ঢাকা, শনিবার   ২৩ নভেম্বর ২০২৪

কাশ্মীর ইস্যুতে পাক-ভারত দ্বন্দ্ব চলছেই

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ১৭:৫৩, ১২ আগস্ট ২০১৯

প্রবল বিরোধীতা সমালোচনা থাকার পরও ভারত সরকার গত সোমবার ( আগস্ট) সংবিধানের ৩৭০ ধারায় কাশ্মীরের স্বায়ত্তশাসনের বাতিল করে দেয়।এর সঙ্গে ৩৫ () অনুচ্ছেদে বর্ণিত কাশ্মীরিদের বিশেষ সুবিধাও বাতিল হয়ে যায়।

ফলে দীর্ঘদিন স্বাধীনতাকামী জম্মু কাশ্মীর রাজ্যের মর্যাদা হারিয়ে ভারতের কেন্দ্রীয়শাসিত অঞ্চলে পরিণত হয়েছে।বিধানসভাযুক্ত কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল জম্মু-কাশ্মীর বিধানসভাবিহীন লাদাখ নামে দুটি রাজ্যে ভাগ করা হয়।এর ফলে কাশ্মীরকে নিয়ে যত বাঁধা তার সব অতিক্রম করলেন মোদি সরকার।

ভারত যেভাবে রাতারাতি কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা বাতিল করে জম্মু-কাশ্মীর লাদাখকে দুটি কেন্দ্র শাসিত অঞ্চলে ভাগ করছে, তাতে সমালোচনা করেছে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলো। তাদের সম্পাদকীয় কলমে মোদি সরকারের পদক্ষেপের নানা দিক খতিয়ে দেখা হয়েছে।

আমেরিকার ওয়াশিংটন পোস্টে লাফায়েত্তি কলেজের অধ্যাপক হাফসা কাঞ্জওয়াল লিখেছেন, মোদি সরকার সংবিধানবিরোধী কাজ করেছে। খুব পরিকল্পিতভাবে একটি রাজ্যে হিন্দুদের সংখ্যাগরিষ্ঠ করে ফেলার চেষ্টা হচ্ছে।

তার লেখায়, ভারতীয়রা এখন কাশ্মীরে জমি কিনতে পারবেন। স্থানীয় মানুষকে তাড়িয়ে দেওয়া হবে। ইসরাইল যেভাবে ফিলিস্তিনিদের তাড়িয়ে দিয়েছে, সেই একই পদক্ষেপ নিচ্ছে ভারত।

সে ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়ার জন্য কাশ্মীরে বিরাট সংখ্যক সেনা মোতায়েন করা হয়েছে। তাদের সংখ্যা ৫০ লাখের বেশি। কাশ্মীরের বিরাট এলাকা জুড়ে তৈরি হয়েছে ক্যান্টনমেন্ট, ক্যাম্প আর বাঙ্কার। ভারতের রুলিং পার্টির বহুদিনের পরিকল্পনা হল, সেখানে অনেক হিন্দুর বসতি করানো। তাহলে রাজ্যের সংখ্যাগুরু মুসলিম জনতার রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষাকে সহজে দমন করা যাবে।

জেরুজালেম পোস্টে পশ্চিম এশিয়া বিশেষজ্ঞ সেথ ফ্রাঞ্জম্যান লিখেছেন, কাশ্মীর ইস্যু মানে শুধু আর্টিকেল ৩৭০ নয়, তার গুরুত্ব অনেক বেশি। তার সঙ্গে আন্তর্জাতিক রাজনীতির সম্পর্ক আছে। ভারতের সঙ্গে ইসরাইলের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আছে। তারা নিজেদের সেনাবাহিনীকে আরও আধুনিক করে তুলতে চায় বলেও তিনি মন্তব্য করেন।

এদিকে কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা বাতিল করার পর ভারত পাকিস্তানের সম্পর্ক তলানিতে পৌঁছেছে।একের পর এক হুমকি পাল্টা হুমকি আসছে দেশ দুটির পক্ষ থেকে।

