যে কারণে দিল্লি করোনার হটস্পট
প্রকাশিত : ১১:০৪, ২৯ জুন ২০২০
ভারতে এ পর্যন্ত করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ৫ লাখ মানুষ। এর মধ্যে দেশটির রাজধানী দিল্লি এখন সবচেয়ে বড় করোনাভাইরাসের হটস্পট। সেখানে ৭৭ হাজারের বেশি মানুষের করোনা শনাক্ত হয়েছে। কী কারণে দিল্লি দেশটির করোনার হটস্পটে উঠে আসলো তার বিস্তারিত বর্ণনা করেছে আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যম বিবিসি।
বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়, ভারত জুড়ে দু’মাস ধরে যখন কঠোর লকডাউন জারি করা হয়েছিল তখন দিল্লির কর্তৃপক্ষ করোনাভাইরাসের বিস্তার ঠেকানোর সুযোগ হাতছাড়া করেন।
এরজন্য দায়ী করা হচ্ছে বেশ কয়েকটি বিষয়কে। প্রথমত, কন্টাক্ট ট্রেসিংয়ের কোন ব্যবস্থা না রাখা; দ্বিতীয়ত, অতিরিক্ত আমলাতান্ত্রিক জটিলতা এবং তৃতীয়ত, ব্যক্তি খাতের স্বাস্থ্যসেবার সঙ্গে সমন্বয়ের অভাব। এর পাশাপাশি ভারতের রাজধানীতে ফেডারেল সরকারের সঙ্গে রাজ্য কর্তৃপক্ষের রাজনৈতিক বিবাদকেও এর জন্য দায়ী করা হচ্ছে।
ভারতের অনেক ছোট ছোট শহর দিল্লির তুলনায় অনেক ভালোভাবে করোনাভাইরাসের মোকাবেলা করেছে। দক্ষিণ ভারতের ব্যাঙ্গালোরে কন্টাক্ট ট্রেসিং অ্যাপ ব্যবহারের মাধ্যমে সাফল্যের সঙ্গে ভাইরাসের বিস্তার ঠেকানো সম্ভব হয়। দক্ষিণ ভারতের আরেকটি নগরী চেন্নাইও বেশ এগিয়ে আছে দিল্লি তুলনায়। সেখানে সংক্রমণ বেশ ছড়ালেও মৃত্যুর সংখ্যা তুলনামূলকভাবে অনেক কম।
তবে দিল্লি এবং মুম্বাই, এ দুটি শহরেই ভাইরাস সবচেয়ে মারাত্মকভাবে আঘাত হেনেছে। এই দুটি শহরেই সংক্রমনের হার খুবই বেশি। কিন্তু ভারতের সব নামী-দামী সরকারি হাসপাতাল এই দুই শহরে। অথচ এসব বড় বড় হাসপাতাল এখন করোনাভাইরাসের মোকাবেলায় হিমশিম খাচ্ছে।
তাহলে দিল্লির ভুলটা কোথায়?
