ঢাকা, সোমবার   ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪

হংকং’র আদালতে অসুস্থ অ্যাক্টিভিস্ট: ‘শহীদ হতে আমার আপত্তি নেই’

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ২১:৩৯, ১৪ জুলাই ২০২২

শেষ পর্যায়ের কোলন ক্যানসারে আক্রান্ত এক হংকং অ্যাকটিভিস্টকে ৯ মাসের কারাদণ্ড দিয়েছে দেশটির আদালত। ফেব্রুয়ারিতে বেইজিং শীতকালীন অলিম্পিক উপলক্ষে সেখানে এক প্রতিবাদ কর্মসূচীর ঘোষণা দেওয়ায় কু সেজে-ইউ নামে ওই অ্যাক্টিভিস্টকে গ্রেপ্তার করে হংকং পুলিশ, পরে তাকে ৯ মাসের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। 

এই সময়ের মধ্যে জেলে থাকাকালীনই তার মৃত্যু হতে পারে, এমন আশঙ্কা করছেন মানবাধিকার কর্মীরা।

কু প্রায়ই হাতে কাঠের কফিন তৈরি করতেন, আর সেগুলোতে চীনের কমিউনিস্ট পার্টির নিন্দা করে বার্তা দিয়ে সাজাতেন। ৭৫ বছর বয়সী কু কয়েক দশক ধরে হংকং-এর প্রতিবাদে কফিনগুলো বহন করেছিলেন এবং তিনি ফেব্রুয়ারিতে বেইজিং শীতকালীন অলিম্পিক উপলক্ষে একই কাজ করার পরিকল্পনা করেছিলেন। কিন্তু তার আগেই হংকং পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করে।

মঙ্গলবার (১২ জুলাই) কু-কে রাষ্ট্রদ্রোহের চেষ্টার জন্য দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছে এবং তাকে নয় মাসের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। কু-এর কেসটি বিশেষ উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল কারণ তিনি স্টেজ ৪ কোলন ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়েছেন। তিনি অপেক্ষাকৃত ছোট সাজা ভোগ করার সময়ও কারাগারে মারা যেতে পারেন।

কিন্তু আদালতে কু-সেজে-ইউ তার প্রতি দয়া না দেখানোর জন্য আদালতকে অনুরোধ করেছেন। সে সময় তিনি বলেন, ‘গণতন্ত্র এবং মানবাধিকারের জন্য শহীদ হতে আমার আপত্তি নেই।’ তিনি মূল ভূখণ্ডের সক্রিয় আইনজীবীদের উল্লেখ করে যারা কারাবন্দী, নির্যাতন বা অনির্দিষ্টকালের জন্য গৃহবন্দী হয়েছিলেন তাদের উল্লেখ করে আরও বলেন, ‘চীনের মানবাধিকার আইনজীবীদের সঙ্গে তুলনা করলে, আমি যা ত্যাগ করেছি তা কিছুই নয়।’

২০২০ সাল থেকে, হংকং-এর বেইজিং-সমর্থিত কর্তৃপক্ষ কয়েক মাস ধরে সরকার বিরোধী বিক্ষোভের পর, যখন তা আধা-স্বায়ত্তশাসিত চীনা শহরকে বিপর্যস্ত করে তুলেছিল, তখন ভিন্নমতকে ঠেকানোর জন্য জনগনের উপর ব্যাপক ক্র্যাকডাউন চালিয়েছে। হংকং সরকার তখন বিশিষ্ট বিরোধীদলীয় ব্যক্তিত্ব এবং প্রাক্তন আইন প্রণেতাদের পাশাপাশি প্রভাবশালী আইনজীবী এবং প্রকাশকদেরও নজরদারির ভেতর রেখেছিল। এটা কু-এর মতো তৃণমূল কর্মীদেরও বিপদে ফেলেছে।

হংকংয়ে গণতন্ত্রপন্থী বিক্ষোভ কয়েক বছর ধরে কয়েক হাজার মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। কু -এর ফেব্রুয়ারিতে পরিকল্পিত প্রতিবাদ, যার বিষয়ে তিনি স্থানীয় সংবাদ মাধ্যমকে বলেছিলেন, তুলনামূলকভাবে বেশ ছোট একটা ব্যাপার হতো। তিনি হংকংয়ে বেইজিংয়ের প্রতিনিধি অফিসের সামনে ট্রলিতে একটি কফিন ঠেলে একাই হাঁটতে চেয়েছিলেন, কফিনে লেখা ছিল- কমিউনিস্ট পার্টির এক পক্ষের একনায়কত্বের অবসান হোক এবং জাতীয় নিরাপত্তা আইন সম্পর্কে কিছু আপত্তিকর বার্তা।

এদিকে, আদালতে তার আইনজীবীরা যুক্তি দিয়েছিলেন যে, তার প্রতিবাদ পরিকল্পনায় কোনো সহিংসতা ছিল না, সেগুলোকে তাই অপরাধ হিসাবে বিবেচনা করা উচিত নয়। কু এমনকি আশেপাশের পুলিশ স্টেশন থেকেও মিছিল করতে চেয়েছিলেন যাতে অফিসারদের পক্ষে প্রতিবাদটি পর্যবেক্ষণ করা সহজ হয়, এমনটাই বলেছেন আইনজীবীরা কিন্তু সরকারী প্রসিকিউটররা যুক্তি দিয়েছিলেন যে, এই ধরনের বিক্ষোভ হংকংয়ের বাসিন্দাদের সরকারকে উৎখাত করার জন্য অবৈধ উপায় ব্যবহার করতে অনুপ্রাণিত করার জন্য একটি পরিকল্পনা হতে পারে।

তবে কু-এর সমর্থক এবং মানবাধিকার কর্মীরা বলছেন যে তার মামলাটি এটাই প্রমাণ করে যে হংকংয়ে মানুষের অধিকার কত ব্যাপকভাবে হ্রাস করা হয়েছে।

হংকংয়ের একটি বামপন্থী, গণতন্ত্রপন্থী গ্রুপ লীগ অফ সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটস-এর সেক্রেটারি জেনারেল অ্যাভেরি এনজি বলেছেন, ‘এখন এমন কিছু ধারণা রয়েছে যা আপনি আপনার স্বাধীনতা হারানো ছাড়া স্পর্শ করতে পারবেন না, এটি খুব কষ্টদায়ক। তারা যদি চতুর্থ পর্যায়ের ক্যান্সারে আক্রান্ত এই লোকটিকে জেলে পাঠায়, তাহলে আমাদের বাকিদের কী হবে? কিন্তু এটা হল নতুন বাস্তবতা যাকে হংকংকে মেনে নিতে হবে।’

অন্যদিকে, প্রিন্সিপাল ম্যাজিস্ট্রেট পিটার ল, যিনি কু-এর মামলার শুনানি করেছিলেন, তিনি জানিয়েছেন, কু অপরাধ করার সময় ইতিমধ্যেই ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়েছেন, তাই তার শাস্তির ক্ষেত্রে এটিকে যুক্ত করা হবে না।
কু সেজে ইউ কিন্তু সবসময় সরকারের সমালোচক ছিলেন না। ১৯৯৯ সালে চীনের নিয়ন্ত্রণে ফিরে আসা পর্তুগিজ উপনিবেশ ম্যাকাওতে বেড়ে ওঠা একজন যুবক হিসাবে, তিনি কমিউনিস্ট পার্টি-সংযুক্ত শ্রমিক ইউনিয়নে সক্রিয় ছিলেন এবং দেশাত্মবোধক ‘রেড সং’ শুনতে পছন্দ করতেন- এমনটাই জানিয়েছেন সাং কিন-শিং, কু’র একজন বন্ধু এবং সহকর্মী। কিন্তু চীনের কমিউনিস্ট পার্টি ১৯৮৯ সালে তিয়ানানমেন স্কোয়ারের চারপাশে গণতন্ত্রপন্থী বিক্ষোভ দমন করতে সৈন্য পাঠানোর পর, কু বেইজিংয়ের বিরুদ্ধে চলে যান।

তার প্রজন্মের অনেক বিরোধী কর্মীদের মতো, তিয়ানানমেন ক্র্যাকডাউন কু-এর রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিকে বদলে দিয়েছে। তারা ১৯৮৯ সালে নিহতদের জন্য বার্ষিক কর্মকাণ্ড পালন করেছিল, যেগুলো সাম্প্রতিক বছরগুলোতে কার্যকরভাবে নিষিদ্ধ হওয়ার আগে পর্যন্ত হংকংয়ের ভিক্টোরিয়া পার্কে কয়েক হাজার লোক অংশগ্রহণ করতো।

২০১২ সালে, তিনি টোকিও এবং বেইজিং উভয়ের দ্বারা দাবি করা পূর্ব চীন সাগরের জনবসতিহীন দ্বীপগুলিতে অবতরণকারী একদল কর্মীর একজন ছিলেন। তাদের জাপানি কোস্ট গার্ড আটক করেছিল এবং তাকে হংকংয়ে ফেরত পাঠানো হয়েছিল, যেখানে তাদের বীরের মতো স্বাগত জানানো হয়েছিল। তারা বলেছিলেন, এই বিক্ষোভ দেখানোর উদ্দেশ্য ছিল যে চীনে দেশপ্রেমের উপর কমিউনিস্ট পার্টির একচেটিয়া অধিকার নেই।

কিছু সময়ের জন্য, হংকংয়ের তরুণ কর্মীরা কু-এর প্রজন্মের কর্মীদের মতামতকে খুব একটা মূল্য দিতো না, তারা দেশের বাকি অংশের রাজনৈতিক ভাগ্যের প্রতি খুব কমই আগ্রহ প্রকাশ করতো। কিন্তু বেইজিং এই ভূখণ্ডের উপর তার ক্র্যাকডাউনকে ত্বরান্বিত করার পর থেকে এই পার্থক্যগুলি ম্লান হয়ে গেছে, বিরোধীদের আন্দোলন সংহতিকে ত্বরান্বিত করেছে।

এদিকে, কু-কে জাতীয় নিরাপত্তা আইনের অধীনে বিচার করা হয়নি, বরং একটি ঔপনিবেশিক যুগের রাষ্ট্রদ্রোহ আইনের অধীনে সাজা দেওয়া হয়েছে। বর্তমান ক্র্যাকডাউনের আগে, রাষ্ট্রদ্রোহ আইনটি সর্বশেষ ১৯৬০-এর দশকে ব্যবহৃত হয়েছিল। এর সর্বোচ্চ সম্ভাব্য সাজা কম, নিরাপত্তা আইনের অধীনে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের বিপরীতে মাত্র দুই বছরের কারাদণ্ড।

জর্জটাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর এশিয়ান ল’র এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর থমাস ই. কেলগ বলেছেন, এই ধরনের ছোট আকারের অপরাধ সরকারের সুনামকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে এবং হংকংকে একটি উন্মুক্ত, আন্তর্জাতিক শহর হিসাবে উন্নীত করার জন্য তার নতুন নেতা জন লির প্রচেষ্টাকেও ক্ষুন্ন করবে।

কেলগ আরও বলেছেন, লি প্রশাসনের পক্ষে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাউকে বোঝানো কঠিন হবে যে তারা হংকংয়ের আইনের নিরঙ্কুশ শাসন বজায় রাখার বিষয়ে মনযোগী, যখন তারা কু এবং আরও অনেক কর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা চালিয়ে যাচ্ছে।

এসি
 


Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি