মুক্তিযুদ্ধ কখনো শেষ হয়না: কামাল লোহানী
প্রকাশিত : ১১:০৯, ২৬ মার্চ ২০১৮ | আপডেট: ১৩:৩৭, ১৭ মে ২০১৮
‘মুক্তিযুদ্ধ শেষ হয়নি। মুক্তিযুদ্ধ কখনো শেষ হয়না। তাই মুক্তির আন্দোলনে নতুন প্রজন্মের দায়বদ্ধতা আরও বেড়েছে। মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ বাস্তবায়নে প্রবীণদের দায়িত্ব ধীরে ধীরে নবীনদের ওপর বর্তাচ্ছে’। একুশে টেলিভিশনের কাছে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে সাংবাদিক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব কামাল লোহানী এসব কথা বলেন।
সাংবাদিকনেতা কামাল লোহানী মুক্তিযুদ্ধকালীন সাংবাদিকতায় এদেশে উজ্জ্বল নক্ষত্র। বিজয় দিবসের প্রাক্কালে তিনিই প্রথম বিজয়ের সংবাদ লিখে প্রচার করেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের দিন বাংলাদেশ বেতারে বিমান বন্দরে ধারাভাষ্যকারের ভূমিকায় ছিলেন তিনি। দৈনিক আজাদ`, দৈনিক সংবাদ, দৈনিক পূর্বদেশ, দৈনিক বার্তাসহ বিভিন্ন পত্রিকায় কাজ করে আসা গুণী এই সাংবাদিক দুদফায় সাংবাদিক ইউনিয়নে যুগ্ম-সম্পাদক এবং ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি হন। তিনি গণশিল্পী সংস্থার সভাপতি ছিলেন। ২০১৫ সালে তিনি সাংবাদিকতায় একুশে পদক লাভ করেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন একুশে টেলিভিশন অনলাইন প্রতিবেদক আলী আদনান।
একুশে টেলিভিশন অনলাইনঃ বিজয়ের প্রথম বার্তাটি আপনি লিখেছিলেন, আজকের স্বাধীনতা দিবসে সেই ঘটনার স্মৃতিচারণ করুন।
কামাল লোহানীঃ যখন ভারতীয় পূর্বাঞ্চালীয় মিত্রবাহিনী ও মুক্তিবাহিনী গঠন করা হলো, তারা নানাভাবে চেষ্টা করছিল আক্রমণ করতে। তখন পরিস্থিতি পাল্টে গেল। বিজয়ের কয়েকদিন আগে ১২ অথবা ১৩ তারিখ বেতারে একটা লিফলেট আসে। লিফলেটটি আমাকে বাংলা ও উর্দু করার দায়িত্ব দেওয়া হয়। স্বাধীন বাংলা বেতার থেকেই উর্দু করার ব্যবস্থা করা হয়। কারণ আগে থেকেই উর্দু বিভাগ চালু হয়েছিল। সেখানে উর্দু হেডলাইন ছিল: ‘হাতিয়ার ঢালদো’ মানে ‘অস্ত্র সংবরণ করো’। এবং লিফলেটটা যখন আমরা অনুবাদ করে দিলাম, তখন অনুমাণ করতে পারছিলাম যে, কোনো একটা প্রক্রিয়া চলছে। দ্রুত একটা সুখবর আমরা পাবো। পরে জানতে পারি, ১৬ ডিসেম্বর বিকাল ৪টা ৩০ মিনিটে ঢাকা রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী ময়দানে) পাকিস্তানি সেনাবাহিনী আত্মসমর্পণ করবে । যখন মিত্র বাহিনীর প্রধান অরোরা ও পাকিস্তানি বাহিনীর প্রধান জেনারেল নিয়াজীর কথোপকথন হলো বুঝতে পারলাম বিজয় সুনিশ্চিত। এটা যখন জানতে পারলাম, স্বাভাবিকভাবে আমাদের মধ্যে প্রবল আবেগ ও উত্তেজনা কাজ করতে থাকে। তখন আমরা সবাই বসে ঠিক করলাম, কীভাবে অনুষ্ঠান সাজাব? আমার দায়িত্ব হলো নিউজ করা। তো নিউজটা কীভাবে করা হবে? তখন আমরা রেকর্ডিং করতে বসলাম আমাদের ১নং স্টুডিওতে। দুটো স্টুডিও ছিল। আমি ও আশফাকুর রহমান খান, বেলাল মোহাম্মদ, রাশেদ, আমিনুর রহমান, শরফুজ্জামান, আব্দুল্লাহ আল ফারুক আরো যারা ছিল সবাই একসাথে বসলাম। বসার পর আমাকে সেই সংবাদ লিখতে হলো। লেখার পর যে জিনিসটা লক্ষ্য করলাম, প্রচলিত ধারায় রেডিওতে যে সংবাদ পাঠ করা হয় তাতে যে ধরণের শব্দ, বাক্য ও ভাষা ব্যবহার করতে হয় তা বিপ্লবী রেডিওতে হবে না। তবুও মুক্তি বাহিনীর বিজয়, পাকিস্তানি বাহিনীকে পরাজিত করা, তাদের হাত থেকে মাতৃভূমি বা দেশ মুক্ত করা, মোটামুটিভাবে এই রকম সংবাদই যাচ্ছিল। কিন্তু যখন ১৬ ডিসেম্বরে আত্মসমর্পণের খবরটা এলো তখন তো আমাদের ভাষা বদলে গেল। এবং সঙ্গত কারণেই আমাদের ভাষাটা হলো অত্যন্ত কঠিন।
একুশে টেলিভিশন অনলাইনঃ কেমন ছিল সেই অনুভূতি?
কামাল লোহানীঃ বুঝানো কঠিন। সেই আবেগ ভাষায় বুঝানো যাবেনা। নয় মাসের যুদ্ধ বিধ্বস্ত বাংলাদেশ, রক্তের সাগর, লাশের স্তুপ- সব কিছুর বিনিময়ে স্বাধীনতা, উহ, ভাষায় প্রকাশ করা কঠিন। তবে আমি গর্বিত। ইতিহাসের যে দায়বদ্ধতা আমাদের কাঁধে ছিল তাতে সচল থেকে কাজ করতে পেরেছি।
একুশে টেলিভিশন অনলাইনঃ মুক্তিযুদ্ধের ফসল বাংলাদেশ। এই বাংলাদেশ নিয়ে প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির মধ্যে কোন ফারাক দেখেন কি?
কামাল লোহানী: পাকিস্তানের কাছ থেকে লড়াই-সংগ্রাম করে আমরা স্বাধীনতা অর্জন করেছিলাম। পাকিস্তান থেকে স্বাধীনতা চেয়েছিলাম, কারণ পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রটিতে আমাদের সমস্যার শেষ ছিল না। কিন্তু স্বাধীনতার ৪৭ বছর পরও সমস্যা কাটেনি। বরং দিনদিন বাড়ছে। দেশে গুম, খুন, অপহরণ যেভাবে হচ্ছে এটা কোনো স্বাধীন দেশে ভাবা যায়?
একুশে টেলিভিশন অনলাইনঃ বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে আপনার ব্যাক্তিগত অভিজ্ঞতা কেমন?
কামাল লোহানীঃ আমি তখন ‘বঙ্গবার্তা’ পত্রিকায় কাজ করি। বঙ্গবার্তা তখন চলতো মওলানা ভাসানীর তত্ত্বাবধানে। ফয়েজ আহমেদ সম্পাদক, আমি নিউজ এডিটর। তখন আমি ভাসানীর চীনাপন্থি কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে যুক্ত ছিলাম। আমরা বঙ্গবন্ধুর কোনো সংবাদ প্রকাশ বা ছবি ছাপতাম না। তবে একদিন ছেপেছিলাম। সংবাদটা ছিল বাংলাদেশের সামাজতান্ত্রিক দলের (সিপিবি) কংগ্রেসে বঙ্গবন্ধু প্রধান অতিথি হয়ে এসেছিলেন। তো আঞ্চলিক ভাষায় যে স্টাইলে বক্তব্য রেখেছেন তা হুবহু ছেপে দিয়েছিলাম। পর দিন বঙ্গবন্ধু টেলিফোন করলেন। আমি টেলিফোন ধরলে বললেন, ফজা কইরে? ফজা মানে ফয়েজ আহমেদ। আমি বললাম, তিনি তো এখন নেই। বঙ্গবন্ধু বললেন, ও বুঝছি প্রেসক্লাবে কাচ্চু খেলতে গেছে। তা তোরা তো আমার ছবি ছাপিস না। আজ এতো বড় ছবি ছাপলি ক্যান? আসলে বঙ্গবন্ধু অনেক বড় হৃদয়ের মানুষ ছিলেন, দিলখোলা ছিলেন, আন্তরিক ছিলেন। আমরা নানা সময়ে নানা বিষয়ে তার মুখোমুখি হয়েছি, তর্ক করেছি, পরামর্শ করেছি। এখন সেসব কল্পনা করা যায় না। বঙ্গবন্ধু যেদিন স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করলেন সেদিন ধারাভাষ্য আমি দিয়েছিলাম। সাথে ছিলেন আশফাকুর রহমান।
একুশে টেলিভিশন অনলাইনঃ বাঙালি সংস্কৃতি বর্তমানে পাশ্চাত্য সংস্কৃতি ও পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র হিন্দী সংস্কৃতির চাপে আছে। সেক্ষেত্রে আমাদের করণীয় কী?
কামাল লোহানীঃ আমাদের প্রত্যেককে এক্ষেত্রে স্বউদ্যোগী হতে হবে। আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতির চর্চা বাড়াতে হবে। বৈশাখী উৎসব, বসন্ত উৎসব, নানা ধরণের পার্বনের চর্চা বাড়াতে হবে। সংস্কৃতি শুধু গান বাজনা নয়। বরং আমাদের নিত্য নৈমিত্তিক জীবন যাপনও সংস্কৃতির অন্তর্ভুক্ত। সেক্ষেত্রে আমাদেন দেশীয় রীতি নীতিকে প্রাধান্য দিতে হবে। যুগে-যুগে. কালে-কালে সব সংস্কৃতিতে অপসংস্কৃতি বা বাইরের সংস্কৃতির প্রভাব পড়ে। সেটা সাথায় রেখেই যুগের সাথে তাল মিলিয়ে এগিয়ে যেতে হবে।
একুশে টেলিভিশন অনলাইনঃ আপনারা দেশের স্বাধীনতায় অবদান রেখেছেন। এখন যেহেতু দেশ স্বাধীন, তাই মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ বাস্তবায়নে তরুণ প্রজন্মের কি করা উচিত বলে আপনি মনে করেন?
কামাল লোহানীঃ মুক্তিযুদ্ধ তো শেষ হয়নি। মুক্তিযুদ্ধ কখনো শেষ হয়না। তাই মুক্তির আন্দোলনে নতুন প্রজন্মের দায়বদ্ধতা আরও বেড়েছে। মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ বাস্তবায়নে প্রবীণদের দায়িত্ব ধীরে ধীরে নবীনদের ওপর বর্তাচ্ছে। রাজনৈতিক মুক্তি পেলেও, এখনো স্বাধীন দেশের প্রতিটি নাগরিকের অর্থনৈতিক মুক্তি মেলেনি। এ ছাড়া, দেশে এখনও গুম, খুন ও অপহরণ যেভাবে হচ্ছে এটা কোনো স্বাধীন দেশে মানা যায় না। তাই মুক্তিযুদ্ধ তো শেষ হয়নি, মুক্তিযুদ্ধ চলছে, চলবে...
একুশে টেলিভিশন অনলাইনঃ আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
কামাল লোহানীঃ একুশে টেলিভিশন অনলাইনকেও ধন্যবাদ।
এএ/ এমজে
আরও পড়ুন