পুতিনের কী যুদ্ধাপরাধের দায়ে বিচার সম্ভব?
প্রকাশিত : ২২:০৯, ১১ মার্চ ২০২২
ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি মারিউপোলের শিশু ও প্রসূতি হাসপাতালে রাশিয়ার হামলাকে বর্ণনা করেছেন যুদ্ধাপরাধ হিসেবে।
যদি তা না-ও হয় - তবুও সব যুদ্ধেরই কিছু নিয়ম-কানুন আছে, বলে চলেছে ইন্টারন্যাশনাল কমিটি অফ দা রেডক্রস, সংক্ষেপে যা রেডক্রস হিসেবেই বিশ্বব্যাপী সুপরিচিত।
জেনেভা কনভেনশন নামে পরিচিত বিভিন্ন চুক্তির মধ্যে এবং নানা আন্তর্জাতিক আইন ও সমঝোতার মধ্যেই এসব নিয়ম-কানুন নিহিত আছে।
মারিউপোলে শহরের একটি শিশু ও প্রসূতি হাসপাতালে গত বুধবার এই হামলা চালিয়েছিলো রাশিয়া - যার তীব্র নিন্দা করেছে জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়। এরপর জেলেনস্কি একে যুদ্ধাপরাধ বলে অভিহিত করেন।
গত ২৪ শে ফেব্রুয়ারি রাশিয়া ইউক্রেনে হামলা শুরু করে এবং জবাবে পশ্চিমা বিশ্ব নজিরবিহীন নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে দেশটির ওপর।
যুদ্ধাপরাধ বলতে কী বোঝায়?
বেসামরিক নাগরিকদের ওপর ইচ্ছাকৃত হামলা করা যাবে না- এমনকি এমন কোন অবকাঠামোতেও হামলা করা যাবে না যা তাদের বেঁচে থাকার জন্য অপরিহার্য। কিছু অস্ত্রও নিষিদ্ধ, কারণ এসব অস্ত্র ব্যবহার করলে সবাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। যেমন অ্যান্টি-পার্সোনেল ল্যান্ডমাইন, কেমিক্যাল ও বায়োলজিক্যাল অস্ত্র।
অসুস্থ বা আহতকে অবশ্যই সেবা দিতে হবে। এর মধ্যে অসুস্থ সেনারাও থাকবেন, যাদের যুদ্ধবন্দী হিসেবে অধিকার হবে।
আরও কিছু আইন আছে যেগুলোতে নির্যাতন বা একটি গোষ্ঠীকে ধ্বংস করতে চালানো গণহত্যাকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
ইউক্রেনে যুদ্ধাপরাধের কী কী অভিযোগ আছে
ইউক্রেন বলছে, শিশু ও প্রসূতি হাসপাতালে রাশিয়া যে হামলা চালিয়েছে তা যুদ্ধাপরাধ। এ ঘটনায় তিন জন নিহত হয়েছে আর হাসপাতালের ১৭ জন কর্মী ও রোগী আহত হয়েছে।
এছাড়া রাশিয়ান সৈন্যরা পলায়নরত ইউক্রেনিয়ান বেসামরিক নাগরিকদের লক্ষ্যবস্তু করেছে - এমন খবরও পাওয়া গেছে। এছাড়া খারকিভ শহরে বেসামরিক এলাকায় ক্লাস্টার বোমা নিক্ষেপেরও প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে।
তবে ইউক্রেন বা রাশিয়া কেউ এ ধরণের অস্ত্র ব্যবহারের ওপর নিষেধাজ্ঞায় স্বাক্ষর করেনি। তা সত্ত্বেও এসব ঘটনাগুলো যুদ্ধাপরাধ হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে।
যুক্তরাজ্যের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় বলছে রাশিয়া ভ্যাকিউম বা থারমোব্যারিক বোমা ব্যবহার করেছে। বলা হয়, বিস্ফোরক দিয়ে তৈরি বোমার চেয়েও মারাত্মক বিধ্বংসী এই ভ্যাকিউম বোমা।
এই বোমা দুই ধাপে কাজ করে। প্রথম ধাপের বিস্ফোরণে মেঘের মতো বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে জ্বালানি তেল।দ্বিতীয় ধাপ হচ্ছে, এই জ্বালানি তেলের মেঘ আবার বিস্ফোরিত হয়ে আগুনের গোলার মতো তৈরি হয়, বড় ধরনের শক ওয়েভ বা শব্দ তরঙ্গের ধাক্কা তৈরি করে এবং আশপাশের সব অক্সিজেন শুষে নেয়।
অনেক বিশ্লেষক মনে করেন ইউক্রেনে আগ্রাসনটাই একটা অপরাধ।
সন্দেহভাজন যুদ্ধাপরাধীর বিচার সম্ভব?
প্রত্যেক দেশেরই দায়িত্ব আছে কোন কর্মকাণ্ড যুদ্ধাপরাধ বলে সন্দেহ হলে তার তদন্ত করা। যুক্তরাজ্যে সিনিয়র পুলিশ কর্মকর্তারা প্রমাণ সংগ্রহসহ এ বিষয়ে সহায়তার প্রস্তাব দিয়েছে ইউক্রেনকে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে অনেকগুলো কোর্ট হয়েছে। এর মধ্যে আছে যুগোস্লাভিয়া ভাঙনের পর গঠন করা ট্রাইব্যুনাল ফর ওয়ার ক্রাইমস। রুয়ান্ডায় গণহত্যার দায়ে জড়িতদের বিচারের জন্যও একটি সংস্থা গঠিত হয়েছিলো।
এখন দি ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল কোর্ট (আইসিসি) এবং দি ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অফ জাস্টিস (আইসিজে) যুদ্ধের নিয়মাবলী সমুন্নত রাখতে সক্রিয়। আইসিজে বিবদমান রাষ্ট্রগুলোকে নিয়ে কাজ করে। তারা কোন ব্যক্তির বিচার করতে পারে না।
ইউক্রেন সেখানে আগ্রাসনের দায়ে রাশিয়ার বিরুদ্ধে মামলার কাজ শুরু করেছে। আইসিজের রুল বা নির্দেশ যদি রাশিয়ার বিপক্ষে যায় তাহলে সেই নির্দেশনা কার্যকরের দায় বর্তাবে নিরাপত্তা পরিষদের ওপর।
কিন্তু রাশিয়া নিজেই নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য। তারা সেখানে ভেটো দিতে পারে।
আর আইসিসি সাধারণত গণহত্যা, যুদ্ধাপরাধ, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ ইত্যাদি অপরাধের জন্য দায়ীদের অভিযুক্ত করে থাকে। এর একটি উদাহরণ নুরেমবার্গ ট্রায়াল।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় হিটলারের বাহিনী পরিকল্পিতভাবে যে ভয়ংকর গণহত্যা চালিয়েছিল, তার মূল নায়কদেরই মূলত নুরেমবার্গ ট্রাইব্যুনালে বিচারের আওতায় আনা হয়। বিশ্বের ইতিহাসে এত বড় আকারে যুদ্ধাপরাধের বিচার ছিলো এই প্রথম।
আইসিসি কী ইউক্রেনে অপরাধের বিচার করতে পারবে?
আইসিসির চীফ প্রসিকিউটর ব্রিটিশ আইনজীবী করিম খান কিউসি। তিনি বলেছেন যে ইউক্রেনে যুদ্ধাপরাধ হচ্ছে এটা মনে করার অনেক যুক্তিসঙ্গত কারণ আছে এবং সেটি তদন্তের অনুমতি তার আছে।
তদন্তে দেখা হবে অতীত ও বর্তমান অভিযোগ। যেটি যেতে পারে ২০১৩ সালের রাশিয়ার ক্রাইমিয়া দখল পর্যন্ত।
সেখানে যদি কোন ব্যক্তির বিরুদ্ধে অভিযোগের প্রমাণ মেলে তাহলে প্রসিকিউটর আইসিসির বিচারকদের দি হেগের আদালতে তাদের বিচারের জন্য গ্রেফতারি পরোয়ানা জারীর জন্য আবেদন করতে পারবেন।
এখানেই কোর্টের সীমাবদ্ধতার বিষয়টি আছে। কারণ কোর্টের কোন নিজস্ব পুলিশ নেই। গ্রেফতারের জন্য সংশ্লিষ্ট দেশের পুলিশের ওপর নির্ভর করতে হয়। কিন্তু রাশিয়া এই আদালতের সদস্য নয়। ২০১৬ সালে তারা সরে দাঁড়ায়। ভ্লাদিমির পুতিন কাউকে প্রত্যর্পণ করবেন না।
প্রেসিডেন্ট পুতিন ও অন্য নেতাদের বিচার সম্ভব?
যুদ্ধের যেসব সৈন্য অপরাধ করেন তাদের চিহ্নিত করা যত সহজ ততটাই কঠিন যেসব নেতাদের নির্দেশে তারা এটা করেন তাদের অভিযুক্ত করা। কিন্তু আইসিসি যুদ্ধ চাপিয়ে দেয়ার বিষয়টিকে অপরাধ হিসেবে আমলে নিতে পারে।
এটা নুরেমবার্গ থেকেই এসেছে। যেখানে মস্কো মনোনীত বিচারক মনে করেছিলেন যে নাৎসি নেতাদের বিচার হওয়া উচিত শান্তির বিরুদ্ধে অপরাধের দায়ে।
তবে আন্তর্জাতিক আইনের বিশ্লেষক প্রফেসর ফিলিপ স্যান্ডস বলেছেন, রাশিয়া এ আদালতের সিগনেটরি না হওয়ায় আইসিসি রাশিয়ার নেতাদের বিচার করতে পারবে না।
তাত্ত্বিকভাবে, নিরাপত্তা পরিষদ আইসিসিকে তদন্তের জন্য বলতে পারে। কিন্তু স্থায়ী সদস্য হিসেবে রাশিয়া তাতে ভেটোও দিতে পারে।
তাহলে বিচারের অন্য কোন পথ আছে?
আইসিসির কার্যকারিতা বা আন্তর্জাতিক আইনের প্রয়োগ শুধু চুক্তির ওপর নির্ভর করে না। বরং এখানে রাজনীতি ও কূটনীতির ব্যাপার আছে। সে কারণেই অনেকে মনে করেন নুরেমবার্গের মতো এখানে সমাধান নিহিত কূটনীতি ও আন্তর্জাতিক চুক্তির মধ্যে।
তারা ইউক্রেনে আগ্রাসনের অপরাধের বিচারের জন্য ট্রাইব্যুনাল প্রতিষ্ঠার জন্য বিশ্ব নেতাদের প্রতি আহবানও জানিয়েছেন। সূত্র: বিবিসি
এসি
আরও পড়ুন