৩ বিয়েতে ৪ সন্তান থাকলেও ২০ প্রেমিকাকে বিষ খাইয়ে খুন
প্রকাশিত : ১৮:১৯, ২৬ মার্চ ২০২০ | আপডেট: ১৮:২৪, ২৬ মার্চ ২০২০
গ্রেফতারের পর মোহন কুমার। ছবি- আনন্দবাজার পত্রিকা
বরপণ দিতে অস্বীকার করেছিল পরিবার বা বহু বার পাত্রপক্ষ থেকে প্রত্যাখান হওয়া মেয়েদের নিশানা করত মোহন কুমার। প্রেমের ফাঁদে ভুলিয়ে মুগ্ধ করত তাদের। তারপর এক দিন ‘হবু স্ত্রী’র হাতে তুলে দিত গর্ভনিরোধক ওষুধের রূপে পটাসিয়াম সায়ানাইড। এমন করে ২০ জন তরুণীকে খুনের দায়ে গ্রেফতার করা হয়েছে ভারতের মোহন কুমার নামে এক স্কুল শিক্ষককে। খবর আনন্দবাজার পত্রিকা’র।
২০০৩ থেকে ২০০৯ পর্যন্ত দক্ষিণ কর্নাটকের পাঁচ জেলার ৬ শহরে ২০ জন তরুণীর অস্বাভাবিক মৃত্যু হয়। মৃত এসব তরুণীদের বয়স ২০ থেকে ৩০ বছর। মৃতদের প্রত্যেকের মরদেহ পাওয়া যায় বাসস্ট্যান্ড লাগোয়া শৌচাগারে। পুলিশকে দরজা ভেঙ্গে মরদেহগুলি বের করতে হয়। এমনটি ঘটনা বরংবার ঘটতে থাকায় এক সময় একটা সূত্র পায় পুলিশ। সূত্রটি হলো, নিহতদের সবার গায়ে ছিল বিয়ের সাজ। কিন্তু কারও গায়ে ছিল না কোনও গয়না। আটটি দেহ পাওয়া গিয়েছিল মহীশূরের লস্কর মোহাল্লা বাসস্ট্যান্ডে। পাঁচটি দেহ উদ্ধার হয়েছিল বেঙ্গালুরুর কেম্পেগৌড়া বাসস্ট্যান্ডের শৌচাগার থেকে। দীর্ঘ দিন ধরে এই ঘটনাগুলোকে এক সঙ্গে গাঁথার চেষ্টা করেনি দশটি থানা পুলিশ। বিষয়গুলোকে অস্বাভাবিক মৃত্যু বা আত্মহত্যা বলে চালিয়ে দেয় থানাসমূহের পুলিশ।
প্রতিটি ক্ষেত্রেই ফরেনসিক টেস্ট বলে, মৃত্যু হয়েছে সায়ানাইডের বিষক্রিয়ায়। তারপরেও মাত্র দু’জনের রক্তের নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছিল। এক বারও তদন্তকারীদের মনে প্রশ্ন জাগেনি, আত্মহত্যার ক্ষেত্রে এ রাসায়নিক সাধারণত ব্যবহার করা হয় না।
তবে সম্পূর্ণ ভিন্ন কারনে বিষয়টি সামনে আসে। ১৯তম মৃত্যুর সময় দেখা দিয়েছিল এলাকা ভিত্তিক দ্বন্দ্ব। ২২ বছরের এক নিহতের পরিবার পুলিশকে অভিযোগ করে, অন্য ধর্মের এক তরুণ তাদের মেয়েকে অপহরণ করে নিয়েছে। স্থানীয়রা তরুণীকে খুঁজতে থানা পুলিশকে চাপ দিলে থানা পুলিশ তাদের তদন্তের গতি বাড়িয়ে দেয়।
প্রথমে হারানো তরুনীর বাড়ির ল্যান্ডলাইনের কললিস্ট পরীক্ষা করে দেখা যায়, গভীর রাতে একটি বিশেষ নাম্বারে ফোন করে দীর্ঘ ক্ষণ কথা বলতেন। সেই নম্বর ছিল এক তরুণীর। তরুণীর খোঁজও পাওয়া যাচ্ছিল না। এভাবে নিখোঁজ তরুণীদের ফোনের সূত্র ধরে সন্ধান পাওয়া গেল কিছু নম্বরের। যেগুলি প্রতিটা কোনও না কোনও তরুণীর নামে। কিন্তু তাঁরা সবাই দীর্ঘ দিন ধরে রহস্যজনকভাবে নিখোঁজ।
আরও একটি যোগসূত্র প্রকাশিত হল। তা হল প্রতিটা নম্বর কোনও না কোনও সময় সক্রিয় ছিল মেঙ্গালুরুর ডেরালাকাট্টে গ্রামে। সেই নম্বরগুলি ধরে আরও অনুসন্ধান চালিয়ে খোঁজ পাওয়া গেল ধনুষ নামে এক কিশোরের। তার কাছে একটি ফোন পাওয়া গেল, যা কোনও এক সময়ে ছিল কাবেরী নামে এক তরুণীর। কিন্তু এখন তিনি নিখোঁজ।
ধনুষ পুলিশকে জানাল তাকে ফোনটা দিয়েছে তার কাকা মোহন কুমার। এ বার তদন্তকারীরা নিশ্চিত হলেন খুনি হয় নারীপাচারকারী, নয়তো সিরিয়াল কিলার। প্রতি বার খুনের পরে নিহত তরুণীর ফোন ব্যবহার করে কথা বলেছে পরের ‘শিকার’র সঙ্গে। তদন্ত শুরু হতে অবশেষে পুলিশের পাতা ফাঁদে পা দিল মোহনকুমার।
গ্রেফতারের পর মোহন কুমার পুলিশকে জানায়, এ পর্যন্ত তিনি ৩২ তরুণীকে ধর্ষণ করে হত্যা করেছে। তাদের সঙ্গে নিয়মিত যৌন সম্পর্কে আবদ্ধ হতেন মোহন। তবে তার বিরুদ্ধে মাত্র ১২টি মামলায় প্রমাণ পাওয়া যায়নি। প্রথমে প্রেমের অভিনয় আর বিয়ের প্রতিশ্রুতিতে তিনি তরুণীদের ফাঁদে ফেলতেন মোহন। পরে নতুন সংসার করার আশায় বাড়ি থেকে স্বর্ণালংকার নিয়ে তার সঙ্গে পালাতেন তরুণীরা। তারপর তরুণীদের সঙ্গে কোনও হোটেলে রাত্রিবাস করত মোহনকুমার। সুযোগ বুঝে নিয়ে যেত বাসস্ট্যান্ডে। পরনে বিয়ের সাজ থাকলেও কৌশলে গয়নাগুলো হোটেলেই রেখে দিতে বাধ্য করত মোহন কুমার। তারপর বলত, বাসস্ট্যান্ড লাগোয়া শৌচাগারে গিয়ে তার দেওয়া গর্ভনিরোধক ওষুধ খেতে। কারণ ওটা খাওয়ার পর অসুস্থ বোধ করতে পারেন তরুণী। নিজের অজান্তেই পটাসিয়াম সায়ানাইড মেশানো ওষুধ খেতেন তরুণীরা। তারপর তাঁদের মৃত্যু নিশ্চিত জেনে হোটেল থেকে গয়না ও অন্য মূল্যবান জিনিস নিয়ে পালিয়ে যেত মোহন কুমার।
মেঙ্গালুরুর এক গ্রামের প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষক ছিল মোহন। পড়াত ইংরেজি, বিজ্ঞান এবং গণিত। আব্দুল সালাম নামে এক বিক্রেতার কাছ থেকে সে পটাসিয়াম সায়ানাইড কিনত। ২০০৩ সালে এর দাম পড়ত কেজি প্রতি ২৫০ টাকা। আব্দুল জানতেন, তাঁর পুরনো ক্রেতা পেশায় স্যাঁকরা। সোনার গয়না পালিশ করার জন্য এই রাসায়নিক নেন।
পুলিশ জানিয়েছে, খুব হিসেব করে তরুণীদের নিশানা করতেন মোহন। অসচ্ছল পরিবার অথচ বিয়ে করতে মরিয়া এমন তরুণীদের বেছে নিতেন তিনি। জেনে নিতেন তাদের ঋতুচক্রের দিনও। সেই বুঝে হোটেলে রাত্রিবাস করত সে। যাতে অবাঞ্ছিত সন্তানপ্রসব আটকাতে তার দেওয়া গর্ভনিরোধক ওষুধ খেতে বাধ্য হন তাঁরা।
গ্রামের স্কুলের ছাত্রী মেরি ছিলেন মোহনের প্রথম স্ত্রী। মেরি যখন সপ্তম শ্রেণিতে, প্রেমের সূত্রপাত। তার আঠেরো বছর বয়স হওয়া অবধি অপেক্ষা করে মোহন। তারপর বিয়ে। কয়েক বছর পরে ডিভোর্সের পরে মেরি চলে গেলে মোহন বিয়ে করে মঞ্জুলাকে। দুই ছেলেকে নিয়ে মঞ্জুলা থাকেন মেঙ্গালুরুর গ্রামে। মোহনের তৃতীয় স্ত্রীর নাম শ্রী দেবী। এক ছেলে, এক মেয়েকে নিয়ে সে থাকে ডেরালাকাট্টে গ্রামে। মোহনের কদর্য পরিচয় জানার পরে শ্রী দেবীও তাকে ছেড়ে সন্তানদের নিয়ে চলে গিয়েছেন। বিয়ে করেছেন যাঁকে, তিনিও এক সময় মোহনের সঙ্গে জেলবন্দি ছিলেন। বন্দি মোহনের সঙ্গে কারাগারে দেখা করতে গিয়েই তার সঙ্গে আলাপ হয়েছিল শ্রী দেবীর।
পাঁচটি মামলায় মৃত্যুদণ্ড এবং তিনটি ঘটনায় যাবজ্জীবন কারাবাসে দণ্ডিত হয়েছেন মোহন কুমার। মেঙ্গালুরুতে জেলবন্দি এই সিরিয়াল কিলার এখনও স্মিত হেসে তার বয়ানে জানান তিনি নির্দোষ। তার প্রেমে প্রত্যাখ্যাত হয়েই আত্মঘাতী হন তরুণীরা।
এমএস/
আরও পড়ুন