ঢাকা, মঙ্গলবার   ০৫ নভেম্বর ২০২৪

রাজাপাকসে পরিবারের কেন এই পতন?

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ১৭:৫৬, ১০ জুলাই ২০২২

খাদ্য ও জ্বালানির তীব্র সংকট, কয়েক মাস দীর্ঘ ব্ল্যাকআউট আর মারাত্মক মন্দার কারণ মুদ্রাস্ফীতিতে বেসামাল শ্রীলঙ্কা। অথচ যারা একসময় ছিলেন নাগরিকদের চোখে নায়ক, তাদের হাতেই তো ছিল দেশ চালানোর ভার। কী এমন হলো যে ক্ষমতায় থাকা সেই রাজাপাকসে পরিবার রীতিমত খলনায়কে পরিণত হলো? 

লঙ্কানদের অভিযোগ, দেশকে চরম এই সংকেটর মুখে ঠেলে দিয়েছেন দুই ভাই গোতাবায়া রাজাপাকসে ও মাহিন্দা রাজাপাকসে। এর মধ্যে শেষেরজন বিক্ষোভের মুখে প্রধানমন্ত্রিত্ব ছেড়েছেন কিছুদিন আগে। আর তার ভাই প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া শনিবার জনরোষের মুখে বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে প্রাণ বাঁচিয়েছেন। শেষ পর্যন্ত তিনিও পদত্যাগে রাজি হয়েছেন। পদ ছাড়তে চেয়েছেন প্রধানমন্ত্রী রনিল বিক্রমাসিংহে।   

রাজাপাকসে পরিবারের রাজনৈতিক ঐতিহ্য বেশ পুরনো। গোতাবায়া ও মাহিন্দার বাবা ডন আলউইন রাজাপাকসে ছিলেন শ্রীলঙ্কা ফ্রিডম পার্টির (এসএলএলপি) প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। তিনি দুই বারের সংসদ সদস্য ছিলেন। 

১৯৯৪ সালে চন্দ্রিকা কুমারাতুঙ্গা এসএলএলপির দায়িত্ব নেন। কুমারাতুঙ্গার দুই মেয়াদে প্রেসিডেন্ট থাকাকালে মাহিন্দা রাজাপাকসে ক্যাবিনেট মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। কুমারাতুঙ্গা রাজনীতি ছাড়ার পর ২০০৫ সালে মাহিন্দা প্রেসিডেন্ট হন।

তামিল বিদ্রোহীদের নির্মমভাবে দমন করে এক সময় সিংহলীদের কাছে নায়ক থেকে মহানায়ক হয়ে উঠেছিলেন গোতাবায়া ও তার বড় ভাই মাহিন্দা রাজাপাকসে। 

মাহিন্দা রাজনীতিতে আধিপত্য বজায় রেখেছিলেন প্রায় ২০ বছর। অন্যদিকে দুই দশক সেই বাহিনীতে কাজ করে লেফটেন্যান্ট কর্নেল হয়ে তারপর স্বেচ্ছা অবসর নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে থিতু হয়েছিলেন গোতাবায়া। ২০০৫ সালে সেখানকার পাট চুকিয়ে দেশে ফিরে রাজনীতিতে নাম লেখান। ভাইয়ের অধীনে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব হিসেবে কাজে যোগ দেন তিনি। এ সময় লিবারেশন টাইগার্স অব তামিল এলাম (এলটিটিই) দমনের ভার নিজের হাতে নেন গোতাবায়া।

জাতিসংঘের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এলটিটিইর সাথে শেষ কয়েক মাসের সংঘাতে ৪০ হাজার বেসামরিক তামিল নাগরিককে লংকান সেনাবাহিনী হত্যা করেছিল। বিদ্রোহ দমন করে সিংহলীদের কাছে বীর বনে যান গোতাবায়া। সিংহলী বৌদ্ধদের বিপুল সমর্থন নিয়ে মাহিন্দা ২০১০ সালে দ্বিতীয় মেয়াদে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন।

সে সময় রাজাপাকসে পরিবারের অন্য সদস্যদের সরকারের বিভিন্ন পদে আনা হয় এবং এজন্য মাহিন্দা বড় ধরনের দুর্নীতির আশ্রয় নেন বলে অভিযোগ রয়েছে।

২০১৫ সালে মাহিন্দা তৃতীয়বার প্রেসিডেন্ট পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে সংবিধান পরিবর্তন করেন এবং দ্রুত নির্বাচন আহ্বান করেন। কিন্তু তিনি মাইথ্রিপালা সিরিসেনার কাছে পরাজিত হন। পরে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার চেষ্টাও করেছিলেন মাহিন্দা রাজাপাকসে। 

২০১৯ সালের ইস্টার সানডেতে দেশটির খ্রিস্টান গির্জা এবং বিলাসবহুল হোটেল হামলার ঘটনা রাজাপাকসে ভাইদের জন্য শাপে-বর হয়ে আসে। শেষ পর্যন্ত সিরিসেনা সরকারকে উল্টে দিয়ে গোতাবায়া সেই বছরের শেষের দিকে প্রেসিডেন্ট হয়েই ভাই মাহিন্দাকে প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত করেন এবং তার মন্ত্রিসভায় আরও দুই ভাই চামাল ও বেসিল এবং এক ভাইয়ের ছেলেকে যুক্ত করেন।

২০২০ সালে গোতাবায়া সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে তার অফিসের ক্ষমতা বাড়ান। কিন্তু তখনই শ্রীলঙ্কা অর্থনৈতিক মন্দার মধ্যে ছিল। এরপর কোভিড মহামারির কারণে পর্যটন খাতের পতন এবং কিছু অবকাঠামো প্রকল্পে বিদেশি ঋণের কারণে দেশটির অর্থনীতি আরও ভেঙে পড়ে।

২০২১ সালের এপ্রিলে রাসায়নিক সার আমদানির ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা বাতিল করতে বাধ্য হন গোতাবায়া। ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে বিশ্বব্যাপী খাদ্য ও তেলের দাম বাড়তে থাকায় সমস্যাগুলো আরও প্রকট হয়ে উঠে। দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলছে, এপ্রিলে মূল্যস্ফীতি ছিল ৩০ শতাংশ এবং খাদ্যপণ্যের দাম বেড়েছে প্রায় ৫০ শতাংশ।

পতনের শুরু যেভাবে
চলতি বছরের ১ এপ্রিল অস্থায়ী জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা হয়। বিক্ষোভের পর সন্দেহভাজনদের গ্রেপ্তার এবং আটক করতে নিরাপত্তা বাহিনীকে ব্যাপক ক্ষমতা দেওয়া হয়।

শ্রীলঙ্কার মন্ত্রিসভার প্রায় সবাই ৩ এপ্রিল রাতে পদত্যাগ করলে গোতাবায়া ও মাহিন্দা একা হয়ে পড়েন। 

৫ এপ্রিল অর্থমন্ত্রী আলি সাবরিকে নিযুক্ত করার মাত্র একদিন পরে পদত্যাগ করলে পার্লামেন্টে সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারান গোতাবায়া। পরে তিনি জরুরি অবস্থা তুলে নেন।

১০ এপ্রিল শ্রীলঙ্কার চিকিৎসকরা দেশটিতে জীবন রক্ষাকারী ওষুধের মজুদ শেষ হওয়ার কথা জানান। শ্রীলঙ্কা সরকার নিজেদের 'শেষ অবলম্বন' হিসেবে ৫১ বিলিয়ন ডলারের বৈদেশিক ঋণ খেলাপির ঘোষণা দেয় ১২ এপ্রিল।

জনবিক্ষোভে প্রথম প্রাণহানি ঘটে ১৯ এপ্রিল। এদিন পুলিশের হামলায় একজন বিক্ষোভকারী নিহত হন। 

এরপর ৯ মে দেশটির চিত্র পুরো পালে্ট যায়। ওইদিন কলম্বোতে রাষ্ট্রপতির কার্যালয়ের বাইরে শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভকারীদের ক্যাম্পে সরকার সমর্থকরা হামলা করে। পরে পাল্টা হামলায় ৯ জন নিহত এবং আরও শত শত আহত হয়। সংসদ সদস্যদের বাড়িতে আগুন দেয় বিক্ষোভকারীরা।

বিক্ষোভের মুখে ওইদিন মাহিন্দা রাজাপাকসে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করেন এবং হাজারো বিক্ষোভকারী কলম্বোতে তার বাসভবনে হামলা চালায়। পরে সেনারা তাকে উদ্ধার করে। তার স্থলাভিষিক্ত হন রনিল বিক্রমাসিংহে। 

পরিস্থিতি সামাল দিতে ১০ মে দেশটির প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় রাষ্ট্র বা জীবনের ক্ষতি হবে এমন কিছুর সঙ্গে জড়িত কাউকে দেখলেই গুলি করার নির্দেশ দেয়। কিন্তু, বিক্ষোভকারীরা সরকারের নতুন কারফিউ প্রত্যাখ্যান করেন এবং সপ্তাহের শেষে তা প্রত্যাহার করা হয়। জাতিসংঘ শ্রীলঙ্কায় ভয়াবহ মানবিক সংকটের কথা জানায় ১০ জুন। 

২৭ জুন শ্রীলঙ্কা সরকার জানায়, শ্রীলঙ্কা প্রায় জ্বালানি সরবরাহের বাইরে চলে গেছে এবং অত্যাবশ্যকীয় পরিষেবা ব্যতীত পেট্রোল বিক্রি বন্ধ ঘোষণা করা হয়।

চারদিন পর ১ জুলাই দেশটির সরকার জানায়, মুদ্রাস্ফীতি টানা নবম মাসে রেকর্ড উচ্চতায় পৌঁছেছে। এর একদিন আগে, আইএমএফ শ্রীলঙ্কাকে উচ্চমূল্য এবং ক্রমবর্ধমান মুদ্রাস্ফীতির লাগাম টানতে বলেছিল।

লঙ্কানদের ক্রমবর্ধমান ক্ষোভ চূড়ান্ত পরিণতি পায় ৯ জুলাই। এদিন বিক্ষোভকারীদের আন্দোলন মারাত্মক আকার ধারণ করে। প্রেসিডেন্ট রাজাপাকসে সেনাদের সহায়তায় কলম্বোতে তার সরকারি বাসভবন থেকে পালিয়ে যান। তাকে একটি অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে যাওয়া হয়। এদিন রাতে প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগের ঘোষণা দেন। তারপর বিক্ষোভকারীরা প্রধানমন্ত্রীর বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেন। এর কয়েক ঘণ্টা পরই দেশটির স্পিকার জানান, আগামী ১৩ জুলাই প্রেসিডেন্ট রাজাপাকসেও পদত্যাগ করবেন।
এএইচএস/


Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি