দিল্লিতে কী হচ্ছে?
প্রকাশিত : ১৫:০৬, ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২০
আজ থেকে ৩৬ বছর আগে দিল্লিতে শিখবিরোধী দাঙ্গার কথা সবার নিশ্চয় জানা আছে? ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী তার শিখ দেহরক্ষীর দ্বারা হত্যার শিকার হওয়ার ঘটনা পরবর্তী দাঙ্গায় প্রাণ হারান প্রায় তিন হাজার শিখ।
১৯৯২ সালে বাবরি মসজিদ ধ্বংস নিয়ে ধর্ম নিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসেবে ভারতের বুকে আরেকটি ধর্মীয় যুদ্ধ দেখেছে বিশ্ব। যেখানে অন্তত ২ হাজার মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। গত বছর বহুল আলোচিত এ বিতর্কের অবসান হয় হাইকোর্টের রায়ের মধ্যদিয়ে।
ভারতের বুকে একবিংশ শতাব্দিতে এসে এবার আরেকটি রক্তক্ষয়ী দাঙ্গা রুপ নিতে চলেছে ক্ষমতাসীন বিজেপি সরকারের গৃহীত নাগরিকত্ব সংশোধন আইন (সিএএ) আর নাগরিক পঞ্জিকা (এনআরসি) নিয়ে।
গত বছর ভারতের সপ্তম লোকসভা নির্বাচনে ব্যাপক ভোটে জয় পেয়ে টানা দ্বিতীয়বার সরকার গঠন করে মোদি নেতৃত্বাধীন বিজেপি। ক্ষমতায় এসেই হাত দেন কাশ্মীর ও এনআরসি নিয়ে।
দেশিয় ও আন্তর্জাতিক চাপ উপেক্ষা করে কাশ্মীর দ্বিখণ্ডিত করা হয়। নেয়া হয় ভারতের শাসনাধীনে। যেখানে এখনো ফিরে আসেনি স্বাভাবিক পরিস্থিতি।
এর মধ্যেই যোগ হয় এনআরসি ও সিএএ। চলতি বছরের শুরুতে বিলটি ভারতের পার্লামেন্টে উঠলে শুরু হয় সমালোচানার ঝড়। তা সত্ত্বেও বিলটি পাস হয়। শুরুতেই এটি আসামে প্রয়োগ করা হয়। যেখানে ২০ লাখ মানুষ দেশ ছাড়া হবে বলে ভারতীয় গণমাধ্যমে উঠে আসে। যেখানে শুধু মুসলিমরা নয়, রয়েছে লাখ লাখ হিন্দুও। তবে সরকারের উচ্চ পর্যায়ের বক্তব্যে বলা হয়, হিন্দুরা থাকবে, বাস্তচ্যুত হবে মুসলিমরা।
এমন সিদ্ধান্তের পর থেকেই শুরু হয় আন্দোলন। যা ছড়িয়ে পড়ে দিল্লি থেকে পশ্চিমবঙ্গ পর্যন্ত। যা বর্তমানে সংঘর্ষে রুপ নিয়েছে।
মাঝে অনেকটা নিরবতার পর ভারতে নতুন করে শুরু হয় বিক্ষোভ। এ বিক্ষোভ ঠেকাতে প্রশাসনের বদলে দেখা গেছে ক্ষমতাসীনদের তৎপরতা। বিজেপির উচ্চ পর্যায়ের নেতাদের একের পর এক বক্তব্যে পরিস্থিতি আরও উত্তপ্তের দিকে যায়।
চারদিন আগে শুরু হওয়া এ বিক্ষোভে গত ২৪ ঘণ্টায় নতুন করে আরও ৭ জনের মৃত্যু হয়েছে। এ নিয়ে দিল্লির এ সংকটে ৩৪ জন প্রাণ হারিয়েছেন। আহতের সংখ্যা অন্তত ৩শ। এরমধ্যে গুলিবিদ্ধ হয়েছেন অন্তত ৭০ জন। হতাহতদের মধ্যে হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের লোক রয়েছেন।
চলমান সহিংসতার সবচেয়ে ভীতিকর অবস্থা তৈরি হয়েছে গত মঙ্গলবারের সংঘর্ষে। দিল্লির অশোক নগর এলাকায় মসজিদ থেকে শুরু করে বাড়িঘর পর্যন্ত জালিয়ে দেয়া হয়েছে। যা গণমাধ্যমে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেছে।
সিএএ সমর্থক ও বিক্ষোভকারীদের সংঘর্ষ ও ইট-পাটকেল নিক্ষেপের ঘটনায় সোমবার থেকে উত্তর-পূর্ব দিল্লির কিছু এলাকায় ১৪৪ ধারা জারি করা হয়। কিন্তু সহিংসতা বেড়ে যাওয়ায় এবার সেখানে দেখামাত্র গুলি করার নির্দেশ জারি করা হয়েছে। এমন উত্তেজনাকর পরিস্থিতির কারণে বুধবার দশম ও দ্বাদশ শ্রেণির বোর্ড পরীক্ষা পিছিয়ে দিয়েছে সেন্ট্রাল বোর্ড অফ সেকেন্ডারি এডুকেশন।
এলাকার সরকারি ও বেসরকারি স্কুলও বন্ধ রাখা হয়েছে। দিল্লিতে ৩ দিন ধরে নজিরবিহীন সংঘাতের পর দিল্লি পুলিশ ও আধা-সামরিক বাহিনীর বিপুলসংখ্যক সদস্য নগরীর দাঙ্গা কবলিত এলাকাগুলোয় অবস্থান নিয়েছে। নগরীর দাঙ্গাকবলিত উত্তর-পূর্বাঞ্চলে টান টান উত্তেজনা বিরাজ করছে। কোথাও কোথাও অস্বস্তিকর নীরবতা নেমে এসেছে। বৃহস্পতিবার সকালে এলাকাগুলো যুদ্ধক্ষেত্রের মতো দেখাচ্ছিল বলে প্রত্যক্ষদর্শী সাংবাদিকরা জানান।
এছাড়া গতকাল বুধবার নগরীর চান্দবাগ এলাকায় সিএএ সমর্থক ও বিরোধীদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়েছে। এ সময় চান্দবাগসহ অনেক এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। দাঙ্গাকবলিত এলাকাগুলোয় পুলিশ ও আধা-সামরিক বাহিনীর বিপুলসংখ্যক সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে। পরিস্থিতি ‘ভয়ানক’ বর্ণনা করে দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়াল দাঙ্গাকবলিত এলাকাগুলোয় সেনাবাহিনী মোতায়েনের দাবি জানিয়েছেন।
এদিকে, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি নীরবতা ভেঙে বুধবার দিল্লিবাসীকে শান্তি ও সৌভ্রাতৃত্ব বজায় রাখার আহ্বান জানালেও বুধবার সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রয়েছে বলা হলেও সেখান থেকে একের পর এক মৃত্যুর খবর আসছে। সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ায় কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ ২৪ ঘণ্টায় তিনটি বৈঠক করেছেন। কোনো উসকানিমূলক বক্তব্য না দেয়ার আহ্বান জানিয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
এদিকে, দিল্লির হাইকোর্ট এক আদেশে সহিংসতায় আহতদের জরুরি চিকিৎসা ও জনসাধারণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পুলিশের প্রতি নির্দেশনা দিয়েছেন।
অন্যদিকে, আহতদের বড় হাসপাতালে চিকিৎসার দাবি তোলায় ক্ষমতাসীনদের তোপের মুখে পড়েছেন হাইকোর্টের বিচারপতি মুরলীধর। ইতিমধ্যে তাকে বদলি করা হয়েছে।
এদিকে, চলমান সহিংসতার জন্য পুলিশকে দায়ী করেছেন দেশটির আদালত। পুলিশ ইচ্ছে করলেই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারতো বলে অভিযোগ করেছেন কংগ্রেসনেত্রী সোনিয়া গান্ধী। এমনকি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহকে চলমান সংঘর্ষের জন্য দায়ী করে তার পদত্যাগ দাবি করেছেন তিনি।
চলমান উত্তপ্ত অবস্থা নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে অবস্থা আরও ভয়াবহতার দিকে যাবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তবে নরেন্দ্র মোদি দাঙ্গা এড়াতে কার্যকরি ব্যবস্থা নিবেন বলে আশা করছেন তারা।
আরও পড়ুন