যে তিনটি বিষয় নিয়ে সঙ্কটে সৌদি যুবরাজ
প্রকাশিত : ২২:৩১, ৯ ডিসেম্বর ২০২০ | আপডেট: ২২:৩৩, ৯ ডিসেম্বর ২০২০
যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান
সৌদি নেতৃত্ব, বিশেষ করে দেশটির প্রবল ক্ষমতাশালী এমবিএস নামে পরিচিত যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান বর্তমানে কিছুটা অস্বস্তিকর সময় পার করছেন। দেশটির অভ্যন্তরে যুবরাজের জনপ্রিয়তা অক্ষুণ্ণ রয়েছে ঠিকই, কিন্তু আন্তর্জাতিকভাবে ২০১৮ সালে সৌদি সাংবাদিক জামাল খাসোগির হত্যায় তার জড়িত থাকার অভিযোগ নিয়ে যে সন্দেহের বাতাবরণ রয়ে গেছে, তা তিনি এখনও ঝেড়ে ফেলতে পারেননি।
এরই মধ্যে আমেরিকায় নতুন প্রশাসন হোয়াইট হাউসে যখন দায়িত্ব গ্রহণের প্রস্তুতি নিচ্ছে, তখন নব নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন স্পষ্ট বলে দিয়েছেন- কোন কোন সৌদি ইস্যুতে তিনি তার পূর্বসুরীর চেয়ে কঠোর অবস্থান নেবেন। সেই ইস্যুগুলো কী এবং আমেরিকা ও সৌদি আরবে ক্ষমতাসীনদের জন্য কেন এই ইস্যুগুলো গুরুত্বপূর্ণ? আসুন জেনে নেয়া যাক-
ইয়েমেন যুদ্ধ
এই যুদ্ধ-লড়াইয়ে জড়িত প্রায় সব পক্ষের জন্যই একটা বিপর্যয়। বিশেষ করে ইয়েমেনের দরিদ্র এবং পুষ্টিহীন জনগোষ্ঠীর জন্য। সৌদি আরব এই যুদ্ধ শুরু করেনি- করেছিল হুথিরা। যখন তারা ২০১৪-র শেষ দিকে রাজধানী সানায় অভিযান চালিয়ে বৈধ সরকারকে উৎখাত করে। হুথিরা ইয়েমেনের উত্তরাঞ্চলের পাহাড়ি এলাকার একটি উপজাতি গোষ্ঠী এবং সংখ্যার হিসাবে তারা দেশটির জনসংখ্যার ১৫ শতাংশেরও কম।
২০১৫-র মার্চে, এমবিএস যখন সৌদি প্রতিরক্ষা মন্ত্রী ছিলেন, তিনি কয়েকটি আরব রাষ্ট্রকে নিয়ে গোপনে একটি জোট গঠন করে ইয়েমেনে বিশাল বিমান আক্রমণ চালান। তারা আশা করেছিলেন- এই প্রবল বিমান হামলার মুখে হুথিরা কয়েকমাসের মধ্যেই আত্মসমর্পণ করবে।
কিন্তু প্রায় ছয় বছর ধরে লড়াইয়ে কয়েক হাজার নিহত ও বহু মানুষ বাস্তুচ্যুত হবার পরেও সৌদি নেতৃত্বাধীন এই জোট সানা এবং ইয়েমেনের জনঅধ্যুষিত পশ্চিমাঞ্চল থেকে হুথিদের হঠাতে পারেনি। এই ছয় বছরে দুই পক্ষই যুদ্ধাপরাধও সংঘটিত করেছে।
ইরানের সহযোগিতায় হুথিরা ক্রমশই আরও নির্ভুল নিশানার ক্ষেপণাস্ত্র এবং বিস্ফোরক ড্রোন ছুঁড়েছে সৌদি আরবকে লক্ষ্য করে। তাদের ছোঁড়া ক্ষেপণাস্ত্র এমনকি জেদ্দা পর্যন্ত পৌঁছেছে এবং তেল স্থাপনাগুলোকে আঘাত করতে সক্ষম হয়েছে।
অর্থের হিসেবে এই অচলাবস্থা সৌদির জন্য বেশ ব্যয়বহুল হয়ে দাঁড়িয়েছে এবং বহু শান্তি পরিকল্পনাই একের পর এক ভেস্তে গেছে। ইয়েমেনের যুদ্ধে প্রাণ হারিয়েছে বহু ইয়েমেনী, কিন্তু সৌদিকে এই রক্তক্ষয়ের জন্য চড়া আর্থিক মূল্য দিতে হয়েছে, পাশাপাশি দেশের বাইরে তাদের বিরাট সমালোচনার মুখে পড়তে হয়েছে।
সৌদি চায় এই অচলাবস্থা থেকে এমন একটা পরিত্রাণ, যাতে অন্তত তাদের মুখরক্ষা হবে। কিন্তু সৌদি "তাদের দক্ষিণ সীমান্তে ইরানের একটা শক্ত ঘাঁটি গড়ে তোলা বন্ধের" কথা ইতোমধ্যেই বলেছে। তারা জোর দিয়ে বলেছে যে- ইরানের সমর্থনপুষ্ট সশস্ত্র মিলিশিয়ারা ইয়েমেনে ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণ করবে, এটা তারা কখনওই মেনে নেবে না। তবে সৌদির যুদ্ধ চালিয়ে যাবার দিন ক্রমশ ফুরিয়ে আসছে।
বারাক ওবামা, ২০১৬ সালে তার ক্ষমতার শেষ দিকে সৌদি আরবের প্রতি মার্কিন সহায়তা অনেকটাই খর্ব করেছিলেন। কিন্তু ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্ষমতা নেয়ার পর সেটা উল্টে দেন এবং রিয়াদ যতো ধরনের গোয়েন্দা তথ্য এবং সামরিক সরঞ্জাম চেয়েছে আমেরিকা তার পুরোটাই দেয়। এখন মি. বাইডেনের প্রশাসন ইঙ্গিত দিয়েছেন যে, এই সহায়তা দেয়া বন্ধ করে দেয়া হতে পারে।
যে কারণে এখন এই যুদ্ধ শেষ করার জন্য সৌদির উপর চাপ বাড়ছে।
বন্দী নারীরা
সৌদির ১৩ জন শান্তিপূর্ণ নারী আন্দোলনকারীকে কারাগারে আটক রাখা হয়েছে এবং এদের কাউকে কাউকে ভয়ানকভাবে নির্যাতনের অভিযোগ রয়েছে। এদের অপরাধ কার্যত নারীদের গাড়ি চালানোর অধিকার দাবি করা এবং পুরুষ অভিভাবকের অধীনে থাকার 'চরম অন্যায্য পদ্ধতি'র অবসান চাওয়া।
এদের মধ্যে সবচেয়ে পরিচিত বন্দী লুজাইন আল-হাথলুলসহ অনেককেই গ্রেফতার করা হয় ২০১৮ সালে। নারীদের গাড়ি চালানোর ওপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নেবার ঠিক আগে আগে। যা সৌদি নেতৃত্বের আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তি উন্নত করার প্রচারণায় এটা একটা বড় বিপর্যয়।
সৌদি কর্মকর্তারা এখনও অভিযোগ করছেন যে- মিস হাথলুল গুপ্তচরবৃত্তির দায়ে দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন এবং তিনি "বিদেশি শক্তির কাছ থেকে অর্থ গ্রহণ করেছেন।" কিন্তু এর স্বপক্ষে তথ্যপ্রমাণ সৌদি কর্তৃপক্ষ দেখাতে পারেননি।
হাথলুল-এর বন্ধুরা বলছেন- তিনি শুধু বিদেশে মানবাধিকার বিষয়ে একটি সম্মেলনে যোগ দিতে গিয়েছিলেন এবং জাতিসংঘে একটি চাকরির আবেদন করেছিলেন।
তার পরিবারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে- আটক অবস্থায় থাকাকালীন তাকে প্রহার করা হয়েছে, ইলেকট্রিক শক এবং ধর্ষণের হুমকি দেয়া হয়েছে। শেষবার যখন তার পরিবার তার সাথে কারাগারে দেখা করতে যায়, তখন তিনি প্রচণ্ড কাঁপছিলেন, নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছিলেন না।
ইয়েমেন যুদ্ধের মতই এই বিষয়টাতেও সৌদি নেতৃত্ব নিজের জন্য নিজ হাতেই কবর খুঁড়ে রেখেছে এবং এখন মুখ রক্ষা হয়- এমন এটা নিষ্কৃতির উপায় খুঁজছে।
এই নারীদের দীর্ঘদিন ধরে কারাগারে আটক রাখা হয়েছে কোনওরকম সাক্ষ্যপ্রমাণ ছাড়াই। নিরপেক্ষ বিচার ব্যবস্থা আছে এমন কোনও দেশের আদালতে এদের বিরুদ্ধে মামলাই টিকবে না। ফলে সৌদির জন্য এই ঘোলাটে পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসার একমাত্র রাস্তা হলো- এদের "খবুই মহানুভব হয়ে ক্ষমা প্রদর্শন"।
ধারণা করা হচ্ছে- নতুন বাইডেন প্রশাসন এই বিষয়টি সৌদির কাছে উত্থাপন করতে যাচ্ছেন।
কাতার বয়কট
দৃশ্যত, এই ইস্যুটি পর্দার আড়ালে দীর্ঘ দিন ধরে চালানো কুয়েতী মধ্যস্থতায় সমাধান হয়ে গেছে বলেই মনে হবে। কিন্তু ভেতরে ভেতরে এই সমস্যার শেকড় অনেক গভীরে।
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ২০১৭ সালে রিয়াদ সফর করার কয়েকদিনের মধ্যেই সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাহারাইন এবং মিশরের সঙ্গে মিলে তাদের উপসাগরীয় প্রতিবেশি দেশ কাতারকে খোঁড়া করে দেবার মতো বিধ্বংসী বয়কট বা বর্জনের পদক্ষেপ নেয়।
তাদের যুক্তি ছিল- কাতার ইসলামপন্থী যে দলগুলোকে সমর্থন করছে, তাদের কর্মকাণ্ড সন্ত্রাসবাদের পর্যায়ে পড়ে এবং এটা অগ্রহণযোগ্য।
যেসব অভিযুক্ত সন্ত্রাসী কাতারে বাস করছে, তাদের সম্পর্কিত একটি নথিও প্রকাশ করে সংযুক্ত আরব আমিরাত। কিন্তু কাতার কোনওরকম সন্ত্রাসে মদদ দেবার অভিযোগ প্রত্যাখান করে এবং তাদের প্রতিষ্ঠিত ও সুপরিচিত টেলিভিশন চ্যানেল আল জাজিরাকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য এই চারটি দেশের জোটের দাবি মানতে অস্বীকৃতি জানায়।
ইয়েমেনে হুথিদের মতই সৌদির একটা ভুল প্রত্যাশা ছিল যে- কাতার চাপের মুখে নতি স্বীকার করবে এবং শেষ পর্যন্ত তার বশ্যতা মেনে নেবে। কিন্তু তারা তা নেয়নি। এর কারণ অংশত কাতারের রয়েছে বিপুল সম্পদ। কাতারে উপকূলবর্তী তেল উৎপাদনের ক্ষেত্র রীতিমত বিশাল এবং শুধুমাত্র ব্রিটেনের অর্থনীতিতেই কাতারের বিনিয়োগের পরিমাণ ৪০ বিলিয়ন পাউন্ড (৫৩ বিলিয়ন ডলার)- এছাড়াও তাদের পেছনে রয়েছে তুরস্ক ও ইরানের সমর্থন।
এর ফলে যেটা দাঁড়িয়েছে সেটা হলো- মধ্য প্রাচ্যে সাম্প্রতিক কয়েক বছরে একটা বিরাট বিভাজন রেখা তৈরি হয়ে গেছে। এর একদিকে আছে- তিনটি রক্ষণশীল, সুন্নি উপসাগরীয় আরব রাজতন্ত্র- সৌদি আরব, ইউএই এবং বাহরাইন, সাথে তাদের মিত্র দেশ মিশর।
অন্যদিকে আছে- কাতার, তুরস্ক এবং রাজনৈতিকভাবে ইসলামী যেসব আন্দোলনকে তারা সমর্থন করে, যেমন মুসলিম ব্রাদারহুড এবং গাজায় হামাস গোষ্ঠী।
আর এই ধরনের অর্ন্তবর্তীকালীন আন্দোলনকারী গোষ্ঠীগুলো ওই চার দেশীয় জোটের অপছন্দের কারণ, এদেরকে তারা নিজেদের অস্তিত্বের প্রতি হুমকি হিসাবে দেখে।
তবে সাড়ে তিন বছর ধরে কাতারকে বয়কটের এই নীতির কারণে দুই পক্ষই যে অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তাতে কোনও সন্দেহ নেই।
এছাড়াও এর মধ্যে দিয়ে যেটা সামনে এসেছে সেটা হলো- উপসাগরীয় এলাকায় আরব সংহতির আদর্শ আসলেই একটা অর্থহীন বিষয়। আর এটা ঘটেছে এমন সময় যখন, উপসাগরীয় আরব নেতাদের মধ্যে ইরানের পারমাণবিক এবং ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচি নিয়ে উদ্বেগ ক্রমশই বাড়ছে।
এই বিবাদ মীমাংসার ব্যাপারে চাপ দিতে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের দূত হিসাবে জারেড কুশনার উপসাগরীয় এলাকা সফর করেন। এবং মি. বাইডেনের প্রশাসনও নিঃসন্দেহে চাইবে এই সমস্যার সমাধান। এর আরও একটা কারণ হলো- কাতারের আল-উদাইদে রয়েছে বিদেশে পেন্টাগনের সবচেয়ে বড় সামরিক ঘাঁটি।
কিন্তু মধ্যস্থতার মাধ্যমে যে সামাধান মীমাংসাই হোক না কেন, সেটার বাস্তবায়নই সবচেয়ে বড় কথা।
প্রতিবেশি দেশগুলোকে ক্ষমা করতে কাতারের হয়তো অনেক বছর সময় লেগে যাবে। এবং অন্যদিক থেকে কাতারের ওপর বিশ্বাস পুনরুদ্ধারের জন্যও এই চারটি দেশ হয়তো অনেক বছর সময় নেবে।- বিবিসি।
এনএস/
আরও পড়ুন