ভারতে যে তিন নারী হয়ে উঠেছেন প্রতিবাদের প্রতিক
প্রকাশিত : ২০:৩৯, ২৭ ডিসেম্বর ২০১৯ | আপডেট: ২২:০০, ২৭ ডিসেম্বর ২০১৯
প্রায় তিন সপ্তাহ ধরে ভারতে নাগরিকত্ব সংশোধণ বিল’র (ক্যাব) বিরুদ্ধে দেশজুড়ে প্রতিবাদ চলছে। আসাম থেকে দিল্লি, উত্তরপ্রদেশ বা পশ্চিমবঙ্গ থেকে কেরালা বা পন্ডিচেরি সবখানেই প্রতিবাদ এখন প্রতি দিনকারের ঘটনা। এ প্রতিবাদে কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের বেশি দেখা যাচ্ছে।
দিল্লির জামিয়া মিলিয়া এবং আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ওপরে পুলিশের ব্যাপক মারধরের পরে দেশটির ছাত্রছাত্রীরা আরও ক্ষুব্ধ হয়ে উঠছেন। রাজপথে নেমেছেন লাখ লাখ শিক্ষার্থী। কিন্তু ছাত্রছাত্রীদের এই বিক্ষোভে বেশ কয়েকটি প্রতিবাদী মুখ নিয়ে চর্চা হচ্ছে - ভাইরাল হয়ে গেছে তাদের প্রতিবাদী ছবি। ঘটনাচক্রে তিনজনই ছাত্রী এবং তিনজনের সঙ্গেই কোনও রাজনৈতিক দলের যোগাযোগও নেই। খবর বিবিসি’র।
তারা এতদিন ধরে শুধুই পড়াশোনা করেছেন আর সঙ্গে কেউবা নাচ, ছবি আঁকার মতো শখে জড়িত ছিলেন। রাজনীতি থেকে দূরেই থেকেছেন এরা। তবে হঠাৎ তারা সামাজিক মাধ্যমগুলোতে ব্যাপক আলোচনার বিষযয়ে পরিগনিত হয়েছেন।
ইন্দুলেখা পর্থান, আইনের ছাত্রী, এর্নাকুলাম, কেরালা:
এই তিনজনের মধ্যে সবথেকে কম বয়সী কেরালার এর্নাকুলামের আইন প্রথম বর্ষের ছাত্রী ইন্দুলেখা পর্থান। তিনি বলেন, ‘আমি কোনদিন কোনও রাজনীতি বা প্রতিবাদে যাইনি এর আগে। সেদিন কলেজের সিনিয়ররা ক্লাসে এসে জানায় যে নাগরিকত্ব সংশোধনীর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হবে ছাত্রছাত্রীদের। প্রতিবাদের ধরণ নিয়ে কারও কোনও আইডিয়া আছে কীনা। তার আগেই প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, যারা অশান্তি ছড়াচ্ছে, তাদের পোশাক দেখেই চেনা যায় কারা এর পিছনে আছে। ওই কথাটা মাথায় এসেছিল হঠাৎ।’ সিনিয়র ছাত্রছাত্রীদের ইন্দুলেখা বলেছিলেন, প্রধানমন্ত্রী যখন পোশাক দেখে চেনা যায় বলছেন তখন তিনি হিজাব পড়ে প্রতিবাদে যেতে চান। উঁচু ক্লাসের ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে সঙ্গেই তার আইডিয়াটা পছন্দ হয়ে যায়। যোগাড় করা হয় হিজাব।
ইন্দুলেখা সেদিন ছাত্রছাত্রীদের প্রতিবাদী মিছিলে যোগ দিয়েছিলেন ওই হিজাব পড়ে। হাতে ধরা ছিল একটা প্ল্যাকার্ড: ‘মি. মোদী আমি ইন্দুলেখা। আমার পোশাক দেখে আমাকে শনাক্ত করুন।’
তিনি বলেন, ‘আমার মনে হয়েছিল প্রধানমন্ত্রীর ওই বক্তব্যটার প্রতিবাদ করা দরকার - যদি একজনও আমার হিজাব পড়ার কারণটা বুঝতে পারে, সেটাই আমার সার্থকতা - এটাই মনে হয়েছিল। কিন্তু ছবিটা যে এ রকম ভাইরাল হয়ে যাবে, এটা ভাবিনি। আমার এক বন্ধুই ছবিটা তুলেছিল।’
১৮ বছর বয়সী ইন্দুলেখা বলেন, ‘আমি কখনই কোনও প্রতিবাদ মিছিলে যাইনি। কিন্তু আইনের ছাত্রী হিসাবে আমার মনে হয়েছিল ছাত্রদেরই এ ব্যাপারে এগিয়ে আসা উচিত - তার কারণ আমরাই তো শিক্ষিত শ্রেণি - আমরাই তো ভবিষ্যৎ। আগামী দিনে কারও নাম তালিকা থেকে বাদ যাবে - এটা তো আমাদেরই ভবিষ্যতের প্রশ্ন।’
যদিও তিনি আইন পড়ছেন তবে তার ভালবাসার বিষয় হল অঙ্ক। রাজ্যস্তরের নানা অঙ্ক প্রতিযোগিতায় যোগ দেন তিনি। আরেকটি শখ ভারতনাট্যম নাচ। ছবিটি সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ার পরে পরিবার আর বন্ধুদের পাশে পেয়েছেন ইন্দুলেখা। অন্যদিকে সামাজিক মাধ্যমে তাকে ব্যাপকভাবে ট্রলও করা হচ্ছে। কিন্তু সেসবের দিকে মন দিতে চান না ইন্দুলেখা পর্থান।
রাবিহা আব্দুরেহিম, গণসংযোগে এমএ পরীক্ষায় স্বর্ণ পদক প্রাপ্ত, পন্ডিচেরি বিশ্ববিদ্যালয়:
বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনে হাজির হয়েছিলেন ভারতের রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোভিন্দ। অনুষ্ঠানে ডিগ্রি নিতে হাজির হয়েছিলেন সহপাঠীদের সঙ্গে রাবিহাও। সমাবর্তনের আনুষ্ঠানিক কালো পোশাকের সঙ্গেই তিনি মাথায় জড়িয়ে নিয়েছিলেন গোলাপি রঙের হিজাব। রাষ্ট্রপতির আসার জন্য যখন সকলেই উদগ্রীব, সেই সময়ে হঠাৎই পুলিশ কর্মকর্তারা রাবিহাকে বাইরে ডেকে নিয়ে যান। বলা হয় যে তার সঙ্গে কিছু কথা আছে।
তিনি বলেন, ‘বাইরে নিয়ে গিয়ে পুলিশ আমাকে নানা প্রশ্ন করতে থাকে। তার আগেই সামাজিক মাধ্যমে আমি খুব কড়া প্রতিবাদ করছিলাম এনআরসি এবং সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন নিয়ে। আমার মনে হচ্ছিল সামাজিক মাধ্যমের ওইসব প্রতিবাদের কারণেই বোধহয় আমাকে ডেকে নিয়ে যাওয়া হয়। এবং যতক্ষণ রাষ্ট্রপতি সমাবর্তনে ছিলেন, ততক্ষণ আমাকে হলে ঢুকতে দেওয়া হয় নি।’
কিছু ছাত্রছাত্রীকে ডিগ্রি আর পদক দেওয়ার পরে রাষ্ট্রপতি বেরিয়ে যান। তারপরে পুলিশে রাবিহাকে ভেতরে যাওয়ার অনুমতি দেয়। তখনও বাকি ছাত্রছাত্রীদের ডিগ্রি প্রদান চলছিল।
মঞ্চে যখন তার ডাক পড়ে তখন সটান বলে দেন, ‘আমি পদক নেব না। এটাই আমার প্রতিবাদ। নাগরিকত্ব আইনের প্রতিবাদ করেছি বলে আমাকে হল থেকে বার করে দেওয়া হল! অত্যন্ত অপমানিত হয়েছি। আর আমি সেই অপমান সহ্য করে স্বর্ণপদক নেব?’
তিনি আরও বলেন, ‘প্রথমে মনে হয়েছিল যে সামাজিক মাধ্যমে কড়া প্রতিবাদের কারণে আমাকে বের করে দেয়া হয়। কিন্তু সেখানে আরও মুসলমান ছাত্রী ছিল, এমন অনেকে ছিল যারাও এনআরসি-বিরোধী প্রতিবাদে সামিল হয়েছিল। কিন্তু কাউকে না বেছে শুধু আমাকেই বের করে দেওয়া হয়। এটা তো বৈষম্য। পরে পুলিশ জানিয়েছে যে তাদের আশঙ্কা ছিল যে রাষ্ট্রপতির সামনে আমি কোনোভাবে প্রতিবাদ করে উঠতে পারি সেজন্যই আমাকে সভাস্থল থেকে সরিয়ে দেয়া হয়।’
বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ জানায়, ওই সভার নিরাপত্তার দায়িত্ব সম্পূর্ণভাবেই ছিল পুলিশের। তাই সেখানে তাদের কিছু বলার ছিল না। ওই ঘটনার খবর গণমাধ্যমে প্রকাশ পেতেই রাবিহাও হয়ে উঠেছেন ছাত্রছাত্রীদের প্রতিবাদের আরেকটি মুখ।
দেবস্মিতা চৌধুরী, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগে স্বর্ণ-পদকপ্রাপ্ত, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়:
