে চীন অদ্যম শক্তিতে সেই শীর্ষস্থান দখল নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রকে ফেলে দিয়েছে দ্বিতীয় অবস্থানে। সংস্থার জরিপে আরও দেখানো হয়েছে, চীন-যুক্তরাষ্ট্রের পর তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে ভারত। চতুর্থ অবস্থানে রয়েছে জাপান, পঞ্চমে জার্মানি, এর পরেই রয়েছে রাশিয়া, ব্রাজিল, ফ্রান্স ও ইন্দোনেশিয়া। আর সেরা দশে শেষ নামটি যুক্তরাজ্য।

১৩০ কোটি জনসংখ্যার দেশ চীনে রয়েছে বিশ্বের সর্ববৃহৎ শ্রমশক্তি। চীনের রয়েছে অফুরন্ত প্রাকৃতিক সম্পদ। বিশ্বব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ জাস্টিন লিন ২০১১ সালে বলেন, ২০১০ সালে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতিতে পরিণত চীন ২০৩০ সাল নাগাদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে অতিক্রম করে বিশ্বের সর্ববৃহৎ অর্থনীতিতে পরিণত হতে পারে, যদি বর্তমান প্রবণতা অব্যাহত থাকে। ২০২১ সালে চীনা কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিসি) তার শতবর্ষপূর্তি পালন করবে। চীন তার কাঙ্ক্ষিত অর্থনৈতিক অবস্থান বিশ্ব বিশেষজ্ঞদের ভবিষ্যদ্বাণীর উল্লিখিত সময়ের বহু আগেই অর্জন করে সবাইকে একরকম তাক লাগিয়ে দিয়েছে। চীন, রাশিয়া ও সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রজাতন্ত্রগুলোর সমন্বয়ে গঠিত সাংহাই কো-অপারেশন অর্গানাইজেশন একটি শক্তিশালী অর্থনৈতিক জোট। চীন একে আরও শক্তিশালী করার উদ্যোগ নিয়েছে। চীনের অর্থনৈতিক সম্পর্ক সম্প্রসারণের ক্ষেত্রে আসিয়ান হবে অন্যতম খুঁটিস্বরূপ। আসিয়ান ডলার ব্লক। চীন এটাকে ইউয়ান ব্লকে রূপান্তর করার উদ্যোগ নিচ্ছে। ঐতিহ্যগতভাবে পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে আসিয়ানের অর্থনৈতিক জোট বাঁধার প্রবণতা রয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ায় অনেক দেশের সঙ্গে চীনের রয়েছে গভীর সম্পর্ক। চীন দক্ষিণ এশিয়ার সমৃদ্ধি ও প্রবৃদ্ধিতে অংশগ্রহণে আগ্রহী। 

বিশ্বের মোট জনগোষ্ঠীর এক-পঞ্চমাংশ রয়েছে চীনে। দেশটি নিরন্তর সংগ্রাম করে চলেছে এবং অবশ্যই ব্যাপক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়ন সাধনে অনেক দীর্ঘ পথ এগিয়ে গেছে। চীন জনগণের দারিদ্র্য বিমোচন করেছে। তাদের জীবনযাত্রার মানের ব্যাপক উন্নতি হয়েছে। বিশ্বের শান্তি ও স্থিতিশীলতা এবং মানবজাতির উন্নয়ন ও প্রগতির ক্ষেত্রে দেশটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।

গত ৪৫ বছরে প্রথম বারের মতো চলতি মাসে সীমান্তে ভারত ও চীনের সামরিক সংঘর্ষে প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে। সিএনএন জানায়, এর আগে, ১৯৬২ সালে দুই দেশের মধ্যে ঠিক ওই একই জায়গায় যুদ্ধ হয়েছিল। সেই যুদ্ধে ভারত শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়েছিল। গত সোমবার ভারতের লাদাখের গালওয়ান উপত্যকা ও চীনের আকসাই চীন সীমান্তে ওই সংঘর্ষে ভারতের ২০ সেনা মারা যান। দুই দেশের মধ্যকার ডি-ফ্যাক্টো সীমান্ত কিংবা লাইন অব অ্যাকচুয়াল কন্ট্রোল (এলএসি) স্থানে ওই সংঘর্ষ ঘটে। সেখানে দুই দেশের মধ্যে ৩ হাজার ৪৪০ কিলোমিটার সীমান্ত রয়েছে। এই সংঘর্ষের কারণে মূলত কোন দেশ সামরিকভাবে কতটা শক্তিশালী এমনটি আলোচনা আসে। ১৯৬২ সালের যুদ্ধের পর বিগত দশকগুলোতে এশিয়ার দেশ চীন বিপুল পরিমানে যুদ্ধাস্ত্রের সম্ভার গড়ে তুলেছে। পরমাণু শক্তিধরও হয়েছে। বেইজিং ১৯৬৪ সালে শক্তিধর হয়ে ওঠে।

স্টকহোম আন্তর্জাতিক শান্তি গবেষণা ইনস্টিটিউটের (এসআইআরপিআই) চলতি সপ্তাহে প্রকাশিত পরিসংখ্যান অনুযায়ী ধারণা করা হচ্ছে, চীনের ক্ষেপণাস্ত্রের সংখ্যা ভারতের প্রায় দ্বিগুণের চেয়েও বেশি। চীনের পারমাণবিক ক্ষেপণাস্ত্র আছে প্রায় ৩২০টি। বেইজিংয়ের অস্ত্রাগারে নতুন ৪০টি ক্ষেপণাস্ত্র বেড়েছে। ১৯৭৫ সালে শেষবারের মতো ভারত ও চীনের সেনাবাহিনীর মধ্যে গোলাগুলি হয়। তাদের সীমান্তে পারমাণবিক হামলার জন্য সব রকম ব্যবস্থা নেওয়া থাকলেও দুই দেশই এক্ষেত্রে ‘প্রথম ব্যবহারের নীতি’ মেনে চলে। অর্থাৎ যদি এক পক্ষ আগে ব্যবহার করে তবেই অন্য পক্ষ ব্যবহার করবে।

দেশ দুটির মধ্যে সিদ্ধান্ত রয়েছে, ফ্রন্ট লাইনে যেসব সেনা সদস্য মোতায়েন থাকবেন, তাদের কাছে কোনও অস্ত্র থাকবে না। যদি সেনা র‍্যাঙ্ক অনুযায়ী কোনও অফিসারের কাছে আগ্নেয়াস্ত্র রাখার নিয়ম হয়, তাহলে তার নল মাটির দিকে ঘুরিয়ে রাখা থাকবে। সেজন্যই দুই দেশের সেনা সদস্যদের হাতাহাতি বা রড-পাথরের লড়াই হলেও কোথাও গুলি বিনিময় হয়নি।

সক্রিয় সেনাসদস্য
বিশ্বের ১৩৮টি দেশের মধ্যে পিআরডাব্লিউ ইনডেক্সে তৃতীয় স্থানে থাকা চীনের মোট ২১ লাখ ২৩ হাজার সেনা সদস্য রয়েছে, ভারতের রয়েছে ১৪ লাখ ৪৪ হাজার সেনা সদস্য। তবে রিজার্ভ সৈন্যর সংখ্যায় ভারত এগিয়ে। চীনের পাঁচ লাখ ১০ হাজারের বিপরীতে তাদের রয়েছে ২১ লাখ রিজার্ভ সৈন্য।

প্রতিরক্ষা বাজেট: প্রতিরক্ষা খাতে চীনের বাজেট ২৩৭০ কোটি ডলার এবং ভারতের ৬১০ কোটি ডলার।

এয়ারক্রাফট: এখানেও চীন এগিয়ে। চীনের ৩২১০টির বিপরীতে ভারতের রয়েছে ২১২৩টি এয়ারক্রাফট।

যুদ্ধজাহাজ: চীনের রয়েছে ৭৭৭টি যুদ্ধজাহাজ, আর ভারতের রয়েছে ২৮৫টি।

যুদ্ধবিমান: চীনের যুদ্ধবিমান ভারতের চেয়ে দ্বিগুণেরও বেশি। চীনের ১২৩২টি, আর ভারতের ৫৩৮টি৷

হেলিকপ্টার: চীনের আছে ৯১১টি হেলিকপ্টার, আর ভারতের ৭২২টি৷

ট্যাঙ্ক: ভারতের ট্যাঙ্ক চীনের চেয়ে অনেক বেশি। চীনের আছে ৩৫০০টি ট্যাঙ্ক, আর ভারতের ৪২৯২টি।

সাঁজোয়া যান: চীনের সাঁজোয়া যানবাহনের সংখ্যা ৩৩ হাজার, অন্যদিকে ভারতের ৮ হাজার ৬৮৬।

স্বয়ংক্রিয় আর্টিলারি: এই ক্যাটাগরিতে দু’দেশের তুলনাই হয় না। চীনের আছে ৩৮০০, ভারতের মাত্র ২৩৫৷

ফিল্ড আর্টিলারি: এখানে ভারত কিছুটা এগিয়ে। চীনের ৩৮০০টির বিপরীতে ভারতের রয়েছে ৪০৬০টি ফিল্ড আর্টিলারি।

রকেট প্রজেক্টর: চীনের আছে ২৬৫০টি রকেট প্রজেক্টর, আর ভারতের ২৬৬টি। সুতরাং এখানে চীন প্রায় দশগুণ এগিয়ে।

সাবমেরিন: সাবমেরিনের সংখ্যার দিক থেকেও ভারত অনেক পিছিয়ে। চীনের ৭৪টির বিপরীতে ভারতের আছে ১৬টি সাবমেরিন।

বিমানবাহী জাহাজ: চীনের আছে ২টি, ভারতের ১টি।

ডেস্ট্রয়ার: চীনের আছে ৩৬টি, অন্যদিকে ভারতের আছে ১০টি ডেস্ট্রয়ার।

ফ্রিগেট: চীনের ৫২টি ফ্রিগট, আর এর ঠিক চার ভাগের এক ভাগ রয়েছে ভারতের, অর্থাৎ ১৩টি।

রণতরি: রণতরি চীনের ৫০টি, ভারতের ১৯টি।

উপকূলীয় টহল: চীনের ২২০, ভারতের ১৩৯।

বিমানবন্দর: চীনের আছে মোট ৫০৭টি বিমানবন্দর, আর ভারতের রয়েছে ৩৪৭টি।

নৌবন্দর এবং টার্মিনাল: বিশ্বের সবচেয়ে বেশি জনসংখ্যার দেশ চীন প্রায় সব জায়গার মতো এখানেও দ্বিতীয় সর্বোচ্চ জনসংখ্যার দেশ ভারতের চেয়ে এগিয়ে। চীনের ২২টির বিপরীতে ভারতের রয়েছে মোট ১৩টি বন্দর ও টার্মিনাল।

এমএস/এসি

 


Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি