ঢাকা, সোমবার   ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪

কট্টরপন্থী ধর্মীয় নেতা থেকে ইরানের নতুন প্রেসিডেন্ট

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ১২:০৩, ৬ আগস্ট ২০২১

ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতোল্লাহ আলী খামেনির ঘনিষ্ঠ এবং কট্টরপন্থী ধর্মীয় নেতা এব্রাহিম রাইসি দেশটির প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন ২০২১ সালের জুন মাসে। ষাট বছর বয়সী এই নেতা ৫ আগস্ট বৃহস্পতিবার ইরানের নতুন প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন।

নির্বাচনে রাইসি প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন যে বিদায়ী প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানির আমলে ইরানে যে ব্যাপক দুর্নীতি হয়েছে এবং অর্থনৈতিক সঙ্কট দেখা দিয়েছে, তিনি সেসব মোকাবেলা করবেন। এর আগে তিনি দেশটির বিচার বিভাগের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তার রাজনৈতিক মতাদর্শও অত্যন্ত কট্টর।

অনেক ইরানি নাগরিক এবং মানবাধিকার কর্মী মনে করেন, ১৯৮০-এর দশকে রাজনৈতিক বন্দীদের গণহারে মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার পেছনে তার ভূমিকা ছিল।

এব্রাহিম রাইসির জন্ম ১৯৬০ সালে ইরানের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর মাশহাদে, যেখানে শিয়া মুসলিমদের পবিত্র মাজার অবস্থিত। তার পিতাও একজন ধর্মীয় নেতা ছিলেন এবং রাইসির বয়স যখন মাত্র পাঁচ বছর তখন তার পিতা মারা যান। শিয়াদের প্রথা মতো রাইসি মাথায় কালো পাগড়ি পরেন। ১৫ বছর বয়সে তিনি পিতার পথ অনুসরণ করে পবিত্র শহর কওমের একটি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা শুরু করেন। ছাত্র থাকা কালেই তিনি পশ্চিমা-সমর্থিত শাহের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ বিক্ষোভে অংশ নেন। আয়াতোল্লাহ রুহুল্লাহ খোমেনি নেতৃত্বাধীন এক ইসলামিক বিপ্লবে ১৯৭৯ সালে শাহের পতন ঘটে। বিপ্লবের পর এব্রাহিম রাইসি বিচার বিভাগে যোগ দেন এবং বিভিন্ন শহরে সরকারি কৌঁসুলি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এই সময়ে তিনি আয়াতোল্লাহ খামেনির কাছ থেকে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন, যিনি ১৯৮১ সালে ইরানের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। রাইসি ২৫ বছর বয়সে রাজধানী তেহরানের ডেপুটি প্রসিকিউটর হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এই পদে থাকার সময় তিনি ইরানের বিতর্কিত একটি ট্রাইব্যুনালের চারজন বিচারকের একজন ছিলেন। ১৯৮৮ সালে গঠিত গোপন এই ট্রাইব্যুনালটি ‘ডেথ কমিটি’ হিসেবে পরিচিত।

ইরানে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের কারণে যে হাজার হাজার মানুষ ইতোমধ্যেই কারাভোগ করছিল তাদের পুনর্বিচারের ব্যবস্থা করা হয় এই ট্রাইব্যুনালে। এসব রাজবন্দীর বেশিরভাগই ছিলেন সরকারবিরোধী বামপন্থী গ্রুপ মুজাহেদিন-ই-খালক (এমইকে)-এর সদস্য। এই গ্রুপটি পিপলস মুজাহেদিন অর্গানাইজেশন অফ ইরান (পিএমওআই) নামে পরিচিত। এই ট্রাইব্যুনালে ঠিক কতোজনকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছিল সেই প্রকৃত সংখ্যা জানা যায় না, তবে মানবাধিকার গ্রুপগুলোর হিসেবে পাঁচ হাজারের মতো নারী ও পুরুষের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছিল যাদেরকে গণহারে কবর দেওয়া হয় যা মানবতা-বিরোধী অপরাধ হিসেবে বিবেচিত।

ইসলামিক এই দেশটির নেতারা এসব মৃত্যুদণ্ডের কথা অস্বীকার করেন না, তবে এসব মামলার প্রতিটির আইনগত দিক ছাড়াও এসব বিষয়ে তারা বিস্তারিত আলোচনা করতে আগ্রহী নন। রাইসি এসব মৃত্যুদণ্ডের পেছনে তার ভূমিকার কথা অস্বীকার করেছেন। তবে তিনি বলেছেন, সাবেক সর্বোচ্চ নেতা আয়াতোল্লাহ খোমেনির এক ফতোয়ার কারণে এসব মৃত্যুদণ্ড যৌক্তিক ছিল।

রাইসির সঙ্গে বিচার বিভাগের আরো কয়েকজন সদস্য এবং দ্বিতীয় সর্বোচ্চ নেতা আয়াতোল্লাহ হোসেইন আলী মনতাজেরির ১৯৮৮ সালে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকের অডিও টেপ ফাঁস হয়ে যায় পাঁচ বছর আগে। তাতে মনতাজেরি বলেছেন এসব মৃত্যুদণ্ড ছিল ইসলামিক দেশটির ইতিহাসে সবচেয়ে বড় অপরাধ। তার এক বছর পরেই মনতাজেরিকে তার পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয় এবং খোমেনির মৃত্যুর পর আয়াতোল্লাহ খামেনি ইরানের সর্বোচ্চ নেতা হয়ে ওঠেন।

তখনও রাইসি তেহরানে সরকারি কৌঁসুলি হিসেবে কাজ করছিলেন। এর পর তাকে স্টেট ইন্সপেক্টোরেট অর্গানাইজেশনের প্রধান করা হয়। তারও পরে তিনি বিচার বিভাগের উপ-প্রধানের দায়িত্ব পালন করেন। ২০১৪ সালে তাকে প্রসিকিউটর জেনারেলের পদে নিয়োগ দেওয়া হয়। এর দু’বছর পর আয়াতোল্লাহ খামেনি তাকে ইরানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং সমৃদ্ধ ধর্মীয় ফাউন্ডেশন আস্তান-ই-কুদস-ই রাজাভির কাস্টোডিয়ান বা রক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেন। এই ফাউন্ডেশন মাশহাদ শহরে অবস্থিত অষ্টম শিয়া ইমাম রেজার মাজারসহ আরো কিছু দাতব্য প্রতিষ্ঠান ও সংস্থা পরিচালনা করে থাকে।

পরে এব্রাহিম রাইসি ২০১৭ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে নিজেকে যখন একজন প্রার্থী হিসেবে ঘোষণা করেন তখন পর্যবেক্ষকদের অনেকেই বিস্মিত হয়েছিল। ওই নির্বাচনের প্রথম ধাপে আরেক ধর্মীয় নেতা হাসান রুহানি বিপুল ভোটে (৫৭%) বিজয়ী হয়ে দ্বিতীয় মেয়াদে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। সেসময় রাইসি নিজেকে দুর্নীতি-বিরোধী যোদ্ধা হিসেবে তুলে ধরেন। কিন্তু তৎকালীন প্রেসিডেন্ট তার বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন যে বিচার বিভাগের উপ-প্রধান হয়েও দুর্নীতি ঠেকাতে তিনি তেমন কিছু করেন নি। ওই নির্বাচনে ৩৮% ভোট পেয়ে দ্বিতীয় হন এব্রাহিম রাইসি। কিন্তু এই পরাজয়ে রাইসির ভাবমূর্তির কোনো ক্ষতি হয়নি। ২০১৯ সালে আয়াতোল্লাহ খামেনি তাকে ইরানের বিচার বিভাগের প্রধানের মতো প্রভাবশালী পদে নিয়োগ দেন। এর পরের সপ্তাহেই তিনি অ্যাসেম্বলি অফ এক্সপার্টস কমিটির ডেপুটি চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। এটি ৮৮ জন ধর্মীয় ব্যক্তিত্বকে নিয়ে গঠিত একটি কমিটি যারা ইরানের পরবর্তী সর্বোচ্চ নেতা নির্বাচন করে থাকে।

