ঢাকা, রবিবার   ২২ ডিসেম্বর ২০২৪

আফগানিস্তানের ‘নতুন বন্ধু’ রাশিয়া

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ০৯:১৩, ২২ আগস্ট ২০২১

রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন

রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন

রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন শুক্রবার বলেছেন, আফগানিস্তানের ওপর তালেবানের নিয়ন্ত্রণ কায়েম হচ্ছে একটা বাস্তবতা যাকে মেনে নিতে হবে। রুশ কূটনীতিকরা কাবুলের নতুন শাসকদের ‘সাধারণ মানুষ’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন এবং যুক্তি দেখিয়েছেন যে আফগান রাজধানী এখন আগের চাইতে নিরাপদ। এ খবর বিবিসি বাংলা’র।

অনেক বিদেশি দূতাবাসের মতো রাশিয়া কাবুলে তাদের দূতাবাস বন্ধ করেনি। তালেবান নেতাদের প্রতি তাদের বক্তব্য ছিল বেশ উষ্ণ। কাবুল দখলের ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে রুশ অ্যাম্বাসেডর দিমিত্রি ঝিরনফ তালেবানের প্রতিনিধিদের সাথে দেখা করেছেন। 

এরপর তিনি বলেছেন, তালেবান যোদ্ধারা যে কোনো ধরনের প্রতিশোধ নিচ্ছে কিংবা কোনো সহিংসতা চালাচ্ছে এমন কোন প্রমাণ তিনি দেখতে পাননি।

জাতিসংঘে মস্কোর দূত ভাসিলি নেবেনজিয়াও আফগানিস্তানে আপোষের উজ্জ্বল সম্ভাবনার কথা বলেছেন। ‘বহু বছরের রক্তপাত অবসানের’ পর সে দেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসবে বলে আশা প্রকাশ করেছেন তিনি।

আফগানিস্তানে প্রেসিডেন্ট পুতিন যাকে বিশেষ প্রতিনিধি হিসেবে পাঠিয়েছেন তার নাম জামির কাবুলফ। তিনি এমনকি একথাও বলেছেন যে, নির্বাসিত প্রেসিডেন্ট আশরাফ গানির ‘পুতুল সরকারের’ চাইতে তালেবানের সাথে দরকষাকষি করা অনেক বেশি সহজ।

গানি সম্পর্কে রাশিয়ার সরকার কোন কালক্ষেপণই করতে রাজি নয়। এ সপ্তাহেই রুশ কূটনীতিকরা দাবি করেছেন আশরাফ গানি কাবুল থেকে পালানোর সময় সাথে করে চারটি গাড়ি এবং একটি হেলিকপ্টার বোঝাই অর্থ সাথে নিয়ে গেছেন। অবশ্য এই অভিযোগকে ডাহা মিথ্যে বলে উড়িয়ে দিয়েছেন গানি।

রুশ-আফগান সম্পর্কের নতুন ধারা
রাশিয়া এই মুহূর্তেই তালেবানকে আফগানিস্তানের বৈধ শাসক হিসেবে স্বীকৃতি দিচ্ছে না। তবে তালেবানের প্রতি মস্কোর সরকারের মনোভাব বেশ নরম। রাশিয়ার সরকারি বার্তা সংস্থা টাস্ তাদের রিপোর্টে চলতি সপ্তাহ থেকে তালেবানকে বর্ণনা করতে গিয়ে ‘সন্ত্রাসবাদী’ শব্দের জায়গায় ‘কট্টরপন্থী’ শব্দটি ব্যবহার করছে।

তবে রুশ সরকার বেশ কিছুদিন ধরেই ধীরে ধীরে তালেবানের সাথে সম্পর্ক গড়ে তুলছিল। রাশিয়া যেসব দেশ ও প্রতিষ্ঠানকে সন্ত্রাসবাদী ও নিষিদ্ধ সংগঠন বলে মনে করে ২০০৩ সাল থেকে সেই তালিকার শীর্ষে ছিল তালেবান। কিন্তু তালেবানের প্রতিনিধিরা ২০১৮ সাল থেকে আলোচনার জন্য নিয়মিতভাবে মস্কোতে যাচ্ছিলেন।

এদিকে পশ্চিমা সরকারের ছত্রছায়ায় থাকা আফগানিস্তানের সাবেক সরকার রুশ প্রেসিডেন্টের প্রতিনিধিকে খোলাখুলিভাবে তালেবান সমর্থক হিসেবে বর্ণান করেছে। তারা অভিযোগ করেছে, মস্কোতে তালেবানের সাথে তিন বছরে ধরে চলা বৈঠকে আফগান সরকারের প্রতিনিধিকে যোগ দিতে দেয়া হয়নি।

তবে এই অভিযোগ কাবুলফ অস্বীকার করেন। তিনি বলেন যে, আফগান সরকার অকৃতজ্ঞ। তবে ২০১৫ সালেই তিনি বলেছিলেন, ইসলামিক স্টেট (আইএস) গোষ্ঠীর সাথে লড়াইয়ের প্রশ্নে রাশিয়া এবং তালেবানের স্বার্থ এক ও অভিন্ন।

রাশিয়া এই অভিযোগকে ‘বিভ্রান্তিকর’ বলে বর্ণনা করে নাকচ করে দিয়েছিল।

সে সময় মস্কোতে রুশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছিল যে ‘আমাদের মার্কিন সহকর্মীদের বলেছিলাম এর প্রমাণ দিতে, কিন্তু তারা তা দেয়নি… আমরা তালেবানকে কোনভাবে সমর্থন করছি না।’

চলতি বছর ফেব্রুয়ারি মাসে মি. কাবুলফ আফগান সরকারের ক্রোধের পাত্র হন যখন তিনি দোহা চুক্তি সুচারুভাবে পালন করার জন্য তালেবানের প্রশংসা করেন। অভিযোগ করেন যে কাবুলের কর্তৃপক্ষ ওই চুক্তিকে নস্যাৎ করতে চাইছে।

নজর আঞ্চলিক নিরাপত্তার দিকে
তালেবানের সাথে সখ্যতা থাকার পরও মস্কোর সরকার বাস্তবমুখী পদক্ষেপ নিচ্ছে। তারা আফগানিস্তানের ঘটনাবলীর দিকে নজর রাখছে এবং সন্ত্রাসবাদীর তালিকা থেকে তালেবানের নাম এখনই কেটে দিচ্ছে না।

প্রেসিডেন্ট পুতিন বলেছেন, তালেবান তার প্রতিশ্রুতি পালন করবে এবং আইনশৃঙ্খলার উন্নতি করবে বলে তিনি আশা করেন। ‘এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ যে (আফগানিস্তান থেকে) প্রতিবেশী দেশগুলিতে যেন সন্ত্রাসীরা ঢুকতে না পারে’ বলেন তিনি।

আফগানিস্তানের ব্যাপারে রাশিয়ার নীতিমালার গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর হচ্ছে আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা এবং সে দেশের সাথে তার নিজের ইতিহাস। মস্কো চায় মধ্য এশিয়ায় তার মিত্র দেশগুলোর সীমান্ত নিরাপদ রাখতে এবং সন্ত্রাসবাদের প্রসার ও মাদক পাচার রোধ করতে।

১১ই সেপ্টেম্বরের হামলার পর যুক্তরাষ্ট্র যখন তালেবানকে আক্রমণের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করে এবং সাবেক সোভিয়েত প্রজাতন্ত্রগুলোতে ঘাঁটি তৈরি করে, প্রথমদিকে তাকে স্বাগত জানায় রাশিয়া। কিন্তু তারপর রুশ-মার্কিন সম্পর্কে ফাঁটল ধরে।