যথেষ্ট পরীক্ষা এবং ট্রেসিং এর ব্যবস্থা না রাখা জুন মাসের শুরু থেকে দিল্লিতে সংক্রমণের সংখ্যা বাড়তে থাকে। কেবল এ মাসেই ৫০ হাজারের বেশি কোভিড-১৯ সংক্রমনের ঘটনা ধরা পড়েছে দিল্লিতে। এর একটা কারণ হয়তো দিল্লিতে করোনাভাইরাস পরীক্ষার সংখ্যা ব্যাপকভাবে বাড়ানো হয়েছে। এটি করা হচ্ছে একটি নতুন রেপিড টেস্টিং কিট দিয়ে, মাত্র আধ ঘন্টার মধ্যেই পরীক্ষার ফল জানা যায়।
ভারতের পাবলিক হেলথ ফাউন্ডেশনের প্রেসিডেন্ট এবং ন্যাশনাল কোভিড-১৯ টাস্কফোর্সের সদস্য কে শ্রীনাথ রেড্ডি বলছেন, “টেস্টিং কোন মহৌষধ নয়। আপনাকে টেস্টিং অবশ্যই করতে হবে। কিন্তু সেটা করতে হবে বিচার বিবেচনা করে, লক্ষণ দেখে এবং এর একটা পরিস্কার ভিত্তি থাকতে হবে।”
তিনি আরও বলেন, এটা কেবল তখনই করা সম্ভব যখন কনট্যাক্ট ট্রেসিং এর ব্যবস্থা থাকবে।
ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অফ মেডিক্যাল রিসার্চ বা আইসিএমআর একটি সমীক্ষা চালিয়েছে ভারতের কন্টাক্ট ট্রেসিং এর ওপর। তারা দেখেছে, জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত ভারতে প্রতিটি কনফার্মড কোভিড-১৯ কেসের জন্য গড়পড়তা ২০টি কন্ট্যাক্ট ট্রেসিং করা হয়েছে। যখন কর্নাটকের মত কোন কোন রাজ্যে কন্টাক্ট ট্রেসিং করা হচ্ছিল ৯৩ জন পর্যন্ত, সেখানে দিল্লিতে করা হয়েছে মাত্র ৯ জন।
এ মাসের শুরুর দিকে দিল্লির স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেছিলেন, সেখানে সংক্রমণের সংখ্যা এত বেশি যে কোভিড-১৯ পজিটিভ রোগীদের সরাসরি সংস্পর্শে আসা নিকটজনদেরই কেবল পরীক্ষা করা হচ্ছিল।
কিন্তু অনেক মানুষ টুইটারে এমন অভিযোগ করেছেন যে, কোনো কোনো ক্ষেত্রে কোভিড-১৯ পজিটিভ রোগীদের পরিবারের সদস্যদের পর্যন্ত টেস্ট করা হয়নি। এমনকি তাদের এলাকাগুলোতে সংক্রমণ প্রতিরোধের কোন ব্যবস্থাও নেয়া হয়নি।
অনেক ক্ষেত্রেই এসব পরিবারের সদস্যদের টেস্ট পর্যন্ত করা হয়নি। টেস্ট তখনই করা হয়েছে যখন বারবার সরকারের কাছে এ নিয়ে তারা আবেদন-নিবেদন করেছেন।
যদিও এখন দিল্লির প্রায় দুই কোটি ৯০ লাখ বাসিন্দাকে বাড়ি বাড়ি গিয়ে পরীক্ষার কথা বলা হচ্ছে। প্রতিদিনের ভিত্তিতে ২৬ হাজার মানুষকে বাছাই করা হবে। আর লোকজন সোশ্যাল ডিস্ট্যান্সিং মেনে চলছে কিনা সেটি পুলিশ এবং ড্রোন ব্যবহার করে নিশ্চিত করা হবে।
কিন্তু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই পদক্ষেপগুলো আসলে নেয়া উচিত ছিল অনেক আগে। যখন লকডাউনের কঠোর বিধিনিষেধ জারি ছিল তখন। যদি এই কাজটি করা হতো তাহলে হয়তো সরকারের পক্ষে অনেক দ্রুত এবং বেশ বিচক্ষণভাবে পদক্ষেপ নেয়া সহজ হতো।
সরকার পার্টনারশিপ গড়ে তুলতে ব্যর্থ
