কী ঘটতে যাচ্ছে ওই ১৯ লাখ লোকের ভাগ্যে?
প্রকাশিত : ১৯:৩৬, ৩১ আগস্ট ২০১৯ | আপডেট: ২০:০০, ৩১ আগস্ট ২০১৯
ভারতের উত্তরপূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য আসামের নাগরিক পঞ্জির চূড়ান্ত তালিকা থেকে বাদ দেয়া হয়েছে ১৯ লাখেরও বেশি মানুষের নাম। ভারতীয় সময় আজ শনিবার বেলা দশটার দিকে টুইট করে একটি সংবাদবিজ্ঞপ্তি জারি করে এই তথ্য দিয়েছে এনআরসি। এখন প্রশ্ন উঠেছে, তাহলে কি আছে ওই ১৯ লাখ লোকের ভাগ্যে?
ন্যাশনাল রেজিস্টার অব সিটিজেন্স (এনআরসি)’র রাজ্য সমন্বয়ক প্রতীক হাজেলা জানিয়েছেন, ‘ভারতের নাগরিক পঞ্জিতে অন্তর্ভূক্ত হবেন আসামের তিন কোটি এগারো লাখ ২১ হাজার ৪ জন অধিবাসী। তবে ওই তালিকায় স্থান পাননি ১৯ লাখ ৬ হাজার ৬৫৭ জন।’
এর আগে গত বছরের ৩০ জুলাই প্রকাশিত খসড়া এনআরসি বা নাগরিক পঞ্জি তালিকা থেকে বাদ পড়েছিল প্রায় ৪১ লাখ লোকের নাম। তার মধ্যে প্রায় ৪ লাখ মানুষ তালিকায় নাম তোলার জন্য পুনর্বিবেচনার আবেদন করেননি। সেই ৪ লাখসহ মোট ১৯ লাখ মানুষের নাম বাদ গেল আজ।
এদিকে, যারা বাদ পড়েছেন তারা মূলত দরিদ্র এবং বেশিরভাগই মুসলমান বলে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের খবরে বলা হচ্ছে। এ নিয়ে এখন প্রশ্ন দেখা দিয়েছে যে, তাহলে কী ঘটতে চলেছে এই ১৯ লাখ লোকের ভাগ্যে? কী আছে তাদের কপালে? বিচার প্রক্রিয়ায় বা কেমন হবে?
এ বিষয়ে আসাম সরকার জানিয়েছে, এনআরসি থেকে বাদ পড়া এই ১৯ লাখ মানুষকে এখনই বিদেশী বলে ঘোষণা করা হবে না। এমনকি গ্রেফতারও করা হবে না। পুনর্বিবেচনার জন্য এরা বিদেশী ট্রাইব্যুনালে আবেদন করতে পারবেন, আজ থেকে ১২০ দিনের মধ্যেই।
এই বিষয়ে শুনানির জন্য রাজ্যজুড়ে ১ হাজার ট্রাইব্যুনাল গড়ে তোলা হবে বলে জানানো হয়েছে। ইতোমধ্যেই ১০০ ট্রাইব্যুনাল খোলা হয়েছে। আরও ২০০টি ট্রাইব্যুনাল সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহেই খোলার আশ্বাস দিয়েছে রাজ্য সরকার।
রাজ্যটির সরকার আরও জানায়, ট্রাইব্যুনাল যদি বিচার করে বিদেশী বলে রায় দেন, তারপরেও হাই কোর্ট আর সুপ্রীম কোর্টের কাছে আবেদন জানাতে পারবেন যে কেউ।
এদিকে, গত কয়েকদিন ধরেই এই তালিকা প্রকাশকে কেন্দ্র করে ব্যাপক উৎকন্ঠা কাজ করেছে এনআরসি থেকে বাদ পড়া মানুষদের মধ্যে। যে কারণে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট ইতিমধ্যেই নাগরিকত্বের তালিকা হালনাগদ করার প্রক্রিয়াটি পর্যবেক্ষণ করছে বলেও জানা গেছে।
অন্যদিকে, সতর্কতামূলক ব্যবস্থা হিসাবে বাড়তি নিরাপত্তা বাহিনীও মোতায়েন করেছে রাজ্য সরকার। রাজধানী গুয়াহাটিসহ সংবেদনশীল এলাকাগুলোতে ১৪৪ ধারা অনুযায়ী নিষেধাজ্ঞা জারি রয়েছে। তবে স্বাভাবিক জন জীবনের ওপর তার কোনও প্রভাব পড়তে দেখা যায়নি বলেই জানিয়েছেন বিবিসির এক সংবাদদাতা।
শুরুটা যেভাবে
আসামের ন্যাশনাল রেজিস্টার অফ সিটিজেনস বা এনআরসির প্রথম তালিকাটি প্রকাশিত হয় ১৯৫১ সালে। সেটা ছিল ভারত ভাগের চার বছর পর। সে সময় তৎকালীন পূর্ববঙ্গ পাকিস্তানের অংশ হওয়ার পর লাখ লাখ লোক সীমান্ত অতিক্রম করে নবগঠিত ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন।
বিপুল সংখ্যক মুসলমানদের আগমন হিন্দু-প্রধান আসামের জনসংখ্যার ভারসাম্যকে বদলে দিতে পারে এই আশঙ্কায় সেখানকার অসমীয়া জাতীয়তাবাদী দলগুলো আন্দোলন শুরু করে এবং নাগরিকত্বের প্রথম তালিকাটি তৈরি হয়।
এই সমস্যা আবার দেখা দেয় ১৯৭০-এর দশকে যখন বাংলাদেশে স্বাধীনতার লক্ষ্যে আন্দোলন শুরু হয়। সে সময়ও লাখ লাখ মানুষ পালিয়ে ভারতে চলে যায়। এদের একাংশ গিয়ে আশ্রয় নেয় আসামে।
পরে ১৯৭৯ সালে অবৈধ অভিবাসীদের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করে অল আসাম স্টুডেন্টস ইউনিয়ন (আসু)। ১৯৮৩ সালে এই আন্দোলন সহিংস রূপ নেয় যাতে ২০০০ সন্দেহভাজন অবৈধ অভিবাসী প্রাণ হারান। এদের বেশিরভাগই ছিলেন মুসলমান।
আসু এবং কয়েকটি আঞ্চলিক দল এই প্রশ্নে শেষ পর্যন্ত ১৯৮৫ সালে রাজীব গান্ধীর নেতৃত্বাধীন কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে একটা চুক্তিতে আসে। চুক্তিতে বলা হয়, ১৯৭১ সালের ২৪ মার্চের আগে থেকে আসামের বাসিন্দা, কেউ এমনটা প্রমাণ করতে না পারলে তাকে ভোটার তালিকা থেকে বাদ দেয়া হবে এবং তাকে অবৈধ অভিবাসী হিসেবে বিবেচনা করা হবে। কিন্তু চুক্তিটি কখনই বাস্তবায়ন করা হয়নি।
পরে ২০০৯ সালে অভিজিৎ শর্মা নামে এক ব্যক্তি ভারতের সুপ্রিম কোর্টে একটা পিটিশন দায়ের করেন এবং এনআরসি তালিকা হালনাগাদ করার আবেদন করেন। ২০১৪ সালে আদালত ওই তালিকা ২০১৬ সালের ৩১ জানুয়ারির মধ্যে হালনাগাদ করার জন্য কেন্দ্র সরকারকে আদেশ দেয়।
তবে দু:সাধ্য এই কাজ সম্পন্ন করে ২০১৭ সালের ডিসেম্বর মাসে প্রথম খসড়া তালিকা প্রকাশ করে সরকার। আর যাচাই বাছাইয়ের পর ওই খসড়ার দ্বিতীয় তালিকাটি প্রকাশিত হয় ২০১৮ সালের ৩০ জুলাই।
কারা আছেন এই তালিকায়?
খসড়া তালিকা অনুযায়ী, রাজ্যের মোট তিন কোটি ২৯ লক্ষ বাসিন্দা তাদের নাগরিকত্ব প্রমাণ করতে সমর্থ হন। তারা প্রমাণ করতে পেরেছেন যে, ১৯৭১ সালের ২৪ মার্চের আগে তারা আসামে এসে হাজির হয়েছেন।
নাগরিকত্ব প্রমাণের জন্য রাজ্যের সব অধিবাসীকে তাদের জমির দলিল, ভোটার আইডি এবং পাসপোর্টসহ নানা ধরনের প্রমাণপত্র দাখিল করতে হয়েছিল। যারা ১৯৭১ সালের পর জন্মগ্রহণ করেছেন তাদের প্রমাণ করতে হয়েছে যে, তাদের বাবা-মা ওই তারিখের আগে থেকেই আসামের বাসিন্দা।
কিন্তু এই তালিকা থেকে বাদ পড়ে যান ৪০ লক্ষ মানুষ। শঙ্কা জাগে, নাগরিকত্বের বৈধতা প্রমাণ করতে ব্যর্থ হওয়ার জন্য ভোটার তালিকা থেকে তাদের নাম কেটে দেয়া হতে পারে।
এরপর নাগরিকত্ব প্রমাণের জন্য তাদের কাছ থেকে অতিরিক্ত কাগজপত্র চাওয়া হয় এবং ৩৬ লক্ষ ২০ হাজার মানুষ তালিকায় নাম ওঠানোর জন্য দলিলপত্র জমা দিয়েছেন বলে জানা যায়। এসময় তালিকায় নাম তোলার জন্য পুনর্বিবেচনার আবেদন করেননি প্রায় ৪ লাখ মানুষ।
এদিকে, এনআরসি কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগ উঠেছে যে, তালিকা থেকে বাদ পড়া বহু লোকের কাছে তারা চিঠি পাঠিয়েছে এবং কাছের অফিস বাদ দিয়ে অনেক দূরের অফিসগুলোতে গিয়ে তাদের কাগজপত্র জমা দেয়ার নির্দেশ দিয়েছে। সূত্র- বিবিসি।
এনএস/আরকে
আরও পড়ুন