বঙ্গবন্ধু জনগণকে বুঝতে পারতেন: শাহরিয়ার কবির
প্রকাশিত : ১৯:২২, ১৭ মার্চ ২০১৮ | আপডেট: ১৫:৩১, ১৯ মার্চ ২০১৮
বঙ্গবন্ধু তাঁর রাজনৈতিক লক্ষ্যে সবসময় স্থির ছিলেন। স্বাধীনতার প্রশ্নে তিনি অটুট ছিলেন। জনগণের আওয়াজ তাঁর কণ্ঠ থেকে উৎসারিত হতো। তাই সমসাময়িক অনেক নেতাকে ডিঙিয়ে তিনি ইতিহাসে স্থান করে নিতে পেরেছেন। এমনটাই মনে করেন একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মদিনে একুশে টেলিভিশন অনলাইনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি এসব মন্তব্য করেন। এসময় তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধুর দর্শনের সবচেয়ে বিস্ময়কর দিক `ধর্মনিরপেক্ষতা`। ঐ সময় দেশে ৮৫ শতাংশ লোক ছিল মুসলমান। সেই প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের মতো একটি দেশের সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা সংযোজন করা একটি বিস্ময়কর ব্যাপার। যা আমাদের সংবিধানকে একটি উচ্চ মর্যাদা দিয়েছিল। তবে বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দর্শন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী পুরোপুরি বাস্তবায়নে সফল হননি বলেও মন্তব্য করেন একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির এই নেতা। নারী নীতি, শিক্ষা নীতি সহ বিভিন্ন প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, ত্রিশ লক্ষ শহীদের উত্তরাধিকারীত্ব ও বঙ্গবন্ধুর দর্শন বাস্তবায়ন করতে পারলে দেশকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যাওয়া সম্ভব। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন একুশে টেলিভিশন অনলাইন প্রতিবেদক আলী আদনান।
একুশে টেলিভিশন অনলাইন: বঙ্গবন্ধুর উথানের আগেও এদেশে অনেক রাজনীতিবিদ ছিলেন। তাঁরাও দেশকে ভালবাসতেন। তাঁদের তুলনায় বঙ্গবন্ধুর বিশেষত্ব কী?
শাহরিয়ার কবির: অন্যান্য রাজনৈতিক নেতারা দেশ ও দেশের মানুষকে ভালবাসতেন তা ঠিক। কিন্তু একটি সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যে কেউ হাঁটেন নি। বঙ্গবন্ধু প্রথম উপলব্ধি করেছিলেন, পাকিস্তানিদের সাথে আমাদের হবেনা। সেই চিন্তা থেকে তিনি সরাসরি স্বাধীনতায় বিশ্বাস করতেন। দ্বিতীয়ত, বঙ্গবন্ধু সব সময় তার সিদ্ধান্তে স্থির ছিলেন। অন্য অনেক নেতা স্থিরতা বজায় রাখতে পারেননি। বঙ্গবন্ধু জনগণের ইচ্ছা বা চাওয়ার জায়গায়টা বুঝতে পারেন। তার কোন সিদ্ধান্ত কখনো জনগণের ইচ্ছার বিরুদ্ধে যায়নি। বরং জনগণের আওয়াজটা তার কণ্ঠ দিয়ে বের হয়েছে। এটাই মূলত তাঁর বিশেষত্ব।
একুশে টেলিভিশন অনলাইন: বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দর্শনের স্বরূপ কী?
শাহরিয়ার কবির: বঙ্গবন্ধু খুব বেশি লেখেননি। `অসমাপ্ত আত্মজীবনী` ও `কারাগারের রোজনামচা ` ছাড়া তাঁর অন্য কোন লেখা আমাদের চোখে পড়ে না। এই দুটি বই ও তার অসংখ্য বক্তৃতা শুনে আমরা বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দর্শন সম্পর্কে একটা ধারনা পাই। সেখান থেকে বুঝতে পারি তাঁর রাজনৈতিক দর্শন বাঙালি জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র নির্ভর। তবে বঙ্গবন্ধুর গণতন্ত্র ও আব্রাহাম লিংকনের গণতন্ত্র এক নয়। বঙ্গবন্ধুর গণতন্ত্র হচ্ছে শোষিতের গণতন্ত্র। একই ভাবে সমাজতন্ত্র নিয়েও ভিন্ন পরিকল্পনা ছিল তাঁর। তিনি তথাকথিত ভাবে সোভিয়েত ইউনিয়ন বা চীনের সমাজতন্ত্রের অনুসারী হতে চাননি। বরং বাংলাদেশের মাটিতে, বাংলার মানুষের উপযোগী করে শোষিত মানুষের মুক্তির জন্য কিছু একটা করতে চেয়েছিলেন। ঠিক একই ভাবে তাঁর `ধর্মনিরপেক্ষতা` ও পাশ্চাত্যের ধর্মনিরপেক্ষতা এক জিনিস নয়। প্রত্যেকটি আলাদা আলাদা ব্যাখ্যার অবকাশ রাখে।
একুশে টেলিভিশন অনলাইন: বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দর্শনের কোন বিষয়টা আপনার কাছে বিস্ময়কর মনে হয়?
শাহরিয়ার কবির: ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহার বন্ধে বঙ্গবন্ধুর যে চিন্তা ও পদক্ষেপ তা আমার কাছে বড় বিস্ময়। বাংলাদেশের বেশির ভাগ মানুষ অসচেতন ও নিয়তি নির্ভর। সেখানে
অরো ছেচল্লিশ বছর আগে তিনি সংবিধানে `ধর্মনিরপেক্ষতা` নিয়ে এসে যে সৎ সাহস দেখিয়েছেন তা বিস্ময়কর। তার একটা বড় কারণ হলো তিনি দেখেছেন, পাকিস্থান এদেশে যতো শোষণ চালিয়েছে তা ধর্মের নামেই চালিয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের সময় এখানে যতো খুন - ধর্ষণের ঘটনা ঘটে তা ধর্মের নামেই হয়েছে। ৪৭- এ দেশ ভাগের ঘটনা বঙ্গবন্ধু খুব কাছ থেকে প্রত্যক্ষ করেছেন। তখনো ধর্মের নামে সাম্প্রদায়িক হানাহানি দেখেছেন তিনি। সব মিলিয়ে তিনি বুঝেছিলেন এদেশকে সবার বাসযোগ্য করতে হলে ধর্মীয় বিষবাষ্প মাথাচাড়া দেওয়ার সুযোগ দেওয়া যাবেনা। আমি পৃথিবীর বিভিন্ন রাষ্ট্রে অনেক বড় বড় রাষ্ট্রবিজ্ঞানীর সাথে বথা বলে দেখেছি, তিনি এ জায়গায় খুব বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়েছেন।
একুশে টেলিভিশন অনলাইন: এমন রাজনৈতিক উদারতা ও বিচক্ষণতা সর্বোপরি মহান মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক হওয়া সত্ত্বেও বঙ্গবন্ধুকে একটি রাজনৈতিক দলের নেতা বা আদর্শ হিসেবে চিহ্নিত করছি। এ ব্যাপারটির জন্য দায়ী কে?
শাহরিয়ার কবির: আমাদের দুর্ভাগ্য হলো যার ডাকে, যার নেতৃত্বে আমরা মুক্তিযুদ্ধ করেছি, দেশ স্বাধীন করেছি, সেই আমরাই মাত্র তিন বছরের মাথায় তাকে হত্যা করি। শুধু হত্যা করেই ক্ষান্ত থাকিনি। বরং তাঁর সব অর্জন ও প্রচেষ্টাকে মুছে দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের বিপরীতে চাকা ঘুরাতে শুরু করি। এর ভেতর দিয়ে প্রচারণা শুরু হয় বঙ্গবন্ধু আওয়ামী লীগের, জয় বাংলা আওয়ামী লীগের -এমনকী মুক্তিযুদ্ধও আওয়ামী লীগের। কিন্তু এটাতো শুধু আওয়ামী লীগের একা যুদ্ধ ছিলনা। এটা ছিল একটা গণযুদ্ধ। যদিও বা সব জায়গায় তখন নির্বাচিত আওয়ামী লীগ সরকারের প্রতিনিধি ছিল- তথাপি যুদ্ধের একনায়ক বঙ্গবন্ধু। সেই বিবেচনায় তিনি সব বিতর্কের ঊর্ধ্বে। তিনি জাতির প্রতীক, জাতিস্বত্ত্বার প্রতীক।
একুশে টেলিভিশন অনলাইন: বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধুর আদর্শ বাস্ততবায়নে কতটুকু সফল বলে মনে করছেন?
শাহরিয়ার কবির: প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধুর চেয়ে অনেক বেশি সময় ও সুযোগ পেয়েছেন। রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে তিনি অনেক সফলতা দেখিয়েছেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর আদর্শ বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী পুরোপুরি সফল হয়েছেন সেটা অন্তত আমি বলবো না। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন ছিল ৭২- এর সংবিধান। যা এখনো কার্যকর হয়নি। এখনো বাংলাদেশে ধর্মের নামে রাজনীতি চর্চা হয়। এখনো সংবিধানে ধর্মের ছাপ রয়ে গেছে। যা দিয়ে সাম্প্রদায়ীকীকরণ হচ্ছে। সংবিধানের এই বিকৃতি থেকে আমরা এখনো বের হতে পারিনি। ড. কুদরত ই- খুদা শিক্ষা কমিশনে বঙ্গবন্ধু পরিষ্কার ভাবে বলেছেন, শিক্ষা হবে একমুখী শিক্ষা। ২০০৯ সালে অধ্যাপক কবির চৌধুরীর নেতৃত্বে একটা শিক্ষানীতি হয়েছিল।
বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে কিন্তু হেফাজতের বিরোধীতায় সেই শিক্ষানীতিও আলোর মুখ দেখেনি। প্রথমবার আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে খুব সুন্দর একটা নারী নীতি করেছিলেন। পরবর্তীতে খালেদা জিয়া সেটা বাতিল করে দেয়। আওয়ামী লীগ দ্বিতীয়বারে ক্ষমতায় এসে তা চালু করতে গিয়ে বাধার মুখে পড়ে। যদিও বিশ্বের সব জায়গায় দক্ষিণ পন্থাদের উথান ঘটছে তথাপি এটাও স্বীকার করতে হবে আমাদের ত্রিশ লক্ষ শহীদের উত্তরাধিকারীত্ব রয়েছে। সেই উত্তরাধিকারীত্ব ও বঙ্গবন্ধুর যে দর্শন তার মিশ্রনে দেশকে বিশ্বের সর্বোচ্চ মর্যাদায় নিয়ে যাওয়া সম্ভব এবং আমরাও সেটা চাই।
একুশে টেলিভিশন অনলাইন: আমাদের সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ।
শাহরিয়ার কবির: আপনাকেও ধন্যবাদ।
টিকে
আরও পড়ুন