কলকাতার যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা রাজনৈতিকভাবে সচেতন বলে মনে করা হয়। তারা সব ইস্যুতেই ছাত্র-প্রতিবাদে রাস্তায় নামে, যেমনটা নেমেছে নাগরিকত্ব আইনে সংশোধন এবং এনআরসি নিয়েও। মিছিল-বিক্ষোভে পা মিলিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা, স্লোগান দিয়েছে, পোস্ট-কমেন্ট করছে সামাজিক মাধ্যমেও।
কিন্তু এসবের থেকে কিছুটা দূরে থাকা, চুপচাপ পড়াশোনা আর ছবি আঁকার শখ নিয়ে গত পাঁচ বছর ধরে লাগাতার প্রথম হয়ে আসছেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের যে ছাত্রীটি, সেই দেবস্মিতা চৌধুরী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনের মঞ্চে এমন একটি ঘটনা ঘটিয়েছেন, যাতে তার সম্পর্কে বন্ধুবান্ধব আর সহপাঠীদের ধারণাটাই বদলিয়ে গেছে।
সমাবর্তনে স্বর্ণ পদক নিতে উঠে দেবস্মিতা চৌধুরী নাগরিকত্ব আইনের কপিটা সবার সামনে ছিঁড়ে ফেলেন। তাকে চিৎকার করে বলতে শোনা যায় ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’। স্লোগানটা বামপন্থীদের হলেও তিনি নিজে কোনও দিন কোনও রাজনৈতিক বা ছাত্র সংগঠনের সঙ্গেই থাকেননি এমনটিই জানিয়েছেন দেবস্মিতা।
তিনি বলেন, ‘আমাকে সবাই জানে যে কম কথা বলি, পড়াশোনা নিয়ে থাকতেই পছন্দ করি। কখনও কোনও রাজনৈতিক সংগঠনে ছিলাম না। কিন্তু পরিস্থিতিই আমাকে বাধ্য করেছে রাস্তায় নামতে, প্রতিবাদ করতে। সেদিন মঞ্চে ওঠার আগে থেকেই ভীষণ ইমোশনাল হয়ে পড়েছিলাম। যেভাবে ছাত্রদের মারা হচ্ছে, বাচ্চা ছেলেরা মার খাচ্ছে পুলিশের কাছে, এটা জাস্ট মেনে নিতে পারিনি। আগে থেকে কিছুই ভেবে করিনি। হঠাৎই ক্ষোভটা উগড়ে দিয়েছি।’
তার ক্ষোভ যে শুধু এনআরসি এবং নাগরিকত্ব আইন বিরোধী প্রতিবাদে ছাত্রদের ওপরে পুলিশের লাঠিচার্জের কারণে নয়, সেটাও বললেন তিনি।
তিনি বলেন, ‘আজকে সরকারকে বুঝতে হবে যে কেন এত মানুষ রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ করছে, কেন কোনও জায়গায় সেটা সহিংস হয়ে যাচ্ছে। আমি সহিংসতাকে সমর্থন করি না ঠিকই, কিন্তু সরকারের এটাও বোঝা উচিত যে এখানে দেশের মানুষের নিজের পরিচয় নিয়ে, অস্তিত্ব নিয়ে সংশয় তৈরি হয়েছে। কারণ কারও যদি নাগরিকত্ব না থাকে, তাহলে তার নিজের পরিচয় আর অস্তিত্ব বা তার কোনও অধিকারই আর থাকবে না।’
কথার শুরুতে দেবস্মিতা বলছিলেন যে তিনি চুপচাপ পড়াশোনা নিয়ে থাকতেই ভালবাসতেন। কিন্তু সেরকমই একজনকে প্রতিবাদ করতে বাধ্য করেছে বিরাট বড় ম্যান্ডেট নিয়ে ক্ষমতায় আসা সরকার।
তিনি বলেন, ‘আমি বা আমার মতো কম বয়সীরা তো আমাদের দেশটাকে এভাবে দেখতে চাইনি। আমার ভারতকে আমি বড়ো হতে, বিশ্বের সেরা দেশগুলোর একটা দেখতে চেয়েছি। এভাবে নেতা-হীন একটা দেশ তো চাইনি আমরা। এই কথাগুলো যখন আপনাকে বলছি, গলার স্বরে বুঝতে পারছেন হয়তো আমার চোখে জল এসে যাচ্ছে।’
সমাবর্তনের মঞ্চে উঠে নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের কপি ছিঁড়ে ফেলার ছবি ভাইরাল হওয়ার পরে তার কাছে যেমন বহু ফোন আর মেসেজ এসেছে অভিনন্দন জানিয়ে, তেমনই ট্রলও করা হচ্ছে তাকে। আর সেই সব ট্রলে টেনে আনা হচ্ছে তার পরিবারকেও। কিন্তু পাশে পেয়েছেন সহপাঠী, শিক্ষকদের।
এমএস/এসি
আরও পড়ুন