চলতি মাসের গোঁড়ার দিকে রাশিয়া উজবেকিস্তান এবং তাজিকিস্তানে সামরিক মহড়া চালায়। লক্ষ্য ছিল মধ্য এশিয়ায় তাদের মিত্র দেশগুলোকে আশ্বস্ত করা। গতমাসে মস্কোর সরকার তালেবানের কাছে প্রতিশ্রুতি আদায় করে যে, আফগানিস্তানে দখল কায়েম করার পর তা কোনভাবেই রাশিয়ার মিত্র দেশগুলোর জন্য হুমকি সৃষ্টি করবে না। সেই সঙ্গে তালেবান আইএস-এর বিরুদ্ধে লড়াই অব্যাহত রাখবে।

ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কা
তালেবানের আফগানিস্তান দখল নিয়ে রাশিয়া মানসিকভাবে তৈরি ছিল, এমন একটা ধারণা দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু যে অবিশ্বাস্য দ্রুততার সাথে তালেবান কাবুল দখল করেছে তাতে অন্যান্য দেশের মতো রাশিয়াও অবাক হয়েছে বলে মনে করছেন অনেক বিশেষজ্ঞ।

‘মস্কোর কোন কৌশল নিয়েই কথা বলা যায় না’ বলছেন গবেষণা প্রতিষ্ঠান রাশিয়ান সেন্টার ফর কনটেম্পোরারি আফগান স্টাডিজের আন্দ্রেই সেরেংকো। তিনি বলছেন, অনেক সিদ্ধান্তই নেয়া হচ্ছে তাৎক্ষণিক বিবেচনায়। ‘ওই অঞ্চলের কাঠামো পরিবর্তনের প্রক্রিয়ায় যেন কোন ধরনের দেরি না হয়, সেটাই হচ্ছে মস্কোর উদ্বেগ।’

তালেবান শাসনের জেরে আফগানিস্তানের কী হাল হবে তা নিয়েও উদ্বিগ্ন মস্কোর অনেকেই।

আরেকটি কূটনৈতিক গবেষণা সংস্থা রাশিয়ান ইন্টারন্যাশনাল অ্যাফেয়ার্স কাউন্সিলের আন্দ্রেই কর্তুনফ মনে করেন, পুরো আফগানিস্তানের ওপর শাসন ব্যবস্থা কায়েম করতে গিয়ে তালেবান হিমশিম খাবে, বিশেষভাবে দেশের উত্তরাঞ্চলে। সেটা ঘটলে রাশিয়া এবং তার প্রতিবেশী দেশগুলো হুমকির মুখে পড়তে পারে।

এছাড়া আফগানিস্তানে ঘাপটি মেরে থাকা আল কায়দা কিংবা আইসিস-এর কোন গোষ্ঠী মধ্য এশিয়ায় তৎপরতা চালাতে উৎসাহ দিতে পারে। আগামীতে আফগানিস্তানের অর্থনৈতিক অবস্থা আরো খারাপ হবে বলেও তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করেন। সেটা ঘটলে ওই অঞ্চলের স্থিতিশীলতাও বিনষ্ট হতে পারে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপের সরকারগুলো যখন প্রাণান্তকর চেষ্টা চালাচ্ছে আফগানিস্তান থেকে তাদের নাগরিক এবং তাদের আফগান সহযোগীদের বের করে আনতে। তখন তালেবানের কাবুল দখল নিয়ে রাশিয়াকে খুব একটা চিন্তিত হতে দেখা যাচ্ছে না।

কিন্তু ১৯৮০’র দশকে কাবুলে একটি কমিউনিস্ট সরকার প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে নয় বছর দীর্ঘ এক বিপর্যয়কর লড়াইয়ে জড়িয়ে পড়তে হয়েছিল রাশিয়াকে। সে কথা হয়তো রুশীদের আজ মনে পড়বে না।

এএইচ/


Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি