‘আমাকে হত্যার জন্য খুনি ভাড়া করেছিল আমার স্বামী’
প্রকাশিত : ১২:৩৯, ৫ জুলাই ২০১৮
২০১২ সালের অগাস্ট মাস। একদিন ন্যান্সি শোর যখন গাড়ি চালিয়ে গীর্জা থেকে বাসার দিকে ফিরছিলেন তখন এক ঘাতক পিস্তল নিয়ে তার জন্য অপেক্ষা করছিল। সেই সময় বেঁচে যান ন্যান্সি। তাকে হত্যার জন্য অর্থ দেবার কারণে পুলিশ যাকে অভিযুক্ত করেছে, হাসপাতালের বিছানায় থাকা অবস্থায় তার নাম শুনে রীতিমতো বিস্মিত হন ন্যান্সি।
৫৭ বছর বয়সী ন্যান্সি শোর বলেন, ‘আমাদের বিয়েটা ছিল খুবই দারুণ। তবে বিয়ের পর আমরা কিছু উত্থান-পতনের ভেতর দিয়ে গিয়েছি। আমরা শতভাগ নির্ভুল ছিলাম না। আমাদের মধ্যে বিভিন্ন সময় নানা বিষয় সামনে আসতো এবং আমরা সেগুলো সমাধান করতাম।’
১৯৮৩ সালে ন্যান্সি বিয়ে করেন ফ্রাঙ্ক হাওয়ার্ডকে। তাদের তিনটি সন্তান রয়েছে। ক্যারোলটন এবং টেক্সাস শহরে তারা বেড়ে উঠেছে।
ন্যান্সি জানান, তার স্বামী ছিল খুব দয়ালু, ভদ্র এবং ভালাবাসা-প্রবণ। সন্তানদের সঙ্গে তার খুব ঘনিষ্ঠতা ছিল। বাচ্চারা যখন ছোট ছিল, তখন সে তাদের ফুটবল খেলা শেখাতো। বাচ্চাদের সব খেলা সে দেখতে যেতো। কিন্তু সন্তানরা যখন বড় হয়ে যায় তখন ফ্রাঙ্ক একজন হিসাবরক্ষক হিসেবে তার কাজের জন্য নানা জায়গায় যেতে শুরু করেন। তখন ন্যান্সি এক ধরনের বিচ্ছিন্নতা অনুভব করতে থাকেন। ন্যান্সি ঘরের কাজ করতেন এবং ঘরেই থাকতেন। কিন্তু ফ্রাঙ্ক এবং সন্তানরা যখন নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে যান সে সময় পরিস্থিতি কঠিন হতে শুরু করে ন্যান্সির জন্য। তাদের মধ্যে দূরত্বও বাড়তে থাকে।
২০১২ সালের আগস্ট মাসের ১৮ তারিখে ফ্রাঙ্ক বাড়ির বাইরে ছিলেন। ন্যান্সি ভেবেছিলেন ফ্রাঙ্ক যথারীতি তার কাজে বাইরে গেছে। ন্যান্সি গিয়েছিলেন গীর্জায়। ফেরার পথে একটি দোকান থেকে কিছু জিনিস কিনে গাড়ি চালিয়ে বাড়ি ফিরে আসছিলেন তিনি। গাড়িটি গ্যারেজে আসা মাত্রই এক লোক আকস্মিকভাবে তাকে পেছন দিক থেকে ধরে মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে দেয়। সে ব্যক্তি প্রথমে ন্যান্সির হাত ব্যাগটি দাবি করে। অস্ত্রধারীর সঙ্গে হাতাহাতির এক পর্যায়ে ন্যান্সি ঘুরে সে লোকটির মুখোমুখি দাঁড়ায়। ন্যান্সি হঠাৎ করে তার সঙ্গে থাকা জিনিসপত্রের ব্যাগটি লোকটির হাতে তুলে দেয়। কিন্তু সে ব্যক্তি ন্যান্সির কাছে আবারও তার হাত ব্যাগটি দাবি করে। ন্যান্সি যখন তার হাত ব্যাগ দিয়ে অস্ত্রধারীকে ধাক্কা দেয় তখন সে ব্যক্তি ন্যান্সির মাথায় গুলি করে। তাৎক্ষনিক-ভাবে অচেতন হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন ন্যান্সি। লোকটি দৌড়ে পালিয়ে যায়। ন্যান্সির যখন জ্ঞান ফিরে আসে তখন শ্বাস-প্রশ্বাস নিতে তার খুবই কষ্ট হচ্ছিল এবং তীব্র যন্ত্রণা অনুভব করতে থাকেন।
ন্যান্সি বলেন, ‘আমার মনে হচ্ছিল যে আমি মারা যাচ্ছি। সৃষ্টিকর্তা আমাকে জেগে উঠার শক্তি দিলেন।’
ঘাতক ব্যক্তি ন্যান্সির হাত ব্যাগ নিয়ে পালিয়ে যাবার কারণে তার কাছে কোন মোবাইল ফোন ছিল না। সে কোন রকমে হামাগুড়ি দিয়ে গাড়ির দরজা খুলে জরুরী বোতামে চাপ দিলেন যাতে তাকে উদ্ধারের জন্য জরুরী সাহায্য আসে। কিন্তু বোতামটি কাজ না করায় ন্যান্সি কোন রকমে তার ঘরে এসে ঢুকে আয়নার সামনে দাঁড়ায়।
ন্যান্সি বলেন, ‘আমি নিজের দিকে তাকালাম। আমি দেখলাম আমার চোখ থেকে রক্ত পড়ে শার্ট ভিজে যাচ্ছে। আমি তখনো বুঝতে পারিনি যে আমার বাম চোখটি হারিয়েছি।’
শ্বাস-প্রশ্বাস নিতে কষ্ট হলেও ন্যান্সি জরুরী সাহায্যের জন্য টেলিফোন করেন। তখন একজন পুলিশ সদস্য সেখানে এসে ন্যান্সির সন্তানদের টেলিফোন করে। পরে সন্তানরা তাদের বাবাকে টেলিফোনে এ ঘটনা জানায়। ন্যান্সির স্বামী ফ্রাঙ্ক দ্রুত হাসপাতালে চলে আসে।
পুলিশ এ ঘটনার তদন্ত করার সময় ফ্রাঙ্কের মোবাইল ফোনে কিছু বিস্ময়কর তথ্য পায়। এসব তথ্যের মধ্যে ছিল অন্য এক নারীর কিছু ছবি এবং মোবাইল ফোনে বার্তা আদান-প্রদান। ন্যান্সিকে যখন গুলি করা হয় তখন তার স্বামী ফ্রাঙ্ক পেশাগত কাজে নয় বরং অন্য নারীর সঙ্গে ছিলেন। তিন বছর ধরে সেই নারীর সঙ্গে ফ্রাঙ্কের গোপন প্রণয় চলছিল। ন্যান্সি যখন কিছুটা সুস্থ হয়ে উঠেন এবং হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র ছাড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন সে সময় তার স্বামী টেলিফোন করে গোপন প্রণয়ের কথা স্বীকার করেন। একথা শুনে ন্যান্সি কাঁদতে শুরু করলেও তার জন্য আরও ধাক্কা অপেক্ষা করছিল।
পুলিশ এক পর্যায়ে ন্যান্সিকে জানায় যে তাকে হত্যা প্রচেষ্টার জন্য এক ব্যক্তিকে আটক করা হয়েছে। যার নাম জন ফ্রাঙ্কলিন হাওয়ার্ড। এ ব্যক্তিই হচ্ছেন ন্যান্সির স্বামী। ন্যান্সিকে হত্যার জন্য ফ্রাঙ্ক একটি অপরাধী-চক্রকে কয়েক বছর ধরে অর্থ দিয়ে আসছিলেন। ন্যান্সি জানেন না যে তার স্বামী কেন তাকে হত্যা করতে চেয়েছিল। তবে তার বিশ্বাস ফ্রাঙ্ক জানতো যে ন্যান্সি কখনোই বিবাহ বিচ্ছেদে রাজী হবে না। সেজন্যই তাকে হয়তো হত্যা করতে চেয়েছে।
বিচারে ফ্রাঙ্কের যাবজ্জীবন সাজা হয়েছে এবং ৩০ বছর সাজা ভোগ করার আগ পর্যন্ত তিনি প্যারোলে মুক্তি পাবেন না। ততদিনে তার বয়স হবে ৮৫ বছর।
বিচার শুরুর আগে ন্যান্সির সঙ্গে ফ্রাঙ্কের বিবাহ বিচ্ছেদ হয়েছিল। কিন্তু ফ্রাঙ্ক যদি এখন মুক্তি পায় তাহলে তাদের সঙ্গে পুনরায় সম্পর্ক স্থাপন কিংবা তাকে আবারও বিয়ে করতে ইচ্ছুক ন্যান্সি।
ন্যান্সি বলেন, ‘এর কারণ হচ্ছে আমি তাকে এখনো ভালোবাসি। এটা কোন আবেগ-তাড়িত ভালোবাসা নয়, আমার সন্তানদের পিতা হিসেবে তার প্রতি আমার ভালোবাসা আছে এবং সেটা সবসময় থাকবে।’
ফ্রাঙ্ক কারাগারে যাবার পর থেকে ন্যান্সির সঙ্গে তার কখনও দেখা হয়নি। ন্যান্সি একবার ভেবেছিলেন যে তাকে দেখতে যাবেন। কিন্তু তিনি আপাতত দূরত্ব বজায় রাখতে চাইছেন। তার মনে একটি প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে। ফ্রাঙ্কের সঙ্গে দেখা করে ন্যান্সি একটি প্রশ্ন জিজ্ঞেস করতে চান।
সে প্রশ্নটি হচ্ছে, তাদের বিয়েতে কী সমস্যা ছিল? ফ্রাঙ্ক কেন তার কাছ থেকে দূরে সরে গিয়ে অন্য নারীর দিকে ঝুঁকে পড়েছিল?
সূত্র : বিবিসি বাংলা
এসএ/
আরও পড়ুন