ঢাকা, রবিবার   ২২ ডিসেম্বর ২০২৪

ফুটবল তারকা থেকে যেভাবে আইএস প্রধান বাগদাদি

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ১৭:২৬, ২৮ অক্টোবর ২০১৯

বাগদাদি

বাগদাদি

মসজিদের বারান্দায় দাঁড়িয়ে মাইক্রোফোনের সামনে বক্তৃতা দিচ্ছেন আইএস প্রধান। আবু বকর আল বাগদাদি বলতে গোটা দুনিয়া চেনে শুধু এই ছবিটাই। সংবাদ মাধ্যমে যতবার আইএস প্রধান বাগদাদির নাম উঠে এসেছে, ততবার তার এই ছবিও ছড়িয়ে পড়েছে। সেইসঙ্গে ছড়িয়ে পড়েছে ইসলামিক স্টেট নামক জঙ্গি সংগঠনটির নানা নৃশংসতার কাহিনিও। 

কিন্তু কে এই বাগদাদি? মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যার মাথার দাম ঘোষণা করেছিল কোটি কোটি ডলার।

১৯৭১ সালে ইরাকের ছোট্ট শহর সামারায় একটি সুন্নি পরিবারে জন্ম হয়েছিল বাগদাদির। তখন অবশ্য তার নাম ছিল ইব্রাহিম আল বদরি। ২০১৩ সালে নিজেকে ‘খলিফা’ হিসাবে ঘোষণা করার পরই সংবাদ মাধ্যমে উঠে আসে আইএস প্রধান। তার আগের ৪২ বছরে, বাগদাদির কথা অবশ্য তেমনভাবে শোনা যায়নি। বরং, তা মার্কিন গোয়েন্দাদের হাতেই সীমাবদ্ধ ছিল। 

পরিবারের ধর্মীয় পরিবেশ জোরাল প্রভাব ফেলেছিল বাগদাদির উপর। ছোটবেলা থেকেই কোরান ও ধর্মীয় রীতিনীতির প্রতি অসম্ভব টান ছিল তার। তা নিয়েই পড়াশোনা শুরু করেন তিনি। ১৯৯৬ সালে বাগদাদ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইসলামিক স্টাডিজের উপর ব্যাচেলর ডিগ্রি লাভ করেন তিনি। এরপর কোরআনিক স্টাডিজে মাস্টার ডিগ্রি ও পরে ডক্টরেটও পান তিনি। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের ফাইল থেকে অবশ্য বাগদাদি সম্পর্কে বড়সড় তথ্য মেলেনি। 

জানা যায়, ওই সময়েই বাগদাদ শহরের কাছে একটি মসজিদে শিশুদের কোরআন শিক্ষাও দিতে শুরু করেন তিনি। সেইসঙ্গে চলতে থাকে তার ফুটবল চর্চাও। ক্লাব ফুটবলে রীতিমতো স্টার হয়ে উঠে ছিলেন বাগদাদি।

ইরাকে মুসলিম ব্রাদারহুড আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েছিলেন বাগদাদির কাকা। তার হাত ধরেই, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করার সময়ে মুসলিম ব্রাদারহুডে যোগ দেন বাগদাদি। তবে, শুধুমাত্র সেই গণ্ডিতেই আটকে থাকেননি বাগদাদি। ২০০০ সাল নাগাদ সালাফি জিহাদিদের সঙ্গে যোগ দেন বাগদাদি। 

মার্কিন গোয়েন্দা সূত্র অনুযায়ী, ১৯৯৬ সাল থেকে ২০০০ সালের মধ্যেই আফগানিস্তানে জিহাদি প্রশিক্ষণ নেন বাগদাদি। নব্বই-এর দশকে উপসাগরীয় যুদ্ধের সময় ছাত্র ছিলেন তিনি। ২০০৩ সালে মার্কিন বাহিনী যখন ফের ইরাকে অভিযান শুরু করে তখন বাগদাদি অবশ্য পুরোদস্তুর জঙ্গি। ২০০৪ সালে তাকে প্রথম এবং শেষবারের জন্য গ্রেফতার করেছিল মার্কিন বাহিনী। তখন তাকে পাঠানো হয় বুক্কা ক্যাম্পে, সেখানে প্রায় ১০ মাস কাটান বাগদাদি।

নানা সূত্র থেকে জানা যায়, খুব কম কথা বলতেন বাগদাদি। বন্দি থাকাকালীন বেশিরভাগ সময়েই ধর্মীয় চর্চাই চালিয়ে যেতেন তিনি। সেইসঙ্গে বিভিন্ন বিরোধী জঙ্গি গোষ্ঠীর নেতাদের সঙ্গেও তার যোগাযোগ ঘটে। বুক্কা ক্যাম্প থেকে ছাড়া পাওয়ার পর ইরাকের আল কায়দাগোষ্ঠীর সঙ্গে যোগাযোগ করেন বাগদাদি। 

যদিও, পরে ওই জঙ্গি সংগঠন ভেঙে দিয়ে তার নাম রাখা হয় ইসলামিক স্টেট। সেই থেকেই সূত্রপাত। বিরোধী গোষ্ঠীগুলোকে এক জায়গায় আনার ক্ষমতা, ধর্মীয় পড়াশোনা -এই সমস্ত কিছুই বাগদাদিকে নেতা হিসাবে উঠে আসতে দারুণ সাহায্য করে। তার জঙ্গি সংগঠনে যোগ দেয় সাদ্দাম হুসেনের বাথ পার্টির একাধিক সদস্য এবং ইরাকি সরকারের সেনাকর্তাদের অনেকেই। 

মধ্য-এশিয়া বিশেষজ্ঞ মাইকেল স্টিফেন্সের কথায়, ‘সাদ্দাম হুসেনের প্রাক্তন গোয়েন্দা অফিসারদের কেমনভাবে কাজে লাগাতে হয়, তা তিনি (বাগদাদি) ভালই জানতেন।’ তবে নিজের নিরাপত্তা নিয়েও নাকি যথেষ্ট খুঁতখুঁতে ছিলেন বাগদাদি।

২০১০ সালের এপ্রিলে বাগদাদিকে নতুন আমির ঘোষণা করা হয়। তখনও অবশ্য আল কায়দার সঙ্গে ইসলামিক স্টেটের সম্পর্ক টিকে ছিল। কিন্তু ২০১১ সালে পাকিস্তানের অ্যাবোটাবাদে মার্কিন নেভি সিলের অপারেশন নেপচুন স্পিয়ারে নিহত হন আল কায়দা প্রধান ওসামা বিন লাদেন। তারপর আল কায়দার দায়িত্ব নেন আয়মান আল জাওয়াহিরি। ততদিনে ইরাক ও সিরিয়ার বিস্তীর্ণ এলাকা থেকে পিছু হঠতে শুরু করে আল কায়দা। বদলে, সেই জায়গা দখল করে নিতে থাকে ইসলামিক স্টেট। 

কিন্তু তখনও আল কায়দা ছেড়ে বেরিয়ে আসেনি তারা। ভাঙনটা শুরু হয় আল নুসরা নামে আরেকটি জঙ্গি সংগঠনকে ঘিরে। নুসরার নেতারা সিরিয়া সরকারের বিরুদ্ধে সশস্ত্র আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার পক্ষে ছিল। কিন্তু তার বদলে নিজের ‘সাম্রাজ্য’ গড়ে তোলাই প্রথম পছন্দ ছিল বাগদাদির। সেইসঙ্গে দখল করা এলাকায় কঠোর ধর্মীয় আইন চালু করাও ছিল তার লক্ষ্য। এ নিয়েই আল কায়দায় সঙ্গে সংঘাত শুরু হয় বাগদাদির। আইএস-কে জঙ্গি সংগঠন থেকে বহিষ্কার করে আল কায়দা। তাতে কার্যত শাপে বর হয় বাগদাদির।

আল কায়দার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন হওয়ার পর পরই ইরাক ও সিরিয়ার বিভিন্ন এলাকা দুর্বার গতিতে দখল করে নেয় আইএস জঙ্গিরা। ২০১৪ সালের জুনে ইরাকের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর মসুল দখল করে নেয় আইএস। এই সময়েই নিজেকে ‘খলিফা’ হিসাবে ঘোষণা করেন বাগদাদি। শুরু থেকেই একের পর এক নৃশংসতার নজির তৈরি করেছে আইএস। এলাকা দখলের পর, গণহত্যা, নির্মমভাবে অত্যাচারের কোনও নিদর্শনই বাদ রাখেনি তারা। 

ইয়াজেদি সম্প্রদায়সহ একাধিক সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপরে অত্যাচারের নজির দেখে কার্যত শিউরে উঠেছে গোটা বিশ্ব। সেইসঙ্গে ব্যাঙ্ক, তেলের খনিসহ বহু সরকারি সম্পত্তিও দখল করে নেয় তারা। গোটা দুনিয়া তো বটেই, আইএস-এর হিংসার শিকার হয় এই উপমহাদেশও।

যদিও আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমে বার বার ছড়িয়েছে বাগদাদির মৃত্যুর সংবাদ। আবার তার কিছুদিনের মধ্যেই প্রকাশ্যে এসেছে মসুলের আল নুরি মসজিদের বারান্দা থেকে তার বক্তৃতা দেয়ার ভিডিও। গত ২৬ অক্টোবর রাতে প্রথমে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং পরে হোয়াইট হাউসের ডেপুটি প্রেস সেক্রেটারি হোগান গিডলের টুইটে ফের বাগদাদির মৃত্যু নিয়ে নতুন করে জল্পনা শুরু হয়। এমন ঘটনা দেখা গিয়েছিল ওসামা বিন লাদানের ক্ষেত্রেও। পরিস্থিতি আন্দাজ করেই কি আগে থেকে রেকর্ড করে রাখা হয় এমন ভিডিও? 

চলতি বছরের এপ্রিল মাসে শ্রীলঙ্কায় ইস্টারের দিনে চার্চে হামলা চালায় জঙ্গিরা। সেই হামলায় দায় স্বীকার করে আইএস। সেই সূত্রেই প্রকাশ্যে আসে বাগদাদির ভিডিও। আন্তর্জাতিক শক্তির লাগাতার অভিযান ও বিমান হানায় আইএস-এর শক্তি এখন তলানিতে ঠেকেছে। এক সময়ের বহু ঘাঁটিতেই এখন কোণঠাসা হয়ে পড়েছে তারা। কোথাও আবার পিছু হঠতে হয়েছে তাদের। সেই সঙ্গে বাহিনীর হাতে ধরা পড়ে যাওয়ার আশঙ্কাও তাড়া করে বেড়াচ্ছিল বাগদাদিকে। ফলে, বার বার জায়গাও বদলাতে হচ্ছিল ওই জঙ্গিনেতাকে। কিন্তু, শেষ পর্যন্ত অবশ্য পালিয়ে বাঁচতে পারলেন না বাগদাদি। সূত্র- আনন্দবাজার। 

এনএস/


Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি