মিয়ানমারের ফৌজি সংস্থার সঙ্গে ভারতীয় কোম্পানির বাণিজ্যে
প্রকাশিত : ১৮:৫৪, ১৩ জানুয়ারি ২০২১
মিয়ানমারে বিদেশি বিনিয়োগে বিপুল অবকাঠামো নির্মাণের কাজ চলছে
মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর মালিকানাধীন একাধিক সংস্থা জাতিসংঘের ফ্যাক্ট-ফাইন্ডিং মিশনের রিপোর্টে অভিযুক্ত হওয়ার পরও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ও ভারতীয় কোম্পানি তাদের সঙ্গে ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
অস্ট্রেলিয়ার কার্টিন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও গবেষক তোয়ে তোয়ে থেইন জানিয়েছেন, এই কোম্পানিগুলো নৈতিকতার সঙ্গে আপস করেই মিয়ানমারে ব্যবসা চালাচ্ছে এবং এদের মধ্যে ভারতের আদানি শিল্পগোষ্ঠী বা ইনফোসিসের মতো টেক সংস্থাও রয়েছে।
২০১৭ সালে মিয়ানমারে রাখাইন প্রদেশে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে যে সামরিক অভিযান চালানো হয়েছিল, তার জন্য আন্তর্জাতিক আদালতে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে গণহত্যার মামলাও চলছে, কিন্তু তার পরও সে দেশের ফৌজি সংস্থাগুলোকে বাণিজ্যিক বয়কটের মুখে পড়তে হচ্ছে না বলেই তাঁর পর্যবেক্ষণ।
বস্তুত চীন বা ভারতের মতো দেশগুলোর প্রভূত পরিমাণে বাণিজ্যিক স্বার্থ আছে বলেই রোহিঙ্গা গণহত্যার প্রশ্নে তারা সেভাবে মিয়ানমারের সমালোচনা করে না - এই অভিযোগ গত কয়েক বছরে বারে বারেই উঠেছে।অস্ট্রেলিয়া-ভিত্তিক গবেষক ও অধ্যাপক তোয়ে তোয়ে থেইনের সাম্প্রতিক এক রিপোর্টেও সেই অভিযোগের সত্যতা প্রমাণিত হয়েছে।
পার্থ থেকে টেলিফোনে তিনি বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন, "জাতিসংঘের প্রতিবেদনে এই প্রথমবারের মতো বিভিন্ন আন্তর্জাতিক কোম্পানির সমালোচনা করা হয়েছে - যারা মিয়ানমারের সেনার সঙ্গে অংশীদারিত্বে সে দেশে ব্যবসা চালাচ্ছে।"
"মিয়ানমার আর্মির অধীন দুটি সংস্থা, মিয়ানমার ইকোনমিক কর্পোরেশন (এমইসি) ও মিয়ানমার ইকোনমিক হোল্ডিং লিমিটেডের (এমইএইচএল) ব্যবসার মুনাফা যে সরাসরি সেনা অভিযানে ব্যবহার করা হয়েছে, জাতিসংঘ তারও প্রমাণ পেয়েছে।"
"সে কারণেই জাতিসংঘ এই সংস্থাগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করতে এই কোম্পানিগুলোকে আহ্বান জানিয়েছে।"
জাতিসংঘের যে মিশন এই রিপোর্ট দিয়েছে, তার সদস্য ছিলেন অস্ট্রেলিয়ার সাবেক মানবাধিকার কমিশনার ক্রিস সিডোটি, ইন্দোনেশিয়ার সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল মার্জুকি দারুসমান ও শ্রীলঙ্কার মানবাধিকার আইনজীবী রাধিকা কুমারাস্বামী।
অধ্যাপক থেইন মনে করছেন, এইচএসবিসি বা স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ডের মতো ব্যাঙ্কিং জায়ান্টরা কিংবা ভারতের আদানি পোর্টস এই মিশনের মতামতকে মিয়ানমারে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করার নীতি নিয়েছে।
তার কথায়, "মিয়ানমারে যাদের সঙ্গে ব্যবসা করবেন, তাদের ব্যাপারে ভাল করে খোঁজ নেওয়া বা 'ডিউডিলিজেন্স' খুব জরুরি।"
"আমি এটা মানি মিয়ানমারের ফৌজি কোম্পানিগুলোর বন্দর, রিয়েল এস্টেট, মাইনিং, অবকাঠামো ইত্যাদি বিভিন্ন খাতে যেমন মনোপলি বা একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ আছে কিংবা যে বিপুল জমির মালিকানা আছে তাতে তাদের বাদ দিয়ে ব্যবসাপাতি করা খুব মুশকিল - কিন্তু একেবারে অসম্ভব নয়।"
"কিন্তু যাদের বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগ আছে, তাদের সঙ্গে সরাসরি ব্যবসায় জড়িয়ে এই কোম্পানিগুলো নৈতিকতার সঙ্গে বিরাট আপস করছে বলেই মনে করি", বলছিলেন অধ্যাপক থেইন।
তোয়ে তোয়ে থেইন অবশ্য এটাও স্পষ্ট করে দিতে চান, তিনি কখনওই মিয়ানমারে আন্তর্জাতিক লগ্নির বিরোধী নন। বরং তিনি চান মিয়ানমারে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো আরও বেশি করে আসুক - কিন্তু তারা যেন 'হাতে রক্তের দাগ লাগা' সেনাবাহিনীর সঙ্গে ব্যবসায়িক সম্পর্কে না জড়ায়।
দিল্লিতে অবজার্ভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের ফেলো ও মিয়ানমার গবেষক জয়িতা ভট্টাচার্য কিন্তু মনে করেন, সেনাবাহিনী দেশের ক্ষমতার রাশ কাগজে-কলমে ছেড়ে দিলেও মিয়ানমারে তাদের বাদ দিয়ে ব্যবসা করা এখনও প্রায় অসম্ভব।
তিনি বলছিলেন, "সে দেশের আর্থসামাজিক কাঠামোতে 'তাতমাদও' বা সামরিক বাহিনীর একটা প্রগাঢ় প্রভাব রয়েছে, এবং তাদের উপেক্ষা করে ব্যবসা করা খুব কঠিন - এরকম একটা চিত্রই কিন্তু আমরা পাই। এখানে এথিকস বা নৈতিকতা এবং ব্যবসায়িক স্বার্থ - দুটো যে যার মতো আলাদা পথে চলে বলেই আমার পর্যবেক্ষণ! কোম্পানিগুলো এথিকসকে একভাবে দেখে, আর বিজনেসকে দেখে অন্য চোখে।"
মিস ভট্টাচার্য অবশ্য সেই সঙ্গে এটাও মনে করিয়ে দিচ্ছেন আদানি বা ইনফোসিস শিল্পগোষ্ঠী মিয়ানমারে তেমন বড় কোনও প্লেয়ার নয় - চীন বা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার কোম্পানিগুলোর লগ্নি বা ভূমিকা সেখানে অনেক বেশি।
"যেভাবে চীন মিয়ানমারের বাজারে ঢুকেছে বা ইস্ট এশিয়ার আরও নানা দেশ, সেই তুলনায় ভারতীয় সংস্থাগুলোর উপস্থিতি কিন্তু একেবারেই কম", বলছিলেন তিনি।
"মিয়ানমারে ভারতের যতটা সম্ভাবনা ছিল তার অনেকটাই এখনও কাজে লাগানো যায়নি, ভারতীয় কোম্পানিগুলোর ভূমিকাও বেশ সীমিত রয়ে গেছে।"
"চীনের প্রাধান্যই সেখানে বেশি। আর একটা কথা হল, মিয়ানমার কিন্তু নিজেদের প্রধানত পূর্ব এশিয়ার দেশ হিসেবেই দেখে। ফলে দক্ষিণ এশিয়ার তুলনায় পূর্ব এশিয়ার সঙ্গেই তাদের বাণিজ্যিক সম্পর্ক বেশি নিবিড়", বলছিলেন জয়িতা ভট্টাচার্য।
মিয়ানমারে নৈতিকতার সঙ্গে আপসের প্রশ্নে আদানি গোষ্ঠীর জবাব কী, সে প্রসঙ্গে তাদের কাছে ইমেইল পাঠানো হলেও এখনও জবাব মেলেনি।
তবে গত মাসেই আদানি পোর্টস এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, ইয়াঙ্গনে তারা যে অ্যাহলোন বন্দর টার্মিনাল বানাচ্ছে সেটা স্থানীয় অর্থনীতির উন্নয়ন ঘটাবে, অন্তত এগারোশো স্থানীয় বাসিন্দা সেখানে চাকরি পাবেন। সূত্র: বিবিসি বাংলা
এসি
আরও পড়ুন