ঢাকা, রবিবার   ২৯ ডিসেম্বর ২০২৪

টাকা-পয়সা কি সন্তান নিতে উৎসাহিত করে?

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ১১:৫০, ২২ জানুয়ারি ২০২০ | আপডেট: ১১:৫২, ২২ জানুয়ারি ২০২০

উন্নত বিশ্বের দেশগুলোয় একপ্রকার শিশু সংকট শুরু হয়েছে। তাই অনেক দেশ বেশি করে সন্তান নিতে নাগরিকদের উৎসাহ দিতে অর্থকড়ি দিয়ে থাকে। কিন্তু এই পদ্ধতি বাস্তবে তেমন একটা কাজে আসছে না। অর্থ দিয়েও শিশুর জন্মহার বাড়ানো সম্ভব হয়নি।

অনেকদিন ধরে ফিনল্যান্ড, ফ্রান্স, দক্ষিণ কোরিয়া এবং ইরানের মতো দেশ বেশি করে সন্তান নেওয়ার জন্য নারীদের উৎসাহ দিতে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছে। এসব পরীক্ষায় অর্থকড়ির সম্পৃক্ততা, ক্যারিয়ারকে উন্নত করা এবং সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিতের বিষয়টি উঠে এসেছে।

গত সপ্তাহে দুটি প্রতিবেদনে দেখা গেছে, বিশ্বের বৃহত্তম শক্তির দেশগুলো চিন্তায় পড়ে গেছে, কারণ সেখানে যথেষ্ট শিশু নেই। আর এ কারণেই গত বুধবার রাশিয়ান নারীদের বেশি করে সন্তান নিতে উৎসাহিত করার জন্য পরিকল্পনা ঘোষণা করেছেন প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। প্রথম সন্তান নেয়ার জন্য একজন নারীকে ৭ হাজার ৬০০ মার্কিন ডলার দেয়া হবে। আর দ্বিতীয় সন্তান নেয়ার জন্য তিনি পাবেন ২ হাজার ৫০০ মার্কিন ডলার।

আরেকটি তথ্যে জানা গেছে যে, ২০১৯ সালে চীনে জন্ম নেয়া শিশুর সংখ্যা গত ছয় দশকের মধ্যে সর্বনিম্ন অবস্থায় নেমে এসেছে। ফলে দেশগুলো চিন্তায় পড়ে গেছে যে, তাদের নাগরিকরা দিনে দিনে বয়স্ক হয়ে উঠছে। তাদের উদ্বেগ, ভবিষ্যতে কাজ করার জন্য যথেষ্ট তরুণ কর্মী পাওয়া যাবে না।

তবে এই সমস্যা শুধুমাত্র চীন এবং রাশিয়ায় নয়, সারা বিশ্ব জুড়েই জন্ম হার কমছে। ২০০৭ সালে বেবি বোনাস ঘোষণা করেছিল রাশিয়া। দ্বিতীয় এবং তৃতীয় সন্তান গ্রহণের জন্য বোনাস হিসাবে অর্থ পাবেন বাবা-মা। কিন্তু তার প্রায় কোন প্রভাবই পড়েনি, জন্মহার ক্রমে কমছেই।

২০১৫ সালে 'এক সন্তান নীতি' বাতিল করে চীনের সরকার আশা করেছিল যে, শিশু জন্মের হিড়িক পড়ে যাবে। সেই বছর শিশু জন্মের হার সামান্য বেড়েছিল, কিন্তু সে পর্যন্তই।

এশিয়ার অবস্থা
পরীক্ষা-নিরীক্ষায় দেখা যায় যে, এশিয়া অঞ্চলের মানুষজন যখন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে যে, কম সন্তান নেবে, তখন তাদের বোঝানো খুব কঠিন। দক্ষিণ কোরিয়ার শিশু জন্মের হার গুরুতর পর্যায়ে পৌছেছে। গত বছর তাদের জন্মহার রেকর্ড সংখ্যায় নেমে আসে। 

পরিসংখ্যানে দেখা যায়, দক্ষিণ কোরিয়ায় গড়ে নারী প্রতি সন্তানের সংখ্যা একটিরও কম।  মাত্র ০.৮৯ শতাংশ। ১৯৭০ সালের পর থেকে দেশটির জনসংখ্যা কমে যাচ্ছে। এই সমস্যা সমাধানে দক্ষিণ কোরিয়া সবকিছুই করেছে, অভিভাবকদের ভর্তুকি দিতে প্রায় সাত হাজার কোটি ডলার খরচ করেছে।

সম্ভাব্য মায়েরা আগে থেকেই সরকারের কাছ থেকে সব খরচ পান। যখন শিশুর জন্ম হয়, তারা প্রথম সন্তানের জন্য মাসে ১৭০ ডলার পান এবং দ্বিতীয় সন্তানের জন্য আরো বেশি পান। শিশুদের যত্নের জন্য সরকারি কেন্দ্র রয়েছে। ভর্তুকি পাওয়া বেসরকারি কেন্দ্রও রয়েছে। কিন্তু সরকার যতই চেষ্টা করুক না কেন, এতে তেমন একটা কাজ হচ্ছে না।

শিক্ষাভীতি
দক্ষিণ কোরিয়ায় সন্তান না নেয়ার পেছনে অনেক কারণ আছে। বাড়ির দাম আকাশ ছুঁতে চলেছে, প্রাইভেট পড়াশোনার খরচ বাড়ছে। এই দেশটির অনেকেই মনে করেন, সেসব পূর্ণ করা তাদের পক্ষে সম্ভব নয়। সরকারি আর্থিক ভর্তুকি নিয়েও তা পূরণ হওয়ার নয়। দক্ষিণ কোরিয়ার মতো একই সমস্যায় ভুগছে জাপানও। চীনও এ ধরনের সমস্যার কাছাকাছি রয়েছে।

তিন সন্তানের মা কিম ইয়ে-ইয়ুন বলছেন, 'দক্ষিণ কোরিয়ায় শিক্ষা ভীতি আছে এবং বেসরকারি পড়াশোনার খরচ অনেক বেশি। সরকারি সহায়তা সত্ত্বেও তিনি তার সন্তানের পড়াশোনার খরচ মেটাতে পারছেন না ‘

ছোট সফলতা
তবে স্থানীয়ভাবে এই সমস্যার সমাধান খুঁজে বের করেছে কোন কোন ছোট শহরের বাসিন্দারা। গত নয় বছরে নাগি শহরের বাসিন্দারা তাদের এলাকার জন্মহার দ্বিগুণ করে তুলতে সক্ষম হয়েছে। খুব আকর্ষণীয় ভর্তুকি দেয়ার কারণে সেখানে জন্মহার এখন ১.৪ থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২.৮। ফিনল্যান্ডের লেসটিজার্বি শহরে প্রতি শিশুর জন্মের জন্য ১১ হাজার ইউরো করে ভর্তুকি দেয়া হচ্ছে।

অতিরিক্ত ব্যয়ভার
দীর্ঘমেয়াদে চিন্তা করলে, শিশুদের একটি বড় অংশ পরবর্তীকালে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা বা কাজের জন্য বড় শহরে চলে যাবে। বড় শহরের অতিরিক্ত ব্যয়ভার বিশেষভাবে জন্মনিরোধে উৎসাহিত করে থাকে।

ইউরোপের ছোট দেশ এস্তোনিয়া শিশু বোনাস হিসাবে মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার খরচ করেছে, কিন্তু সাফল্য হাতে গোনা। জন্মহার সামান্য বেড়েছে। কিন্তু সেজন্য এস্তোনিয়ার তিন সন্তানের একটি পরিবারকে মাসে দিতে হচ্ছে ৫৭৬ ডলার।

ক্যারিয়ার
সারাবিশ্ব জুড়েই সন্তান জন্ম দেয়া না দেয়ার ক্ষেত্রে এটা বিশেষ ভূমিকা রেখে চলেছে। যখন একজন নারী পড়াশোনা শেষ করে চাকরিতে ঢোকেন, তার কাছে সন্তান জন্ম দেয়ার গুরুত্ব কমে যায়। নানা কারণে সেটা তার জন্য কঠিনও হয়ে যায়।

অক্সফোর্ড ইন্সটিটিউট অব পপুলেশন এজিং এর ড. লেসন বলছেন, 'আমি মনে করি, এটা পুরোপুরি অর্থের অপচয়। অনেক সময়েই আমি আমার ছাত্রদের জিজ্ঞেস করি, কেন মানুষ বেশি সন্তান নিতে চাইবে?'

তিনি বলছেন, জন্মহার কমে যাওয়া নতুন কিছু নয়। ৪০ বছর আগে ইউরোপে এটা শুরু হয়েছে এবং দ্রুত উন্নয়নশীল অর্থনীতির দেশগুলোয় নারীদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে, যারা পরিবারের চেয়ে বরং তাদের শিক্ষাকে কাজে লাগাতে চান
এবং পেশা গড়তে চান।

২০০৫ সাল থেকে শিশু জন্মের ক্ষেত্রে ভর্তুকি দিয়ে আসছে হাঙ্গেরি, কিন্তু কোন প্রভাব দেখা যায়নি। আরো খারাপ হলো, তরুণদের ইউরোপের অন্যত্র চলে যাওয়ার প্রবণতা বেড়েছে।

যেসব পরিবারে সন্তান থাকে, তাদেরকে অর্থ দিয়ে আসল অন্তর্নিহিত সত্যটি বেরিয়ে আসছে না। কারণ আধুনিক অনেক নারীই তাদের পেশাজীবন চালিয়ে যেতে চান।

ভাল সুযোগ-সুবিধা
সুইডেন এবং ফ্রান্স এই বিষয়টিকেই প্রমাণ করেছে। তারা তাদের দেশে জন্মহার ইউরোপের গড় হারের সঙ্গে ধরে রেখেছে। কারণ তারা সন্তান নেয়ার পরে কাজে ফেরার ক্ষেত্রে ভালো পিতৃত্বকালীন ছুটি, বিনা পয়সার ভালো শিশু সেবা ও কাজের সংস্কৃতি তৈরি করেছে। ফলে কেউ পিতা-মাতা হতে গিয়ে চিন্তায় পড়ে যায় না।

দক্ষিণ কোরিয়ার কিম জি-ইয়ে বলছেন, তিনি ভাগ্যবতী কারণ তিনি যে কোম্পানিতে কাজ করেন, সেটা বাবা-মায়েদের ক্ষেত্রে যথেষ্ট সহায়ক। তিনি ১৬ মাসের মাতৃত্বকালীন ছুটি পেয়েছিলেন এবং অফিসে শিশুদের রাখার একটি জায়গা পেয়েছিলেন। কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এরকম সুবিধা পাওয়া যায় না।

সুতরাং দেখা যাচ্ছে, নগদ অর্থ ছড়ানোর চেয়ে যদি ভালোভাবে সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা যায়, তা বেশি উৎসাহ তৈরি করতে পারে সন্তান নেওয়ার ক্ষেত্রে।

উরুগুয়ে, থাইল্যান্ড, তুরস্ক এবং ইরানের মতো দেশগুলো দেখতে পেয়েছে যে, একবার যদি কম সন্তান নেয়ার ব্যাপারটি
স্বাভাবিক হয়ে যায়, তাহলে সেই পরিস্থিতি পাল্টানো কঠিন।

সূত্র : বিবিসি

এএইচ/


Ekushey Television Ltd.

© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি