চীনের পার্শ্ববর্তী দেশ হয়েও যেভাবে করোনা রুখে দিল তাইওয়ান
প্রকাশিত : ১৬:২২, ২৭ মার্চ ২০২০
বিশ্বজুড়ে মহামারি আকার ধারণ করা করোনা ভাইরাস এখন এক আতঙ্কের নাম। করোনা ভাইরাস মহামারিতে পুরো বিশ্ব যখন লড়াই করছে, তখন এর বিরুদ্ধে সফল হওয়ার দৃষ্টান্ত দেখাচ্ছে তাইওয়ান। করোনা ভাইরাসের উৎপত্তিস্থল চীনের খুব কাছাকাছি তাইওয়ানের অবস্থান হলেও এখন পর্যন্ত সেখানে মাত্র ৪৯ জন আক্রান্ত হয়েছেন। আর মারা গেছেন মাত্র একজন। আসুন জেনে নেই যেভাবে করোনা রুখে দিল তাইওয়ান।
২০০৩ সালে তাইওয়ানের সেন্টারস ফর ডিজিজ কন্ট্রোলের পরিচালক সু ইহ-জেনকে সার্সের বিরুদ্ধে লড়াই করতে হয়েছিল। ওই সময় দেশটিতে সার্স ভাইরাস মারাত্মক প্রভাব ফেলেছিল। কিন্তু এবারের চিত্র সম্পূর্ণ আলাদা। এখানকার সাড়ে আট লাখ মানুষ চীনের মূল ভূখণ্ডে কাজ করেন। একেবারে চীনা নববর্ষের সময় করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শুরু হওয়ায় বিশেষজ্ঞরা তাইওয়ান বড় বিপদে পড়তে যাচ্ছে বলে পূর্বাভাস দিয়েছিলেন।
ফিন্যান্সিয়াল টাইমসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০০৩ সালের ওই সার্স মহামারির পর অধ্যাপক সু তাইওয়ানের পুরো পাবলিক হেলথ সিস্টেম পরিবর্তন করে ফেলেন।
তাইওয়ান প্রথমেই প্রাথমিক স্তরের ভ্রমণের বিধিনিষেধ, আগ্রাসী পরীক্ষা, করোনাভাইরাস রোগীর সংস্পর্শে আসা ব্যক্তিদের শনাক্ত করা এবং কঠোর কোয়ারেন্টিন বা পৃথক্করণ বিধিমালা অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে প্রয়োগ শুরু করে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) পক্ষ থেকে যদিও চীন থেকে শিক্ষা নেয়ার কথা বলা হচ্ছে, তবু স্বাস্থ্য খাতের বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, তাইওয়ান মহামারি মোকাবিলায় পশ্চিমাসহ সব আক্রান্ত দেশের জন্য আরও ভালো মডেল হতে পারে।
সংক্রামক রোগের শীর্ষস্থানীয় বিশেষজ্ঞ এবং সেন্ট্রাল এপিডেমিক কমান্ড সেন্টারে বিশেষজ্ঞের পরামর্শদাতা প্যানেলের আহ্বায়ক চ্যাং শান-চয়েন বলেন, ‘আমাদের প্রতিক্রিয়া সাফল্যের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কারণ স্বচ্ছতা। চীনের মতো স্বৈরাচারী ব্যবস্থায় প্রতি নাগরিককে বাড়িতে থাকতে বললে তারা তা পালন করবে। কিন্তু মুক্ত ও গণতান্ত্রিক দেশগুলোয় তা সহজে অর্জন করা যায় না।
স্ট্যানফোর্ড হেলথ পলিসির বিশ্লেষণে বলা হয়, সার্স ভাইরাসের সময় গৃহীত সুনির্দিষ্ট কৌশল ও পরিকল্পনামাফিক শুরুতেই গৃহীত ব্যবস্থাকেই তাইওয়ানের সফলতার জন্য কৃতিত্ব দেয়া যায়। সার্স আক্রমণের পর তাইওয়ানের পক্ষ থেকে ন্যাশনাল হেলথ কমান্ড সেন্টার স্থাপন করা হয়। এর একটি বিশেষ শাখাকে বড় ধরনের মহামারির সময় কী ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখাতে হবে তার জন্য দায়িত্ব দেয়া হয়। এটি সরাসরি, স্বচ্ছ যোগাযোগের জন্য একটি কেন্দ্রীয় কমান্ড পোস্ট হিসেবে কাজ করে। এটি করোনায় আক্রান্ত ব্যক্তিদের শনাক্ত করা ও কোয়ারেন্টিনে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে শুরু করে।
তাইওয়ান আনুষ্ঠানিকভাবে তাদের সেন্টার এপিডেমিক কমান্ড সেন্টার (সিইসিসি) সক্রিয় করে গত ২০ জানুয়ারিতে। এতে ইতিমধ্যে বিদ্যমান নীতি ও কৌশল কার্যকর করতে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করে। গত দুই মাসে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে নেতৃত্বে দ্রুততার সঙ্গে সিইসিসি ১২৪টি কার্যক্রম সম্পন্ন করে। এ কার্যক্রমগুলোর মধ্যে বেশ কিছু কার্যক্রম একাধিক সংস্থার সহযোগিতায় সম্পন্ন হয়। এর মধ্যে ছিল আকাশপথ ও সমুদ্রপথে সীমানা নিয়ন্ত্রণ, করোনায় আক্রান্ত রোগী শনাক্তকরণ, সন্দেহভাজন রোগীকে কোয়ারেন্টিন করা, বরাদ্দ সম্পদ ব্যবস্থাপনা, দৈনিক সংবাদ ব্রিফিং, ভুয়া তথ্য শনাক্তকরণ এবং ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসা ও পরিবারের জন্য অর্থনীতি নীতিমালা ঠিক করা।
করোনাভাইরাস মহামারি মোকাবিলায় বিগ ডেটা এবং প্রযুক্তি সংযুক্ত করে তাইওয়ান সরকারের পক্ষে প্রচুর কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া সম্ভব হয়েছে। এক দিনেই তাইওয়ান সরকার ন্যাশনাল হেলথ ইনস্যুরেন্স অ্যাডমিনিস্ট্রেশন অ্যান্ড ইমিগ্রেশন এজেন্সির কাছ থেকে যাত্রীদের ১৪ দিনের ভ্রমণের তথ্য বের করে। এখান থেকে রোগী শনাক্ত করার কাজ করে। এ ছাড়া নাগরিকদের বাড়ির নিবন্ধন পদ্ধতি ও বিদেশিদের আগমনসংক্রান্ত তথ্য বিশ্লেষণ করে ঝুঁকিপূর্ণ রোগী শনাক্ত করে। ঝুঁকিপূর্ণ ব্যক্তিদের শনাক্তের পর কোয়ারেন্টিন ও তাদের মোবাইল ফোনের মাধ্যমে নজরদারির ব্যবস্থাও করে তাইওয়ান সরকার। সরকারের পক্ষ থেকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা নির্ধারণ করা এবং বাজারে মাস্কের সরবরাহের বিষয়টিও লাইভ ম্যাপের মাধ্যমে নির্ধারণ করা হয়।
এছাড়া দৈনিক সংবাদ ব্রিফিং ছাড়াও সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা নিয়মিত সম্ভাব্য সব অনলাইন ব্যবস্থার মাধ্যমে ভ্রমণ, ব্যক্তিগত স্বাস্থ্য সুপারিশসহ নানা ঝুঁকি সম্পর্কে জনগণের সামনে ঘোষণা নিয়ে হাজির হন। পাবলিক ও প্রাইভেট খাত থেকেও সরকারকে নানা পরামর্শ দিয়ে সহযোগিতা করা হয়। কার্যত, প্রতিটি দোকান, রেস্তোরাঁ অফিস ভবনে ঢোকার আগে হ্যান্ড স্যানিটাইজার এবং তাপমাত্রা মাপার ব্যবস্থা করা হয়। এর বাইরে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে ভুয়া তথ্যের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়।
এমবি//
আরও পড়ুন