পাকিস্তানভিত্তিক হামলার আশঙ্কায় সতর্ক অবস্থানে রয়েছে ভারতীয় নৌবাহিনী। ভারতে কোনো হামলা চালানো হলে এর উপযুক্ত জবাব দেওয়া হবে বলে হুঁশিয়ার করেছেন দেশটির এক সেনা কর্মকর্তা।

অপরদিকে পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকেও বলা হয়েছে, ভারত আগ্রাসন চালালে এর কঠোর জবাব দেওয়া হবে। তবে পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, তারা সংকটের সমাধানে আপাতত কূটনৈতিক পথে এগোবেন।

এই পরিস্থিতিতে উভয় রাষ্ট্রকে ‘সর্বোচ্চ সংযম’ প্রদর্শনের আহ্বান জানিয়েছে জাতিসংঘ। যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, তারা দুই দেশের আলোচনার মাধ্যমেই কাশ্মীর ইস্যুর সমাধান চায়।

এদিকে কাশ্মীর নিয়ে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান ভারতের নরেন্দ্র মোদী সরকারকে টার্গেট করে সোশ্যাল মিডিয়াতে একের পর তীব্র আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছেন।

মোদী সরকার এবং ক্ষমতাসীন দলের সাথে হিটলার এবং নাৎসিদের তুলনা করছেন তিনি।

সোমবার টুইটারে ইমরান লিখেছেন, ‘কারফিউ, কঠোর বিধিনিষেধ, এবং ভারত-অধিকৃত কাশ্মীরে আসন্ন গণহত্যা আরএসএস-এর (রাষ্ট্রীয় স্বয়ং-সেবক সংঘ) আদর্শ, যে আদর্শ নাৎসিদের আদর্শ দ্বারা অনুপ্রাণিত।

জাতিগত শুদ্ধির মাধ্যমে কাশ্মীরের জনসংখ্যার অনুপাত বদলের চেষ্টা চলছে। প্রশ্ন হচ্ছে, মিউনিখে হিটলারকে যেভাবে তোষণ করা হয়েছিল, বিশ্ব কী এবারও তেমনই ভূমিকা নেবে?’

তার আগে আরেকটি টুইটে ইমরান খান লেখেন, ‘আরএসএস-এর হিন্দু শ্রেষ্ঠত্ববাদের আদর্শ নিয়ে আমি শঙ্কিত, কারণ এটা নাৎসিদের আদর্শের মত।

ভারতের সরকারি দলের সাথে হিটলার এবং নাৎসিবাদের সাথে তুলনা করে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী কাশ্মীরের প্রতি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করছেন।

এক বছর আগে প্রধানমন্ত্রী হিসাবে ক্ষমতা নেওয়ার পর থেকে কাশ্মীর নিয়ে সঙ্কটের মধ্যে রয়েছেন ইমরান খান।

ফেব্রুয়ারিতে ভারত শাসিত কাশ্মীরের পুলওয়ামায় একটি সন্ত্রাসী হামলার পর ভারতের সাথে যুদ্ধ প্রায় বেঁধে গিয়েছিল।

কয়েক মাস যেতে না যেতেই কাশ্মীরের স্বায়ত্তশাসন বিলোপের ভারতের এই অকস্মাৎ সিদ্ধান্তের প্রচণ্ড এক ধাক্কা সামলাতে হচ্ছে তাকে।

মিডিয়া রিপোর্ট এবং রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের বক্তব্য থেকে এটা কম-বেশি স্পষ্ট যে, সোমবার যেভাবে ভারত সংবিধানের ৩৭০ ধারা বিলোপ করে জম্মু কাশ্মীরের স্বায়ত্তশাসন অবসান করে, তাতে অপ্রস্তুত হয়ে পড়েছিল পাকিস্তান।

এরপর প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান দফায় দফায় সরকারী মন্ত্রী এবং সেনা কর্মকর্তাদের সাথে কথা বলছেন। ভারতীয় হাইকমিশনারকে বহিষ্কার করা হয়েছে। একইসাথে দিল্লিতে তাদের রাষ্ট্রদূতকে ফিরিয়ে এনেছে।

পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে সোমবারই এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, কাশ্মীরের মানুষের প্রতি দায়বোধ পালনে তারা যে কোনো পথ নিতে প্রস্তুত।

কিন্তু কাশ্মীর ইস্যুতে ভারতের সাথে আরেকটি যুদ্ধের মতো চরম কোনো পথে যাওয়ার সম্ভাবনা কতটা পাকিস্তানের? এখন পর্যন্ত পাকিস্তানের ক্ষমতাসীন মহল থেকে কার্যত সেই সম্ভাবনা নাকচ করে দেওয়া হচ্ছে।

সামরিক পথে যাওয়ার সম্ভাবনা পুরোপুরি নাকচ করে দিয়েছেন জাতিসংঘে পাকিস্তানের দূত মালিহা লোধী।

শুক্রবার সিএনএন সংবাদ সংস্থাকে তিনি বলেন, কূটনৈতিক এবং রাজনৈতিক পথে এগুনোর বহু রাস্তা পাকিস্তানের সামনে খোলা, এবং সেই পথেই তারা এগুবে।

দক্ষিণ এশিয়া নিরাপত্তা বিষয়ের বিশ্লেষক . সৈয়দ মাহমুদ আলী বিবিসিকে বলেন, কাশ্মীরের সর্ব-সাম্প্রতিক এই ইস্যুটিকে নিয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে যাওয়া ছাড়া পাকিস্তানের সামনে এখন তেমন কোনো বিকল্প নেই।

জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের তিনটি প্রস্তাব রয়েছে। ভারতের সিদ্ধান্তে সব প্রস্তাব অকার্যকর হয়ে যায়নি। জাতিসংঘ এবং একইসাথে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে যেতে হবে পাকিস্তানকে।

. সৈয়দ মাহমুদ আলী মনে করেন, যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তান থেকে সৈন্য প্রত্যাহারের জন্য উন্মুখ এবং সেজন্য তালেবানের সাথে তারা একটি শান্তি মীমাংসা করছে। এই প্রচেষ্টায় সাফল্যের পাকিস্তানের সহযোগিতা আমেরিকার কাছে এখন গুরুত্বপূর্ণ।

. আলী বলেন, ইমরান খান এবং ডোনাল্ড ট্রাম্পের মধ্যে ব্যক্তিগত বোঝাপড়া ভালো - যেটা হয়তো পাকিস্তান কাজে লাগানোর চেষ্টা করবে।ট্রাম্প ইমরানের সম্পর্ক বহুদিনের, ২৫ বছর ধরে তারা পরস্পরকে চেনেন, যোগাযোগ আছে।

পাকিস্তানের ইংরেজি দৈনিক দি ডেইল টাইমস পত্রিকা এক সম্পাদকীয়তে লিখেছে, আমেরিকা এবং নেটো যদি জাতিসংঘ প্রস্তাব মেনে চলার জন্য ভারতের ওপর চাপ তৈরি না করে, তাহলে পাকিস্তানের উচিৎ আফগানিস্তানে শান্তি প্রতিষ্ঠায় সাহায্য বন্ধ করে দেওয়া।

আফগানিস্তান-ভারতের বাণিজ্য পথ এবং পাকিস্তানের আকাশ ভারতের জন্য বন্ধ করে দেওয়ার সুপারিশ করছেন পাকিস্তানের কেউ কেউ।

চীনের ওপরও চাপ তৈরির কথা লিখেছে ডেইলি টাইমস – ‘চীন যদি চায় চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডর বা সিপিইসি নিরবিচ্ছিনভাবে চলুক, তাহলে চীনকে পাকিস্তানের সাথে কাঁধ মেলাতে হবে।

পাকিস্তানের সাবেক একজন কূটনীতিক এবং সাবেক পররাষ্ট্র সচিব শামসাদ আহমেদ বিবিসিকে বলেছেন, পাকিস্তানের সরকারের উচিৎ প্রভাবশালী দেশেগুলোতে গিয়ে গিয়ে বলা যে ভারতের এই পদক্ষেপের ফলে পারমাণবিক অস্ত্রধারী দুই দেশের মধ্যে সংঘাতের কত বড় হুমকি তৈরি হয়েছে।

প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প যখন কাশ্মীর প্রসঙ্গে মধ্যস্থতা করার প্রস্তাব করলেন, পরপরই ভারত কাশ্মীরে এই কাণ্ড করলো..এখানে পাকিস্তানের কোনো ভূমিকাই নেই। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে পাকিস্তানকে এই বিষয়টিকেই বোঝাতে হবে।

পাকিস্তানের আরেক সাবেক পররাষ্ট্র সচিব নাজমুদ্দিন শেখ বলেন, আফগানিস্তানের শান্তি প্রক্রিয়াকে কাজে লাগাতে পারে পাকিস্তান, তবে কোনো ভাবেই পাকিস্তানের উচিৎ হবেনা যুক্তরাষ্ট্রের কাছে বিষয়টিকে শর্ত হিসাবে তুলে ধরা।

পাকিস্তানের এখন উচিৎ হবে যুক্তরাষ্ট্র এবং মিত্রদের কাছে গিয়ে বলা যে, আঞ্চলিক শান্তি এবং স্থিতিশীলতার সার্থে পাকিস্তান এবং ভারতের সংঘাতের সমাধান হওয়া প্রয়োজন।। কিন্তু আফগান শান্তি প্রক্রিয়া নষ্ট করে দেওয়ার চেষ্টা করা একবারেই ঠিক হবেনা।

কাশ্মীরে বিদ্রোহে অস্ত্র বা অন্য কোনো উপায়ে সরাসরি মাথা গলানোর কোনো চেষ্টা থেকেও পাকিস্তানের বিরত থাকা উচিৎ বলেও মনে করেন নাজিমুদ্দিন শেখ।

ভারত সবসময় দেখাতে চায় পাকিস্তান কাশ্মীর পরিস্থিতির জন্য দায়ী। তারাই সশস্ত্র সন্ত্রাসী ঢুকিয়ে দেয় কাশ্মীরে। সুতরাং এখন এমন কিছু করা পাকিস্তানের জন্য ঠিক হবেনা যাতে ভারত কোনো অজুহাত পেতে পারে। এখন পর্যন্ত যা বুঝা যাচ্ছে তারা সেই পথেই হাঁটছেন।

ইমরান খানের সাম্প্রতিক বক্তব্য এবং টুইটগুলো ইঙ্গিত দিচ্ছে, তিনি কাশ্মীরের ব্যাপারে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করার পথই নিচ্ছেন।

পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী শাহ মোহাম্মদ কোরেশি জেদ্দায় গিয়ে ইসলামি ঐক্য সংস্থা বা ওআইসির কাছে গিয়ে পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করেছেন। শুক্রবার তিনি চীনে গেছেন।

শুক্রবার বেইজিংয়ে চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সাথে পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আড়াই ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে বৈঠক হয়েছে। পরে পাকিস্তানের মন্ত্রী বলেন, কাশ্মীর প্রশ্নে পাকিস্তানের সঙ্গে রয়েছে চীন।

লাদাখের কিছু কিছু এলাকার মালিকানা দাবি করে চীন, ফলে ইতোমধ্যেই তারা লাদাখকে ভারতের কেন্দ্র শাসিত অঞ্চল করার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে বিবৃতি দিয়েছে। চীনা বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ভারতের এই পদক্ষেপ তাদের সার্বভৌমত্বের জন্য হুমকি।

তবে শিনজিয়াং প্রদেশে মুসলিমদের বিচ্ছিন্নতাবাদী তৎপরতা সামলাতে হচ্ছে বেইজিংকে। ফলে কাশ্মীরিদের ব্যাপারে তারা পাকিস্তানকে কতটা জোরালো সমর্থন জোগাবে, তা নিয়ে অনেক বিশেষজ্ঞেরই সন্দেহ রয়েছে।

নিরাপত্তা পরিষদের অন্য স্থায়ী সদস্যদের পক্ষ থেকেও ভারতের এই পদক্ষেপের বিরুদ্ধে তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া দিতে শোনা যায়নি।

তথ্যসূত্র: বিবিসি

এমএইচ/

 


Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি