বিবিসির বিশ্লেষণ
কে হচ্ছেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী
প্রকাশিত : ১৬:৩৩, ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৪
ভোটের চূড়ান্ত ফল ঘোষণার পরেও পাকিস্তানিরা এখনো জানেন না দেশটির পরবর্তী সরকার গঠন করবে কোন দল। উত্তপ্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ সাধারণ নির্বাচনের চার দিন পরেও কে হবেন দেশটির পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী তা এখনো অজানা।
সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের আটক হওয়া সত্ত্বেও এবং পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ (পিটিআই) এর ওপর চাপিয়ে দেওয়া শত বাধা সত্ত্বেও বিপুল সাফল্যের মুখ দেখেছে তার প্রার্থীরা। জাতীয় পরিষদের ২৫৬টি আসনের মধ্যে পিটিআই সমর্থিত স্বতন্ত্র প্রার্থীরা ৯৩টি আসন পেয়েছেন। এই ফলে অবাক হয়েছেন পর্যকেক্ষকরাও। যেকোনো দলের জন্যই ফলটি সংখ্যাগরিষ্ঠ। তবে সরকার গঠনের জন্য প্রয়োজনীয় শক্তিশালী ১৬৯ আসনের তুলনায় এই সংখ্যা খুবই অল্প।
সাবেক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের পাকিস্তান মুসলিম লীগ নওয়াজ (পিএমএল-এন) ৭৫টি আসন নিয়ে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে। তার দলের প্রতি দেশটির শক্তিশালী সামরিক বাহিনীর সমর্থন ছিল। অপমানজনকভাবে পাকিস্তান ত্যাগ করার পাঁচ বছর পর যখন তিনি দেশে ফিরেছেন তখনই ধারণা করা হয়েছিল তিনি বিজয়ী হবেন।
বিলাওয়াল ভুট্টো জারদারির নেতৃত্বাধীন পাকিস্তান পিপলস পার্টি (পিপিপি) ৫৪টি আসন নিয়ে তৃতীয় স্থানে রয়েছে।
সংবিধান অনুসারে, রাজনৈতিক দলগুলোকে নির্বাচনের দিন থেকে তিন সপ্তাহের মধ্যে সরকার গঠন করতে হবে। সে হিসেবে আগামী ২৯ ফেব্রুয়ারির মধ্যে যেভাবেই হোক সরকার গঠন করতে হবে।
জাতীয় পরিষদের মোট আসন ৩৬৬টি, যার মধ্যে ২৬৬ আসনে প্রার্থীদের সরাসরি ভোটের মাধ্যমে বেছে নেওয়া হয়। বাকি ৭০টি আসন সংরক্ষিত যার মধ্যে ৬০টি আসন নারীদের ও ১০টি আসন অমুসলিমদের। আর সংরক্ষিত আসনগুলো বিধানসভার প্রতিটি দলের শক্তি অনুযায়ী বরাদ্দ করা হয়।
ইসলামাবাদের রাজনৈতিক বিশ্লেষক রফিউল্লাহ কাকার বলেন, ‘এটি একটি খণ্ডিত ম্যান্ডেট যেখানে কোনো দলেরই সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নেই। তবুও তাদের অস্তিত্বের জন্য সাধারণ ভিত্তি খুঁজে বের করতে হবে বা জোট গঠন করতে হবে।’
যদিও পিটিআই ও পিএমএল-এন উভয়ই বিজয় ঘোষণা করেছে, তাই জোট সরকার গঠনই এখন অনিবার্য বলে মনে হচ্ছে। বিতর্ক অব্যাহত থাকায় জয়ী না হওয়া স্বতন্ত্র প্রার্থীরা ভোট কারচুপির অভিযোগে আদালতে দ্বারস্থ হয়েছেন। পিটিআই-এর সমর্থকরাও সারাদেশে নির্বাচন কমিশন অফিসের বাইরে বিক্ষোভ করেছে।
ভুট্টোর পিপিপির সঙ্গে শরিফের পিএমএল-এনের জোট
ওয়েস্টার্ন অস্ট্রেলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সামিনা ইয়াসমিন বিবিসির নিউজডেকে বলেছেন, একটি সম্ভাব্য দৃশ্যে পিএমএল-এন ও পিপিপির পাশাপাশি কিছু ছোট দলের সঙ্গে জোট গঠন করতে পারে। দুটি দল ২০২২ সালে ইমরান খানকে ক্ষমতা থেকে সরানোর জন্য জোট গঠন করে এবং গত আগস্ট পর্যন্ত তারা দেশ শাসন করে।
তিনি বলেন, ‘তবে বিপত্তিটা বাধবে পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী কে হবেন এবং রাষ্ট্রপতির পদের পরিপ্রেক্ষিতে বিভাজন কেমন হবে তা নিয়ে। এমনকী বিভিন্ন প্রদেশের মধ্যেও এমনটা দেখা যেতে পারে।’
পিএমএল-এন সামাজিক উদারপন্থী মুত্তাহিদা কওমি মুভমেন্টকে (এমকিউএম) টানতে চাইছে। দলটি এবার জাতীয় পরিষদে ১৭টি আসন জিতেছে। স্বতন্ত্র প্রার্থীদেরও দলে ভেড়াতে চাইছে তারা।
জারদারি রোববার লাহোরে নওয়াজ শরিফের ভাই শাহবাজের নেতৃত্বে পিএমএল-এনের একটি প্রতিনিধি দলের সঙ্গে দেখা করেছে। তখন পিপিপি তার বিকল্প ভাবার সময় নিচ্ছে বলে মনে হয়েছে। সোমবার ইসলামাবাদে দলের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির বৈঠক হওয়ার কথা রয়েছে।
ইমরানের পিটিআইয়ের সঙ্গে পিপিপির জোট
পিপিপির জ্যেষ্ঠ নেতা শেরি রেহমান বলেছেন, পার্টির দরজা সব রাজনৈতিক শক্তির জন্য উন্মুক্ত। তারা পিটিআইয়ের সঙ্গে কাজ করতে ইচ্ছুক কিনা এ প্রশ্নের জবাবে এ কথা বলেছেন রেহমান।
তবে ইমরান খানের মিডিয়া উপদেষ্টা জুলফি বুখারি বিবিসিকে বলেছেন, পিটিআই যদি সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করতে ব্যর্থ হয় তবে জোট গঠনের পরিবর্তে বিরোধীদের বেঞ্চে বসার খুব বেশি সম্ভাবনা রয়েছে।
ইমরান খান ২০১৮ সালে বলেছিলেন, জোট সরকার গঠন হলে তা হবে দুর্বল। দেশ যে সংকটের মুখোমুখি হয়েছিল তা কাটিয়ে উঠতে একটি শক্তিশালী সরকারের প্রয়োজন। তা সত্ত্বেও, তিনি এমকিউএম-এর মতো ছোট দলগুলোর সঙ্গে জোট গঠন করতে গিয়েছিলেন।
পিটিআই ও অন্যান্য দলের সঙ্গে পিএমএল-এনের জোট
এমনটা ঘটলে পিটিআইয়ের জন্য হবে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন। দলটির নেতা ইমরান খান বর্তমানে কারাগারে ১৪ বছরের সাজা ভোগ করছেন। নির্বাচনের আগে তার দলীয় প্রতীক কেড়ে নেওয়া হয়েছে এবং তার অনেক সমর্থককে আটকও করা হয়েছে। তবে বর্তমানে যে সংকটের মুখে পাকিস্তান তাতে এমন সম্ভাবনার কথা উড়িয়েও দেওয়া যায় না।
পিএমএল-এন সিনিয়র নেতা আজম নাজির তারা একটি ‘অংশগ্রহণমূলক জোট সরকারের’ যে আহ্বান জানিয়েছেন সেখানে তিনি বলেছেন সকলকে হাত মেলানো উচিত। তার এই বক্তব্যকে স্পষ্ট স্বীকৃতি বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। তাই ধারণা করাই যায় যে পিটিআইকে উপেক্ষা করা যাবে না৷
জর্জটাউন ইউনিভার্সিটির উদয় চন্দ্র বিবিসিকে বলেছেন, ‘এমনকী যারা আগে ইমরানকে ভোট দেয়নি তারাও বিগত দুই বছরে সেনাবাহিনীর কর্মকাণ্ড দেখে অনুশোচনা বোধ করতে পারেন যে তার ও তার দলের সঙ্গে কি অন্যায় আচরণটাই না করা হয়েছে।’
তিনি বলেন, স্বতন্ত্রদের জিতিয়ে ভোটাররা সেনাবাহিনীকে এই বার্তা দিয়েছে ‘বেসামরিক গণতন্ত্রের জয় হোক’।
পিটিআই-সমর্থিত স্বতন্ত্রদের ছোট দলে যোগদান
একটি সম্ভাবনা যা উত্থাপিত হয়েছে তা হল পিটিআই-সমর্থিত প্রার্থীরা জোট সরকার গঠনের জন্য একটি ছোট দলে যোগ দিতে পারে। এতে তারা তাদের আসন এক করার পাশাপাশি সংরক্ষিত নারী আসনেরও ভালো দাবিদার হবেন।
একটি রাজনৈতিক দল প্রতি সাড়ে তিনটি আসনের জন্য একটি সংরক্ষিত নারী আসন পায়। স্বতন্ত্র প্রার্থীরা কোনো দলের না হওয়ায় তারা এই সুযোগ পাবেন না। নির্বাচনের ফল চূড়ান্ত হওয়ার ৭২ ঘণ্টার মধ্যে স্বতন্ত্রদের অবশ্যই কোনো একটি দলে যোগদান বা স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য হিসেবে বসার ইচ্ছা প্রকাশ করতে হবে।
তবে লাহোর ইউনিভার্সিটি অব ম্যানেজমেন্ট সায়েন্সেসের আসমা ফয়েজ বলেছেন, পিটিআই জোট সরকার গঠন করতে পারবে এটি ‘খুবই অসম্ভব’। কারণ ছোট দলগুলোর সঙ্গে জোট করলেও পিটিআই সংখ্যাগরিষ্ঠতা থেকে অনেক দূরে থাকবে। পিটিআই ছোট দলের সঙ্গে যোগ দিলে সংখ্যাগত কোনো সুবিধাই পাবে না।’
কেআই//
আরও পড়ুন