দিল্লির স্যার গঙ্গারাম হাসপাতালের একজন ভাসকুলার সার্জন ডক্টর আমবারিশ সাত্ত্বিক মনে করেন, ভারতে করোনাভাইরাস রোগটিকে একটি গ্লানিকর বিষয়ে পরিণত করা হয়েছে। এটিকে জনস্বাস্থ্যের বিষয় হিসেবে গণ্য না করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার সমস্যা বলে চিহ্নিত করা হয়েছে।
দিল্লিতে করোনাভাইরাস পরীক্ষাকে খুবই সীমিত করে রাখা হয়েছিল। কেউ যখন এই পরীক্ষায় পজিটিভ বলে প্রমাণিত হবেন, তারপর কি হবে সেটা নিয়ে কোন সঠিক তথ্য ছিল না। আর করোনাভাইরাস পজিটিভ প্রমানিত হলে সরকার ধরে নিয়ে নিম্নমানের কোন জায়গায় নিয়ে কোয়ারেন্টাইনের জন্য আটকে রাখবে এমন ভয়ে লোকজন কোন পরীক্ষাই করাতে চায়নি।
ডক্টর সাত্ত্বিক বলেন, “যদি আপনাকে পুলিশ ফোন করে, যদি আপনাকে ডিস্ট্রিক্ট সার্ভেইলেন্স অফিসার ফোন করে বলে, আপনাকে ধরে নিয়ে যাওয়া হবে কোয়ারেনটাইনের জন্য, তখন কে যাবে করোনাভাইরাসের পরীক্ষা করাতে।”
ভারতের চিকিৎসাসেবা ব্যবস্থায় ব্যক্তিগত খাত একটা বিরাট ভূমিকা পালন করে। অথচ করোনাভাইরাস মোকাবেলার পুরো দায়িত্বটা এসে পড়েছে সরকারি খাতের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উপর। সরকারি স্বাস্থ্য সেবা খাতে জনবলের ঘাটতি আছে। সরকারের ল্যাবরেটরী এবং হাসপাতালগুলোতে সুযোগ সুবিধার অভাব রয়েছে। ফলে বহু মানুষ, যাদের হয়তো লক্ষণ ছিল, তারা পরীক্ষা করানোর জন্য হাসপাতালে গিয়ে লাইনে দাঁড়ানোর পরিবর্তে ঘরে থাকাটাই শ্রেয় বলে ভেবেছে।
সাম্প্রতিক সময়ে দিল্লির হাসপাতালগুলোর যে অব্যবস্থাপনা এবং বিশৃঙ্খলার কথা প্রচার পেয়েছে, তা মানুষের উদ্বেগ আরো বাড়িয়ে দিয়েছে।
দিল্লিতে ক্ষমতার দুটি কেন্দ্র
আরেকটা সমস্যা দাঁড়িয়েছিল দিল্লির প্রশাসনিক ব্যবস্থায়। যদিও এই রাজ্যটি পরিচালনা করেন কেজরিওয়াল এবং তার সরকার, কিন্তু দিল্লির লেফটেন্যান্ট গভর্নর, যিনি ফেডারেল সরকারের প্রতিনিধি, তারও কিছু ক্ষমতা আছে।
এই দ্বৈত প্রশাসনিক ব্যবস্থার কারণে বেশ কিছু পরস্পরবিরোধী নির্দেশ জারি করা হয়েছিল দিল্লিতে। যেগুলো আবার পরে প্রত্যাহার করে নেয়া হয়। অনেক সময় এরকম নির্দেশ জারি করা এবং প্রত্যাহারের ঘটনা ঘটেছে মাত্র ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই। কেজরিওয়ালের সঙ্গে ভারতের ফেডারেল সরকারের সম্পর্ক যে খুব ভাল ছিল না এটা তারই প্রমাণ।
প্রফেসর রেড্ডি বলেন, “আমরা একটা সিদ্ধান্ত থেকে আরেকটা সিদ্ধান্তের মধ্যে এভাবে দোল খেতে পারিনা, যখন কিনা এরকম জটিল সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ার মধ্যে খাবি খাওয়ার পরিবর্তে রাজধানী শহর হিসেবে দিল্লির একটা আলাদা মনোযোগ পাওয়া উচিৎ ছিল।”
এএইচ/
আরও পড়ুন