ঢাকা, শুক্রবার   ১৫ নভেম্বর ২০২৪

তালেবানের দখলের মুহূর্তে যেভাবে কাবুল ছেড়ে আসেন এক নারী

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ০৯:১৬, ১৭ আগস্ট ২০২১ | আপডেট: ০৯:৪৪, ১৭ আগস্ট ২০২১

তালেবানরা কাবুলের নিয়ন্ত্রণ নেয়ার পর আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছে পুরো আফগানিস্তান জুড়ে। মানুষ আফগানিস্তান ছাড়ার জন্য হামিদ কারজাই আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ভিড় করেন। এক ফ্লাইটে হাজার মানুষ ওঠার চেষ্টা করেন। কেউ কেউ বিমানের ছাদে ও চাকায় অবস্থানও নেন। এক ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে দেশটির এয়ারপোর্টে। এই আতঙ্ক অবস্থার মধ্যে কাবুল ছেড়ে আসেন এক নারী।

মার্কিন একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার হয়ে গত কয়েক বছর ধরে আফগানিস্তানে কর্মরত ছিলেন সোহিনী সরকার। সে দেশে চলমান সংঘাতের আঁচ থেকে কীভাবে বেসামরিক মানুষজনকে রক্ষা করা যায় (কনফ্লিক্ট মিটিগেশন) তা নিয়েই দীর্ঘদিন ধরেই কাজ করছেন তিনি। রোববার (১৫ অগাস্ট) তালেবানের হাতে কাবুলের পতনের দিনেই তিনি এয়ার ইন্ডিয়ার শেষ বিমানে রাতে দিল্লিতে এসে নামেন। 

সোহিনী কিভাবে কাবুল ছেড়ে আসলেন এবং সেখানে শেষ কয়েক ঘন্টার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা তার নিজের বয়ানেই জানা যাক-

“১৫ আগস্ট যে দিল্লি ফিরব সেটা জানা ছিল দিন কয়েক আগে থেকেই। টিকিটও বুক করা ছিল আগেই, কিন্তু সেদিনই যে তালেবান শহরটা দখল করে নেবে তা ঘুণাক্ষরেও আঁচ করতে পারিনি। রোববার সকালেই বজ্রপাতের মতো খবর এলো তালেবান নাকি পিডি-ফাইভে ঢুকে পড়েছে। সে এলাকাটা আমাদের অফিসের বেশ কাছেই। পুরো কাবুল শহরটা ‘পুলিশ ডিস্ট্রিক্ট' বা পিডি-তে ভাগ করা, তার মধ্যে পাঁচ নম্বরটা আমাদের সবচেয়ে কাছে। আর তালেবান রাজধানীতে প্রবেশ করে সেই পথেই।

বিকেলে ফেরার ফ্লাইট থাকলেও জরুরি কিছু কাজকর্ম সারতে রোববার সকালেও অফিসে গিয়েছিলাম। স্থানীয় কর্মীরাও যথারীতি কাজে এসেছিলেন, এর মধ্যে তালেবানের ঢুকে পড়ার খবর আসতেই স্টাফদের তড়িঘড়ি বাড়ি ফেরার নির্দেশ দেওয়া হল। আমাদের জনাকয়েক কর্মী টাকাপয়সা তুলতে ব্যাঙ্কেও গিয়েছিলেন। তারা এসে খবর দিলেন, সব ব্যাঙ্কেই নাকি টাকা ফুরিয়ে গেছে। এমনকি এটিএম বা ব্রাঞ্চ থেকে কোনও টাকা তোলাই যাচ্ছে না।

ঠিক তখন থেকেই দেখলাম সবার মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ছে, ভয়ে সবার মুখ শুকিয়ে আসছে।

আফগানিস্তান ছাড়ার জন্য হামিদ কারজাই আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে মানুষের ভিড়

এর মধ্যেই মার্কিন দূতাবাস থেকে আমাদের কাছে নির্দেশ এল, স্টেশন ছাড়ার আগে সমস্ত সেন্সিটিভ ডকুমেন্টস, কর্মীদের নামধাম-পরিচয় এইসব সরিয়ে ফেলে তাদের কাছে পাঠিয়ে দিতে হবে। সেগুলোও সারতে হল নীরবে।

একটা ভীষণ খারাপলাগা কাজ করছিল সর্বক্ষণ ... আমি প্রায় ২০০ জন স্থানীয় আফগানের সঙ্গে এতদিন কাজ করছি, তাদের একটা প্রবল বিপদের মধ্যে রেখেই আমাকে চলে যেতে হচ্ছে। অথচ তারা চাইলেও এখান থেকে চলে যেতে পারছেন না।