বিচার বিভাগের প্রধান হিসেবে রাইসি বেশকিছু সংস্কার কর্মসূচি পরিচালনা করেন যার ফলে মাদক সংক্রান্ত অপরাধের কারণে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামীর সংখ্যা হ্রাস পায়। তারপরেও চীনের বাইরে ইরানেই সবচেয়ে বেশি সংখ্যক মানুষের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হচ্ছে। এছাড়াও গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগে বহু ব্যক্তির বিরুদ্ধে বিচারকার্য অব্যাহত রেখেছে বিচার বিভাগ। তাদের মধ্যে রয়েছে অনেক ইরানি নাগরিক যাদের দ্বৈত নাগরিকত্ব রয়েছে কিম্বা যাদের স্থায়ীভাবে বিদেশে বসবাসের অনুমোদন রয়েছে। একই সাথে নিরাপত্তা বাহিনীকে সাথে নিয়ে ভিন্নমতাবলম্বীদের বিরুদ্ধেও তাদের কাজ অব্যাহত রয়েছে।

রাইসির মানবাধিকার রেকর্ডের ওপর ভিত্তি করে যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ২০১৯ সালে তার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিলেন। তার বিরুদ্ধে ২০০৯ সালের বিরোধপূর্ণ প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের পর সরকারবিরোধী গ্রিন মুভমেন্ট আন্দোলন সহিংস উপায় দমন করার অভিযোগ আনা হয়েছিল। একই সাথে যেসব ব্যক্তিকে তাদের অল্প বয়সে করা কথিত অপরাধের কারণে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে সেবিষয়েও দৃষ্টি না দেওয়ার অভিযোগ আনা হয়েছে তার বিরুদ্ধে।

রাইসি যখন ২০২১ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার কথা ঘোষণা করেন, তখন তিনি ঘোষণা করেন যে তিনি নিরপেক্ষভাবে নির্বাচনে দাঁড়িয়েছেন এবং দারিদ্র, দুর্নীতি ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে তিনি লড়াই করবেন। একই সাথে তিনি বলেন যারা দেশটি পরিচালনা করেন তাদের মধ্যেও তিনি পরিবর্তন আনবেন। নির্বাচনে অংশ নেওয়ার ব্যাপারে বেশ কয়েকজন প্রখ্যাত মধ্য ও সংস্কারপন্থী প্রার্থীকে অযোগ্য ঘোষণা করে কট্টর গার্ডিয়ান কাউন্সিল। এই সিদ্ধান্ত নিয়েও প্রচুর সমালোচনা হয়েছে।

ভিন্নমতাবলম্বী এবং সংস্কারপন্থী অনেকেই ভোটারদের আহবান জানিয়েছিলেন নির্বাচন বয়কট করার জন্য। তারা অভিযোগ করেন যে সবকিছু এমনভাবে সাজানো হয়েছে যাতে রাইসিকে বড় ধরনের প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুখে পড়তে না হয়। পরে নির্বাচনে তিনি বিপুল ভোটে জয়ী হন। প্রথম দফার ভোটেই তিনি পেয়েছেন ৬২% ভোট। তবে নির্বাচনে ভোট পড়ার হার ছিল খুবই কম, ৪৯% -এর নিচে। ১৯৭৯ সালের বিপ্লবের পর কোনো প্রেসিডেন্ট নির্বাচনেই এতো কম ভোট পড়েনি।

রাইসির ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে খুব কমই জানা যায়। তার স্ত্রী জামিলেহ তেহরানে শহীদ বেহেশতি বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক। তাদের দুই কন্যা। তার শ্বশুড় আরেক কট্টর ধর্মীয় নেতা- আয়াতোল্লাহ আহমাদ আলামোলহোদা। মাশহাদ শহরে শুক্রবারের জুম্মার নামাজে নেতৃত্ব দেন তিনি।
সূত্র : বিবিসি বাংলা
এসএ/
 


Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি