একান্ত সাক্ষাৎকারে কামাল লোহানী
বঙ্গবন্ধু বললেন ‘তুই আমাকে লিডার বলে ডাকিস না’
প্রকাশিত : ১৫:৫৮, ৭ মার্চ ২০১৮ | আপডেট: ১৫:৩৪, ১৯ মার্চ ২০১৮
কামাল লোহানী। বাংলাদেশের একজন বলিষ্ঠ সাংবাদিক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব। তিনি ‘দৈনিক আজাদ’, ‘দৈনিক সংবাদ’, ‘দৈনিক পূর্বদেশ’, ‘দৈনিক বার্তা’সহ বিভিন্ন দৈনিকে কাজ করেছেন। তিনি পূর্ব পাকিস্তান সাংবাদিক ইউনিয়নের দু’দফায় যুগ্ম-সম্পাদক এবং ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি পদে দায়িত্ব পালন করেন। সাংবাদিকতায় অসামান্য অবদানের জন্য একুশে পদক পান ২০১৫ সালে।
এছাড়া তিনি ছিলেন গণশিল্পী সংস্থার সভাপতি। ১৯৬২ সালে স্বল্পকাল কারাবাসের পর কামাল লোহানী ছায়ানট-এর সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। সাড়ে চার বছর এই দায়িত্ব পালন করেন। এরপর মার্কসবাদী আদর্শে ১৯৬৭ সালে গড়ে তোলেন ‘ক্রান্তি’।
মুক্তিযুদ্ধের সময় এবং তার পরবর্তীকালে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন সক্রিয়ভাবে। আজ ৭ মার্চ একুশে টেলিভিশন (ইটিভি) অনলাইনের সঙ্গে একান্ত আলাপচারিতায় মুক্তিযুদ্ধ এবং বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে স্মৃতিচারণ করেন তিনি। আলাপচারিতায় উঠে আসে মুক্তিযুদ্ধের আগে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে একসেলে থাকার অভিজ্ঞতার বিষয়টিও। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন- সোহাগ আশরাফ।
ইটিভি অনলাইন : কেমন আছেন?
কামাল লোহানী : বেশ ভালো আছি। তবে চোখে দেখি না। মনের শক্তি দিয়ে চলে যাচ্ছি।
ইটিভি অনলাইন : শরীরের এখন যে অবস্থা আপনার তো পুরোপুরি বিশ্রামে যাওয়া দরকার। তারপরেও দেখা যায় আপনি বিভিন্ন সময় বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অংশ নিচ্ছেন। এই শক্তিটা কোথা থেকে পান?
কামাল লোহানী : পুরোপুরি মানসিক শক্তি। এই শক্তিটা তৈরি হয় রাজনীতির যে বিশ্বাস সেই বিশ্বাসের উপরে। রাজনীতিটা যদি আদর্শিক হয়, আদর্শ ভিত্তিক হয় তবে সেটা আরও অনেক বেশি শক্তিশালী হয়। সেই শক্তিটা মানুষকে ভীষণভাবে সাহসী করে তোলে। সেজন্যই আমার এই ৮৪ বছর বয়সেও, এমনকি চোখের দৃষ্টি বলতে গেলে একেবারেই নেই, সেই অবস্থাতেও আমি যে কোন জায়গায় চলে যেতে পারি। হয়তো কোনো বন্ধুর হাত ধরে আমি চলাফেরা করি। তবে যখন মানুষের কাছে গিয়ে কথা বলি তখন আমার আত্মশক্তি অনেক বেড়ে যায়।
ইটিভি অনলাইন : অবসরটা কিভাবে কাটে?
কামাল লোহানী : সকালে আমার স্মৃতিকথাটা লেখাই। একজন ভদ্রলোক আছেন যিনি শ্রুতিলিখন করেন। একটা ছেলে। আর বিকেলে অবধারিত কোন না কোন অনুষ্ঠানে যেতে হয়। এভাবেই কাটছে।
ইটিভি অনলাইন : আমরা কি এই স্মৃতিকথার বইটি এ বছরই পাবো?
কামাল লোহানী : কথা ছিল এবছর আমার জন্মদিন ২৬ জুনে ওটা প্রকাশ করা। কিন্তু আমার মনে হচ্ছে এই বয়সে এসে কিছু স্মৃতিবিভ্রাট হচ্ছে। সুতারাং এটা প্রথমে লিখবো। পরে এটা পাঠ করা হবে। সেখানে কোন কোন জায়গাটা বাদ গেলো সেটা ঠিক করবো। এরপর আমি চূড়ান্ত করার পরে এটা আমার ছেলে কে দিবো। ও মুক্তিযুদ্ধের উপর, বাংলার সংগ্রামের ইতিহাসের উপরে গবেষণা করছে। ডকুমেন্ট্রি করার জন্য। আমার দেখার পর স্মৃতিকথাটা ওকে দিবো। ও এর সন, তারিখ, আন্দলোনের নাম এগুলো ঠিক আছে কিনা এটা দেখবে। এরপর সে যখন ওকে করবে তখন হয়তো প্রকাশে যাবো। তাই মনে হচ্ছে না যে এটা এ বছর হবে। আগামী জুন অথবা আগামী পহেলা বৈশাখে প্রকাশ হবে।
ইটিভি অনলাইন : বঙ্গবন্ধুর সাথে আপনার প্রথম সরাসরি দেখা হয়েছিল কত সালে?
কামাল লোহানী : ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টে যখন নির্বাচন হয় তখন তার প্রচার অভিযানের সময় প্রথমবার সরাসরি দেখা হয়েছিল।
ইটিভি অনলাইন : বঙ্গবন্ধুর সাথে একবার একসাথে মাস তিনেক জেলও তো খেটেছিলেন। সেটা কত সালে? ঘটনাটা জানতে চাই।
কামাল লোহানী : ১৯৬২ সাল। সে বছর আমাদের তিনজন সাংবাদিকের নামে হুলিয়া জারি হল। ১৯৬২ সালে ছাত্র আন্দোলন হল। সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে ছাত্ররা যে আন্দোলন করেছিল তার ফলে ব্যাপক গ্রেফতার করা শুরু হল। সেখানে সাংবাদিকদের মধ্যে আমি, মাইদুল হাসান, আর দৈনিক ইত্তেফাকের নুরুল ইসলাম- এই তিনজনের বিরুদ্ধে হুলিয়া জারি হল। হুলিয়া তো গোপন থাকে, আমরা ডিটেইলস কিছু জানতে পারলাম না। আমি তখন দৈনিক আজাদে চাকুরী করি। দৈনিক আজাদ থেকে অফিস করে রাত আড়াইটার সময় যখন বের হলাম তখন চারপাশ থেকে মিলিটারির লোক এসে আমাকে ঘিরে ফেললো। আমাকে বলল যে, তুমি এরেস্ট, তোমার নামে হুলিয়া আছে। এরপর সারারাত লালবাগ থানায় রাখার পর সকালে আমাকে ঢাকা সেন্ট্রাল জেলে নিয়ে যাওয়া হল। ঢাকা সেন্ট্রাল জেলে যাওয়ার পর ২৬ নম্বর সেলে আমাকে পাঠিয়ে দেওয়া হল। ২৬ নম্বর সেলে গিয়ে দেখি শেখ মুজিবুর রহমান, তাজউদ্দীন আহমদ, রণেশ দাশগুপ্ত, বরিশালের অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম, বদরুদ্দোজা চৌধুরীর বাবা কফিলউদ্দিন আহমদ চৌধুরী, আবুল মুনসুর আহমদ- তিনি একসময় পাকিস্থানের অস্থায়ী প্রধানমন্ত্রীও হয়েছিলেন, তোফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া- এঁরা সবাই সেখানে। এনাদের দেখে তো আমি বিস্মিত হয়ে গেলাম। বঙ্গবন্ধু আমাকে দেখে স্বাগত জানালেন। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে প্রায় সাড়ে তিন মাস ছিলাম কারাগারে।
ইটিভি অনলাইন : তাঁর সঙ্গে অনেকগুলো দিন জেলে কেটেছে। খুব কাছে পেয়েছেন তাঁকে। বঙ্গবন্ধু যে রাজনৈতিক আদর্শের লোক ছিলেন আপনি ছিলেন তা থেকে ভিন্ন। সে সময় থেকেই আপনি বাম দল করতেন। বঙ্গবন্ধুও তা জানতেন। তারপরও আপনি তাকে লিডার বলতেন, কেন?
কামাল লোহানী : তার নেতৃত্বের যে গুন, তার ভাষণে যে তেজ এবং সাংগঠনিক যে শক্তি এগুলো মিলিয়ে তাকে আমার কাছে তখন মনে হলো এই ভদ্রলোককে কি বলে ডাকবো? মুজিব ভাই বলে ডাকবো নাকি লিডার বলবো। তখন থেকেই লিডার বলে ডাকা শুরু করলাম। আমি যখন লিডার বলে সম্বোধন করলাম তখন তিনি বললেন, ‘তুই আমাকে লিডার বলে ডাকিস না, আমি তো তোর লিডার না, আমি জানি তোর লিডার কে’।
তার পরেও এই যে একটা পারষ্পারিক সম্পর্ক এবং হৃদরতা পূর্ণ সম্পর্ক এটাই ওই জেলখান থেকেই তৈরি হয়েছিল। ওনাকে যে আমি লিডার বলে ডাকতাম তার পেছনে আরও একটা যুক্তি ছিল। আমরা জেলখানায় সময় কাটানোর জন্য খেলাধুলা, পড়াশুনা এগুলোই করতাম। বিকেলে আমরা যখন খেলাধুলা করতাম, আমি বলি বল খেলতাম, উনিও বলি বল খেলতেন। আমরা সেখানে যারা ছিলাম তাদের মধ্যে দুটি দল হয়েছিল। এক দলে আমি এবং বঙ্গবন্ধু এক সঙ্গে খেলেছি। উনি আমাকে দলের ক্যাপ্টেন বানালেন। আমাকে তিনি ক্যাপ্টেন বলেই ডাকতেন। এই যে একটা মধুর সম্পর্ক এটা তাঁর সঙ্গে তৈরি হয়েছিল।
ইটিভি অনলাইন : বঙ্গবন্ধু যখন ৭ মার্চের ভাষণ দেন তখন আপনি কোথায় ছিলেন?
কামাল লোহানী : আমি মঞ্চের উত্তর দিকে অল্প দূরত্বে দাঁড়িয়ে ছিলাম। আমি শুধু না, আমার সঙ্গে আতাউস সামাদ, সলিমুল্লাহ এবং কবি মহাদেব সাহাও ছিলেন। আমরা চারজন প্রেসক্লাব থেকে হেটে রেসকোর্স ময়দানে আসলাম। এসে আমরা জায়গা নিলাম ঠিক মঞ্চের উত্তর পাশে। উদ্দেশ্য ছিল যেনো বঙ্গবন্ধুকেও দেখতে পাই আর তার ভাষণও শুনতে পাই।
ইটিভি অনলাইন : ওই সময় ভাষণ শোনার পরে কেমন অনুভুতি হয়েছিলো?
কামাল লোহানী : আমাদের কতগুলো ব্যাপার ছিল। আমরা ভাবছিলাম যে ৭ই মার্চে বঙ্গবন্ধু নিশ্চই স্বাধীনতার ঘোষণা সরাসরি দিয়ে ফেলবেন। কিন্তু সেটা আমরা পাইনি। তবে তিনি যে কথাগুলো ওই সময় বলেছিলেন সেই কথার পরিপ্রেক্ষিতে প্রত্যেকেরই ধারণ হয়েছিল এরপরে আমাদের দেশের মানুষ যেভাবে বিক্ষুব্ধ পাকিস্তানের দুঃশাসনের বিরুদ্ধে এবং সামরিক যান্তার বিরুদ্ধে। তাতে অবশ্যই তারা আর ঘরে বসে থাকবে না। বঙ্গবন্ধুর যে আহ্বান, তার যে বক্তব্য- তা জনগণ মনের মধ্যে ধারণ করেছে। ওই যে শেষ কথাটি তিনি বললেন- ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। সবাই এটাকেই ধরে নিলো এটাই স্বাধীনতার ঘোষণা। আর এজন্যই সবাই মাতৃভূমিকে মুক্ত করার জন্য নিজের জীবন বিসর্জন দিতে প্রস্তুতি গ্রহণ করলো।
ইটিভি অনলাইন : এই বক্তব্য শোনার পর সাংবাদিকদের ভূমিকা কেমন ছিল?
কামাল লোহানী : তখন আমি সাংবাদিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক ছিলাম। আমরা সাংবাদিক ইউনিয়ন কিন্তু দেশের যত গণতান্ত্রীক আন্দলোন ছিল সেই আন্দলোনের সঙ্গে গেছি। সব সময় রাজপথে থেকেছি। সংবাদ পত্রে খবর পরিবেশনের মাধ্যমে সহযোগিতা করেছি। ওই সময় সরকারি সেন্সর ছিল। তা উপেক্ষা করে নানা কৌশলে আমরা বিরোধীদলীয় যে বক্তব্য সেগুলোকে তুলে ধরেছি। সাংবাদিক হিসেবে যে ঐক্য তখন ছিল সেই ঐক্যটাই আমাদের শক্তি এনে দিয়েছিল। আর এজন্য আমরা সমষ্টিগতভাবে শক্তি নিয়ে কাজটি করতে পারতাম।
এসএ/
আরও পড়ুন