কাবুলের বাসিন্দাদের মধ্যে অনেকেই ভারতে ফিরতে আগ্রহী ছিলেন, কিন্তু ততক্ষণে ভারতও ভিসা দেওয়ার প্রক্রিয়া বন্ধ করে দিয়েছে। আর আমরা রোববার রাতে যখন কাবুল ছাড়ছি, তখন ভারতের দূতাবাস কার্যত বন্ধই বলা চলে।

এসবের মধ্যেই অবশেষে এয়ারপোর্টের দিকে রওনা দিলাম। এমনিতে আমি থাকি এয়ারপোর্টের বেশ কাছেই, মাত্র দশ মিনিটের ড্রাইভ। কিন্তু কাল সময় লাগল আধঘন্টারও বেশি। কারণ ততক্ষণে কাবুল বিমানবন্দর অভিমুখী সব রাস্তায় মারাত্মক যানজট শুরু হয়ে গেছে। কাবুল শহরের সব গাড়ি যেন গিয়ে বিমানবন্দরে ঢুকতে চাইছে।

অনেককে তো গাড়ি থেকে নেমে প্লেন ধরার জন্য স্যুটকেস নিয়ে আড়াই বা তিন কিলোমিটার পথ হাঁটতেও হয়েছে। আমার অবশ্য অতটা ভোগান্তি হয়নি। তবে এয়ারপোর্টে গিয়ে প্লেন ছাড়ার জন্য অপেক্ষা করতে হল দীর্ঘক্ষণ। বেলা পৌনে তিনটের ফ্লাইট ছাড়ল প্রায় ঘন্টা চারেক পর, দিল্লিতে এসে ল্যান্ড করলাম রাত নটার পর।

আমরা যখন কাবুল এয়ারপোর্ট ছাড়ি, তখনও বিমানবন্দরের পরিস্থিতি একেবারে হাতের বাইরে চলে যায়নি। তারপর থেকে সেখানে যে মারাত্মক হুড়োহুড়ি আর অরাজকতা শুরু হয়েছে, তা তো সবাই দেখতেই পাচ্ছেন।

কাবুল ছেড়ে আসার যন্ত্রণার মধ্যেও একটা কথা বলতে বাধ্য হচ্ছি- এই তথাকথিত নতুন তালেবানকে ভরসা করার আমি কিন্তু কোনও কারণ দেখছি না। ইদানিং নানা সংবাদমাধ্যমে লেখা হচ্ছে এই তালেবান নাকি আগের মতো নয়, তারা এখন নাকি অনেক আধুনিক, অনেক পরিশীলিত।

আমি যত আফগানের সঙ্গে কথা বলেছি, তাদের একজনও বলেনি এই তালেবানকে তারা পছন্দ করেন। বরং তারা সবাই এক বাক্যে বলেছে, এই নতুন তালেবান অনেক বেশি বিপজ্জনক এবং আধুনিক প্রযুক্তিতে সজ্জিত বলে তাদের ভয় পাওয়ার আরও বেশি কারণ আছে। তারা এখন অনেক বেশি নৃশংস।

বিমানে ওঠার হাজার মানুষের লড়াই

তাছাড়া তালেবানরা এখন অনেকগুলো বড় বড় শক্তিধর দেশের সমর্থনও পাচ্ছে। যে কারণে আফগান জনতার একটা বড় অংশ তারা কী করতে পারে সেটা ভেবে খুবই ভয় পাচ্ছে। বিশেষ করে আমাদের মহিলা সহকর্মীরা। যারা গত কুড়ি বছর ধরে অনেক কষ্টে পড়াশুনো করে চাকরি-বাকরি করছিল, নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে উপার্জন করছিল। তারা সবচেয়ে বেশি হতাশ!

এর মধ্যেই খবর এসেছে কান্দাহারে আঁটোসাঁটো পোশাক পরার জন্য একজন মহিলাকে তালেবান মেরে ফেলেছে।
কিংবা হেরাতের ব্যাঙ্কগুলোতে ঢুকে মহিলা কর্মীদের হুমকি দেওয়া হয়েছে এই বলে যে, ‘তোমরা ভালোয় ভালোয় বাড়ি ফিরে যাও এবং পরিবারের পুরুষদের চাকরি করতে পাঠাও।’

ফলে আফগান নারীদের শিক্ষা, কর্মসংস্থান বা মৌলিক অধিকারগুলোর ক্ষেত্রে গত দুই দশকের যে অর্জন- তার পুরোটাই এখন প্রবল হুমকির মুখে।

১৫ই আগস্টের এক বিষণ্ণ বিকেলে কাবুলে সেটাই আমার কাছে সবচেয়ে যন্ত্রণার জায়গা!” সূত্র: বিবিসি বাংলা

এএইচ/


Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি