যুদ্ধের এক মাস: কী পেল রাশিয়া, কী হারালো ইউক্রেন?
প্রকাশিত : ০৯:০১, ২৪ মার্চ ২০২২ | আপডেট: ০৯:১৪, ২৪ মার্চ ২০২২
শুধু রাশিয়াই নয়, বিশ্বের অনেক দেশই ভেবেছিল, রুশ সশস্ত্র বাহিনী যুদ্ধের প্রথম সপ্তাহেই একটি ভয়াবহ আক্রমণের মাধ্যমে ইউক্রেনের দখল নিয়ে ফেলবে। যদিও বাস্তবে তা হয়নি। যে কারণে যুদ্ধের সপ্তাহ পেরোতেই ইউক্রেনের শহরগুলিতে বোমাবর্ষণের কৌশল পরিবর্তন করে রুশ বাহিনী।এরপরেই হামলা হয় হাসপাতাল, গির্জা এবং আবাসনসহ বেসামরিক স্থাপনায়। আর এই আচরণের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের কাছে "যুদ্ধাপরাধী"র বলে পায় পুতিন বাহিনী।
টানা এক মাস হামলা চলে, পাল্টা প্রতিরোধ করে ইউক্রেন সেনাবাহিনী। তাতেও অবশ্য ইউক্রেনের বড় কোনও শহর দখলে নিতে পারেনি রাশিয়া। একমাত্র খেরসন শহরের পতন হয়েছে।
মারিউপোল ও খারকিভ শহর দখলের জন্য রুশ বাহিনী সেখানে তাদের গোলাবর্ষণ চালিয়েই যাচ্ছে। এতে একবারে বিধ্বস্ত হয়ে পড়েছে এই শহরদুটি, তবে এখনও তা বেদখল হয়নি।
ইউক্রেনের কর্মকর্তাদের মতে, অবরুদ্ধ দক্ষিণের বন্দর শহর মারিউপোল সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, কয়েক সপ্তাহের বোমাবর্ষণে অন্তত দুই হাজার ৩০০ লোক নিহত হয়েছে এবং বেশিরভাগ শহর ধ্বংস হয়েছে।
প্রায় এক লাখ বেসামরিক নাগরিক পানি, বিদ্যুৎ এবং খাবারের সরবরাহ ছাড়াই শহরে আটকা পড়ে আছে।
রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ২৪শে ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে সামরিক অভিযান চালানোর নির্দেশ দেওয়ার পর রুশ সৈন্যরা প্রতিবেশি দেশটির ভেতরে ঢুকে পড়ে।
জার্মানির চ্যান্সেলর ওলাফ শোলৎস জার্মান পার্লামেন্ট বুন্দেসটাগে বলেছেন, চার সপ্তাহে ইউক্রেনে রাশিয়ার অভিযান স্থবির হয়ে পড়েছে।
যুদ্ধ বন্ধ করার জন্য তিনি প্রেসিডেন্ট পুতিনের প্রতি আহবান জানান এবং বলেন যে ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে রাশিয়ার ভবিষ্যত ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
এর আগে আমিরকা এবং ইউক্রেনের সামরিক বাহিনীর পক্ষ থেকেও বলা হয়েছে রসদপত্রের সঙ্কটের কারণে রাশিয়ার অভিযান মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
যুদ্ধের এক মাসের মাথায় এসে সংবাদদাতারা বলছেন, ইউক্রেনের সৈন্যরা কোথাও কোথাও রুশ বাহিনীর ওপর পাল্টা হামলা চালাচ্ছে এবং খবরে বলা হচ্ছে যে রাজধানী কিয়েভের কাছে কিছু এলাকায় তারা পুনরায় নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছে।
কিয়েভের পশ্চিমে মাকারিভ শহরের স্থানীয় কর্তৃপক্ষ বলছে ওই শহরে তারা আবারও ইউক্রেনের পতাকা উড়াতে সক্ষম হয়েছে।
একজন ব্রিটিশ প্রতিরক্ষা বিশ্লেষক বিবিসিকে বলেছেন, ইউক্রেনের এই পাল্টা লড়াই-এর শক্তির কারণে রাশিয়া তার রণকৌশল পরিবর্তন করতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা বিভাগের একজন মুখপাত্রও বলেছেন যে দেশটির দক্ষিণের কিছু কিছু অংশে ইউক্রেনের সৈন্যরা যুদ্ধক্ষেত্রের গতি উল্টো দিকে ঘুরিয়ে দিচ্ছে।
দক্ষিণের ছোট্ট একটি শহর ভজনেসেন্সকে ইউক্রেনের সৈন্য ও স্বেচ্ছাসেবীরা রাশিয়ার সাঁজোয়া বহর ধ্বংস করে তাদেরকে পিছু হটতে বাধ্য করেছে।
ক্রিমিয়ার কাছে যে খেরসন শহরটি যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর সর্বপ্রথম রাশিয়ার দখলে চলে গিয়েছিল সেটি ফিরে পাওয়ার জন্য ইউক্রেনের সৈন্যরা তুমুল লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে।
তবে ব্রিটিশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের বিশ্লেষণে বলা হচ্ছে রাশিয়ার সৈন্যরা এখন উত্তর থেকে দক্ষিণ দিকে অগ্রসর হচ্ছে "দেশটির পূর্বাঞ্চলে ইউক্রেনের বাহিনীকে ঘিরে ফেলার উদ্দেশ্যে।"
প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের নোটে বলা হয়েছে, "পুনরায় বড় ধরনের আক্রমণ শুরু করার আগে রুশ সৈন্যরা সম্ভবত পুনর্সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা করছে।"
যুদ্ধের মৃতের সংখ্যা স্পষ্ট নয়, তবে ইউক্রেনের রাষ্ট্রপতি ভলোদিমির জেলেনস্কি বলেছেন যে কমপক্ষে ১২১ ইউক্রেনীয় শিশু সহ হাজার হাজার মানুষ নিহত হয়েছে।
ইউক্রেন বলেছে যে তারা ১৪হাজার রুশ সৈন্যকে হত্যা করেছে এবং শত শত ট্যাংক, সাঁজোয়া যান, আর্টিলারি এবং বিমান ধ্বংস করেছে।
যুক্তরাজ্যে প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা বিষয়ক একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান রুসির একজন বিশ্লেষক জাস্টিন ব্রঙ্ক বলেছেন, রাশিয়ার সৈন্যরা অগ্রসর হতে না পারার কারণেই তারা এর ক্ষতিপূরণ দিচ্ছে।
"দৃশ্যত রাশিয়ার সৈন্যরা ইউক্রেনের বিভিন্ন অংশে অগ্রসর হতে ব্যর্থ হয়েছে। এখন তারা তাদের রসদ ফিরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে এবং দক্ষিণের মারিউপোল শহরের চারপাশে তাদের শক্তিকে সংহত করার চেষ্টা করছে," বলেন তিনি।
তিনি বলেন, রাশিয়া যদি মারিউপোল দখল করে নিতে পারে, তার পরে তারা তাদের সৈন্য ও যুদ্ধাস্ত্র নতুন করে বিন্যস্ত করবে। প্রথমত সেটা হবে ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলীয় দনবাস অঞ্চলে এবং তার পরে সম্ভবত উত্তর-পূবের খারকিভ শহরে।
তবে বিশ্লেষকরা বলছেন ইউক্রেনের সৈন্যরা যেহেতু কিয়েভের কাছের শহর ইরপিন ও মাকারিভ থেকে রুশ সৈন্যদের হটিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছে, সেকারণে রাজধানী কিয়েভ দখলে মস্কোর পরিকল্পনা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
তিনি বলেন, "ইউক্রেনের সৈন্যরা চেষ্টা করছে রুশ সৈন্যরা যাতে কিয়েভকে ঘিরে ফেলতে না পারে।"
যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা দপ্তর পেন্টাগনও বলছে, রুশ সৈন্যরা যেসব জায়গা সম্প্রতি দখল করে নিয়েছিল সেসব জায়গা থেকে তাদেরকে হটিয়ে দিয়েছে।
জাতিসংঘ বলছে এই যুদ্ধের কারণে ৩.৬ মিলিয়নেরও বেশি ইউক্রেনীয় এখন দেশ ছেড়ে পালিয়েছে এবং আরও ৬.৫ মিলিয়ন মানুষ ইউক্রেনের মধ্যে বাস্তুচ্যুত হয়েছে। এই যুদ্ধ বিশ্বব্যাপী অর্থনীতি এবং ভূ-রাজনৈতিক ব্যবস্থাকেও বিপর্যস্ত করেছে।
এসবি/
আরও পড়ুন