ভেজাল বিরোধী অভিযান
‘ভোক্তার অভিযোগ সাত দিনের মধ্যেই নিষ্পত্তি’
প্রকাশিত : ২৩:৩১, ১৭ মার্চ ২০১৮ | আপডেট: ১৫:৩২, ১৯ মার্চ ২০১৮
পণ্যে ভেজাল দেওয়া, অ-স্বাস্থ্যকর পরিবেশে খাদ্যদ্রব্য তৈরি ও বিক্রি, মেয়াদোত্তীর্ণ পণ্য বিক্রি এবং ওজন কম দেওয়াসহ বিভিন্ন অনিয়ম রুখতে কাজ করছে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর। বাজারে যেকোনো ধরনের অনিয়মের অভিযোগ পেলে দ্রুত তদন্ত করে কার্যকর ব্যবস্থা নিচ্ছে ভোক্তা অধিদফতর। ভোক্তারা এখন সচেতন হওয়ায় অভিযোগ সংখ্যা বাড়ছে। সঠিক অভিযোগদাতাকে আদায়কৃত জরিমানার এক চতুর্থাংশ দেওয়ায় অনেকেই ব্যবসায়ীদের অসাধু তৎপরতার বিরুদ্ধে অভিযোগ করতে আগ্রহী হচ্ছেন। এর ফলে ভোক্তাদের আস্থা অর্জন করতে শুরু করেছে অধিদফতর।
অপর দিকে ব্যবসায়ীরা অধিক দামে পণ্য বিক্রি করলেও এখনও অনেক ভোক্তাই জানেন না তাদের অধিকার বা এর প্রতিকার বিষয়। যদিও ভোক্তার স্বার্থ রক্ষায় সরকার বিভিন্ন উদ্যেগ নিয়েছে। প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে ভোক্তা সংরক্ষণ অধিদফতর, নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ, প্রতিযোগিতা কমিশন।
জাতীয় ভোক্তা সংরক্ষণ অধিদফতর গত নয় বছরে বাজার তদারকির মাধ্যমে পণ্যে ভেজাল, মূল্য কারসাজিসহ বিভিন্ন অপরাধে ৩৭ হাজার ৩৯২টি প্রতিষ্ঠানকে দোষী সাব্যস্ত করেছে। এসব প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে আদায় করা হয়েছে ২৮ কোটি ৭৬ লাখ ৮৭ হাজার ৩শ’ টাকা। এ সময়ের মধ্যে ৯ হাজার ৮৫১টি বাজারে অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে।
ভোক্তা অধিদফতরের সামগ্রিক কার্যক্রম নিয়ে একুশে টেলিভিশন অনলাইনের (ইটিভি অনলাইন) মুখোমুখি হয়েছেন জাতীয় ভোক্তা সংরক্ষণ অধিদফতরের মহাপরিচালক মো. শফিকুল ইসলাম লস্কর। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন ইয়াসির আরাফাত রিপন।
একুশে টেলিভিশন অনলাইন: ভোক্তাদের সচেতন করতে আপনারা কী ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছেন?
মো. শফিকুল ইসলাম লস্কর: ভোক্তাদের সচেতন করতে আমরা বছরব্যাপী সারাদেশে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছি। এরমধ্যে আমরা সারাদেশে ২০১৭-২০১৮ অর্থবছরের ১৪ মার্চ পর্যন্ত ৪০৩টি গণশুনানি করেছি যা গত ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ছিল ৩৫৯টি, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ছিল ৮টি। সব মিলিয়ে আমরা ৭৭০টি গণশুনানী করেছি। তাছাড়া ২০১৭-১৮ অর্থবছরের ১৪ মার্চ পর্যন্ত আমরা ৪৮৯টি মতবিনিময় সভা করেছি। যা ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ছিল এক হাজার ২৮৩টি, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ছিল ১ হাজার ৫০টি।
তবে মনে রাখতে হবে শুধু অধিদফতরের মাধ্যমেই ভোক্তার অধিকার সংরক্ষণ করা যাবে না। এ জন্য চাই ভোক্তাদের সচেতনতা। তারা সচেতন হলেই ভোক্তার অধিকার আদায় হবে।
একুশে টেলিভিশন অনলাইন: অধিদফতরে কি ধরণের অভিযোগ আসে?
মো. শফিকুল ইসলাম লস্কর: আমাদের এখানে ছোট থেকে বড় সব ধরণের কোম্পানির বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ আসে। এরমধ্যে পণ্যের উৎপাদন ও মেয়াদ উত্তীর্ণের তারিখ না থাকা, মূল্য তালিকা না থাকা, নির্ধারিত দামে চেয়ে বেশি মূল্য নেওয়ার অভিযোগ আসে। এছাড়া মিথ্যা বিজ্ঞাপন দিয়ে প্রতারিত করা, পরিমাপক যন্ত্রে কারচুপির, অবহেলা দ্বারা সেবাগ্রহিতার জীবন বিপন্ন করা, স্বাস্থ্য হানি ঘটানোর পণ্য বিক্রয়কার, খাদ্য অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে উৎপাদন বা পরিবেশন করা বিষয়ে অভিযোগ আসে।
একুশে টেলিভিশন অনলাইন: ভোক্তা অধিদফতরে কি পরিমাণ অভিযোগ আসে?
মো. শফিকুল ইসলাম লস্কর: অধিদফতর প্রতিষ্ঠার পর থেকে গত নয় বছরের মধ্যে এবারই সবচেয়ে বেশি অভিযোগ এসেছে। এর আগে ২০১৫ সালে অভিযোগ এসেছিল মাত্র ২২৫টি। পরের বছর এ সংখ্যা বেড়ে ১ হাজার ৬২২টিতে উন্নীত হয়। আর ২০১৭-২০১৮ অর্থবছরের ১৪ মার্চ পর্যন্ত অভিযোগের সংখ্যা ৬ হাজার ৪৪৮টিতে দাঁড়িয়েছে। এ সময়ের মধ্যে অভিযোগ নিষ্পত্তি করা হয়েছে ৫ হাজার ৬৪টি।
গত ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ৬ হাজার ১৪০টি অভিযোগ আসে। ওই বছর শতভাগ অভিযোগ নিষ্পত্তি করা হয়েছে। এছাড়া ২০১০-২০১৪ পর্যন্ত অভিযোগ আসে ১৭৯টি, ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ২৬৪টি, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ৬৬২টি অভিযোগ আসে। যা বিগত বছরগুলোতেই নিষ্পত্তি করা হয়েছে।
একুশে টেলিভিশন অনলাইন: তাহলে কি চলতি অর্থবছরটি আপনাদের জন্য সফল বছর?
মো. শফিকুল ইসলাম লস্কর: আমরা নয় বছরে ৩৭ হাজার ৩৯২টি প্রতিষ্ঠানকে দোষী সাব্যস্ত করেছি। এসব প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে আদায় করা হয়েছে ২৮ কোটি ৭৬ লাখ ৮৭ হাজার ৩শ’ টাকা। এখানে শুধু চলতি অর্থবছরকেই সফলতার বছর বলা যাবে না। সফলতা তখনই আসবে যখন দেখব দেশের সব নাগরিক সচেতন। দেশের সব কোম্পানিগুলো বা প্রতিষ্ঠানগুলো কিংবা বাজারে কোনো পণ্য কিনে ভোক্তা প্রতারিত হচ্ছে না। অধিদফতর আর কারোর অভিযোগ পাচ্ছে না। তখনই বলব আমরা সফল, তখনই সফল হবে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।
একুশে টেলিভিশন অনলাইন: বর্তমানে ভোক্তাদের অধিকার কতটা সংরক্ষণ হচ্ছে বলে আপনি মনে করেন?
মো. শফিকুল ইসলাম লস্কর: দেশে ভোক্তাদের অধিকার সংরক্ষণের জন্য বেশ কিছু আইন হয়েছে। কিন্তু সেগুলোর ব্যাপারে মানুষ খুব বেশি সচেতন ছিল না। আবার আইনগুলোও ব্যাপক ছিল না। ২০০৯ সালে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন, ২০১২ সালে প্রতিযোগিতা আইন, ২০১৩ সালে নিরাপদ খাদ্য আইন এবং ২০১৫ সালে ফরমালিন নিয়ন্ত্রণ আইন করা হয়। এই প্রত্যেকটি আইনই ভোক্তা বান্ধব। এই আইনগুলোর সাথে সাথে প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো গড়ে তোলার চেষ্টা করেছে সরকার। এখন আগের চেয়ে ভোক্তারা বেশ সচেতন, আশা করছি আগামীতে আরো বেশি সচেতন হবেন তারা।
একুশে টেলিভিশন অনলাইন: ভোক্তা অধিদফতরে বর্তমানে অভিযোগের সংখ্যা বাড়ছে। এজন্য অধিদফতরের অবদান বেশি, নাকি ভোক্তার সচেতনতা?
মো. শফিকুল ইসলাম লস্কর: সফলতার পিছনে ভোক্তাদের অবদানকে অস্বীকার করা যাবেনা। কারণ তারা আমাদের এখানে অভিযোগ করছেন বলেই আমরা জানতে পেরে কারসাজিকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারছি।
তবে সব চেয়ে বেশি অবদান বলব অধিদফতরের কর্মকর্তাদের। কারণ তারা নিরলসভাবে কাজ করছেন, সততার পরিচয় দিচেছন। দেশের নাগরিকদেরকে সচেতন করে তুলছেন।
একুশে টেলিভিশন অনলাইন: অধিদফতরে একটা অভিযোগ আসার পর, নিষ্পত্তি করতে কতদিন সময় লাগে?
মো. শফিকুল ইসলাম লস্কর: ভোক্তা সংরক্ষণ অধিদফতরে কেউ অভিযোগ করলে আমরা ৭ দিনের মধ্যেই এটা নিষ্পত্তি করার চেষ্টা করি। সেটা জেলা অফিস বা বিভাগীয় অফিস হোক। তবে কিছ কিছু ক্ষেত্রে সামান্য দেরি হয়ে যায়। বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানের অনিয়মের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলে তারা সিনিয়র আইনজীবী নিয়ে আসেন, এ ক্ষেত্রে একটু সময় লাগে। তবে আমরা চাই যতদ্রুত সম্ভব এসব অভিযোগের নিষ্পত্তি করতে।
একুশে টেলিভিশন অনলাইন: অভিযান পরিচালনার সময় অধিদফতরে কোনো ধরনের চাপ আসে কিনা কিংবা আপনারা কারো দ্বারা প্রভাবিত হন কিনা?
মো. শফিকুল ইসলাম লস্কর: অধিদফতর কারো দ্বারা প্রভাবিত হবে, এটা প্রশ্নই ওঠেনা। এখন পর্যন্ত অধিদফতর কারো দ্বারা প্রভাবিত হয়নি, আর হবেও না। হয়ত ছোট-খাট বিষয়ে প্রভাব বিস্তার করতে কেউ কেউ আসে। কিন্তু অধিদফতর তাদের পাত্তা দেয় না। কারণ ভোক্তার অধিকার সংরক্ষণে অধিদফতরের পাশাপাশি বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়।
একুশে টেলিভিশন অনলাইন: গ্রুপ অব কোম্পানির বিরুদ্ধে অভিযোগ আসলে অধিদফতর কী কোনো ধরনের বিব্রতকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়?
মো. শফিকুল ইসলাম লস্কর: ছোট-বড় সব ধরনের প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধেই আমাদের কাছে অভিযোগ আসে। অভিযোগের সত্যতা জাচাই করে বহু প্রতিষ্ঠানকে আমরা জরিমানা করেছি। দেশের টেলিকম খাতের প্রায় সব কোম্পানির বিরুদ্ধেই আমরা ব্যবস্থা নিয়েছি। আমরা গ্রুপ অব কোম্পানি ছাড়াও বাংলাদেশ বিমানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছি। মোট কথা হলো কোম্পানি ছোট হোক আর বড় হোক এটা বিষয় না, মূল কথা হলো অপরাধ করলে, অভিযোগ প্রমাণ হলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এক্ষেত্রে কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না।
একুশে টেলিভিশন অনলাইন: একটা প্রতারক চক্র আছে, যারা জরিমানার ২৫ ভাগ পাওয়ার আশায় নামি-দামি কোম্পানির বিরুদ্ধে অভিযোগ নিয়ে আসে। তাদের ক্ষেত্রে আপনাদের অবস্থান কি?
মো. শফিকুল ইসলাম লস্কর: হ্যাঁ এক শ্রেণীর প্রতারক আছে যারা জরিমানার ২৫ শতাংশ পাওয়ার আশায় অভিযোগ করে। অধিদফতর এ ব্যাপারে সর্বোচ্চ সতর্ক রয়েছে। অধিদফতর এসব প্রতারকের ফাঁদে কখনই পা দেয় না। তাছাড়া আমরা বুঝতে পারি কারা প্রতারক, তদন্ত করলেই বেরিয়ে আসে।
একুশে টেলিভিশন অনলাইন: শোনা যায় আপনাদের জনবল কম, এক্ষেত্রে কাজের কোনো সমস্যা হয় কিনা?
মো. শফিকুল ইসলাম লস্কর: আমাদের জনবল সংকট রয়েছে। প্রতিটি জেলায় আমাদের বিচারক নেই। আমরা এখনও দিতে পারিনি। তবে প্রতিটি জেলায় জনবল দেওয়া গেলে আমাদের কাজটা এগিয়ে নেওয়া আরও সহজ হতো। ঢাকায় অধিদফতরের ১৪ জন বিচারক রয়েছেন। যারা তদন্ত সাপেক্ষ অভিযোগগুলোর নিষ্পত্তি করেন। তাছাড়া সারা দেশে আরো ৪৫জন বিচারক রয়েছেন। ৬৪টি জেলাতেই আমরা বিচারক দিতে পারিনি। তবে আগামীতে ভোক্তার অধিকার সংরক্ষণে প্রতিটি জেলাতেই বিচারক থাকবে আশা করি।
একুশে টেলিভিশন অনলাইন: আপনার গুরুত্বপূর্ণ সময় দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ।
মো.শফিকুল ইসলাম লস্কর: ইটিভি অনলাইনকেও ধন্যবাদ।
আর/টিকে
আরও পড়ুন