করোনাভাইরাস নিয়ে প্রথম সতর্ককারী চিকিৎসককে চুপ করে দিয়েছিল চীন
প্রকাশিত : ১১:৪২, ৫ ফেব্রুয়ারি ২০২০

চিকিৎসক লি ওয়েনলিয়াং। হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে সেই কাহিনী বর্ণনা করেছেন ওয়েবে। ছবি: সংগৃহীত
জানুয়ারি মাসের শুরুর দিকে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার খবর চেপে রাখার চেষ্টা করেছিল চীনের উহান শহরের কর্তৃপক্ষ। যখন একজন চিকিৎসক এই রোগের প্রাদুর্ভাবের ব্যাপারে অন্য চিকিৎসকদের সতর্ক করে দেয়ার চেষ্টা করছিলেন, তখন পুলিশ তার সঙ্গে দেখা করে এবং এ ব্যাপারে কথা না বলার আদেশ দেয়।
ডিসেম্বরে এই রোগের প্রাদুর্ভাবের কেন্দ্রস্থলে কাজ করছিলেন চিকিৎসক লি ওয়েনলিয়াং। তখন তিনি ভাইরাসে আক্রান্ত সাতজনকে দেখতে পান। তিনি প্রথমে ভেবেছিলেন, তাদের সার্স রোগ হয়েছে, যে ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে ২০০৩ সালে বিশ্বব্যাপী মহামারী হিসাবে দেখা দিয়েছিল।
হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় ডক্টর লি তার এই কাহিনী বর্ণনা করেছেন। তার ওই পোস্টটি শুরু হয়েছে এভাবে, ‘হ্যালো, আমি লি ওয়েনলিয়াং, উহান সেন্ট্রাল হাসপাতালের একজন চক্ষু বিশেষজ্ঞ।’
৩০শে ডিসেম্বর মাসে একটি চ্যাট গ্রুপের মাধ্যমে সহযোগী চিকিৎসকদের এই ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের ব্যাপারে একটি বার্তা দেন চিকিৎসক লি। সেখানে তিনি সবাইকে সংক্রমণ থেকে বাঁচার জন্য প্রতিরোধমূলক কাপড় পরার পরামর্শ দেন।
অসুস্থ হওয়ার পরেও ড. লি অবাক হতেন যে, কেন চিকিৎসা কর্মীদের অসুস্থ হওয়ার ব্যাপারটি অস্বীকার করে যাচ্ছে কর্তৃপক্ষ তখনো ডক্টর লি জানতে না যে, তিনি যে রোগের কথা বলছেন, সেটা একেবারে নতুন একটি করোনাভাইরাস।
চারদিন পরে তার সঙ্গে দেখা করেন পাবলিক সিকিউরিটি ব্যুরোর কর্মকর্তারা। তারা তাকে একটি চিঠিতে স্বাক্ষর করতে বলেন। সেই চিঠিতে মি. লি’র বিরুদ্ধে মিথ্যা মন্তব্য করার অভিযোগ আনা হয়। বলা হয়, এর ফলে সামাজিক ক্ষতি করা হচ্ছে।
পাবলিক সিকিউরিটি ব্যুরোর কর্মকর্তারা তাকে বলেন, ‘আমরা আপনাকে সতর্ক করছি। আপনি যদি একগুঁয়েমি করে এ ধরনের অবৈধ কার্যকলাপ চালিয়ে যান, তাহলে আপনাকে বিচারের আওতায় আনা হবে। আপনি কি সেটা বুঝতে পারছেন?’ ওই চিঠির নীচে ডক্টর লি হাতে লিখে দেন, ‘হ্যাঁ, আমি বুঝতে পারছি।’
পুলিশ বলেছে, আমরা আশা করছি তুমি শান্ত হবে এবং নিজের আচরণ সংযত করবে। তখন পুলিশ জানিয়েছিল, ডক্টর লি হচ্ছেন আটজন ব্যক্তির একজন, যাদের বিরুদ্ধে 'গুজব ছড়ানোর' অভিযোগে তদন্ত করা হচ্ছে।
জানুয়ারি মাসের শেষের দিকে ওই চিঠির একটি কপি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশ করেন ডক্টর লি এবং তার সঙ্গে কী ঘটেছে, সেগুলো বর্ণনা করেন। এর মধ্যেই তার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেছে স্থানীয় কর্তৃপক্ষ, কিন্তু এই ক্ষমা প্রার্থনা এসেছে অনেক দেরি করে। যখন এই রোগে প্রায় ৫০০ লোক মারা গেছে তারপরে।
জানুয়ারি মাসের প্রথম কয়েক সপ্তাহ উহানের কর্মকর্তারা জোর দিয়ে বলছিলেন যে, যারা আক্রান্ত কোন প্রাণীর সংস্পর্শে এসেছেন, তারাই শুধুমাত্র ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন। এ সময় চিকিৎসকদের সতর্কতার জন্য কোন পরামর্শ বা সহায়তা দেয়া হয়নি।
পুলিশের ওই সাক্ষাতের এক সপ্তাহ পরেই ডক্টর লি একজন নারীর চিকিৎসা করেন, যার গ্লুকোমা রয়েছে। তিনি জানতেন না যে, ওই নারী নতুন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন।
পোস্টে চিকিৎসক লি বর্ণনা করেন কীভাবে তার কাশি শুরু হয়েছিল। পরদিন তার জ্বর আসে এবং দুইদিন পরে তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। তার পিতামাতাও অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং তাদেরকেও হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। এর ১০দিন পরে ২০ জানুয়ারি করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের কারণে চীন জরুরি অবস্থা জারি করে।
ডক্টর লি লিখেছেন, ‘তার গল্প এটা বলে দেয় যে, ভবিষ্যতে কোন সংক্রমণ রোগের লক্ষণ দেখলেও প্রাথমিক সতর্কতা দিতে ভয় পাবেন চিকিৎসকরা।'
চিকিৎসক লি বলছেন, তাকে বেশ কয়েকবার করোনাভাইরাসের পরীক্ষা করানো হয়েছে এবং সবগুলোই নেগেটিভ হয়েছে। ৩০ জানুয়ারি তিনি আরেকটি পোস্টে লিখেছেন, ‘আজ নিউক্লিক অ্যাসিড পরীক্ষার ইতিবাচক ফলাফল এসেছে। অবশেষে পজিটিভ ফলাফল পাওয়া গেছে।’ তার পোস্টে প্রচুর লাইক পড়ে এবং মন্তব্য আসে।
একমাস পর করোনাভাইরাস নিয়ে প্রথম সতর্ককারী সেই চিকিৎসকই সবার কাছে নায়ক হয়ে উঠেছেন। একজন ওয়েব ব্যবহারকারী লিখেছেন, ‘ড. ওয়েনলিয়াং একজন হিরো।’ ওই মন্তব্যকারী আরও লিখেছেন 'চীনে একটি নিরাপদ জনস্বাস্থ্য তৈরি করার জন্য লাখ লাখ লি ওয়েনলিয়াং দরকার’।
সূত্র: বিবিসি
এএইচ/
আরও পড়ুন