কুকুর-বিড়ালের ‘বন্ধু’ একজন প্রসেনজিৎ
প্রকাশিত : ১৭:৫২, ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২১ | আপডেট: ১৮:২৯, ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২১
প্রিয় কুকুরগুলোর সঙ্গে হাস্যোজ্জ্বল প্রসেনজিৎ
সময়টা ২০২০ এর মার্চ! বৈশ্বিক মহামারি করোনা সংক্রমণের আতঙ্কে সারাদেশে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছুটি ঘোষণা করা হলে ১৮ মার্চ থেকে বন্ধ হয়ে যায় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ও। লকডাউন ও আতঙ্কে সবাই যখন ঘরে আবদ্ধ, জনশূন্য ক্যাম্পাসে কুকুরগুলো কাঁতরে মরছিল ক্ষুধার তাড়নায়। ঠিক সে মুহূর্তেই বন্ধু হয়ে আর্বিভাব তার! প্রায় এক বছরে দু-শতাধিক কুকুর-বিড়ালের খাদ্য যোগান দিয়েছেন তিনি।
শুরুটা নিজের অর্থায়নে হলেও পরবর্তীতে তার সাথে সম্পৃক্ত হন আরও অনেকে। রোদ-বৃষ্টি উপেক্ষা করে ক্যাম্পাসেই থেকেছেন সর্বক্ষণ। রেখেছেন বিড়াল-কুকুরদের খেয়াল, করিয়েছেন চিকিৎসাও। বলছিলাম রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কেটিং বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর শেষ করা প্রসেনজিৎ-এর কথা।
সম্প্রতি তিনি কুকুর-বিড়ালের চিকিৎসা সেবা ও সুরক্ষা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে রাজশাহীতে প্রথমবারের মতো প্রতিষ্ঠা করেছেন "কিটিক্যাট কেয়ার এন্ড কিউর" নামে একটি নিরাময় কেন্দ্র। যার উদ্বোধন করা হয়েছে গত ১২ ফেব্রুয়ারি। যেটা নিয়ে বিস্তারিত কথা হয়েছিলো প্রসেনজিৎ-এর সাথে।
প্রশ্ন: ক্যাম্পাসে বিড়াল-কুকুরদের নিয়ে কাজ কবে থেকে শুরু করেন?
প্রসেনজিৎ: করোনা সংক্রমণের কারণে ক্যাম্পাস যখন বন্ধ ঘোষণা করা হয়। লকডাউনে সবাই যখন ঘরে আবদ্ধ, ঠিক তখন থেকে ক্যাম্পাসে থাকা কুকুর-বিড়ালগুলো ক্ষিধের যন্ত্রণায় কাতর; তখন মনে হলো- এদের জন্য কিছু করা উচিৎ। আমরা ক্যাম্পাসে কুকুর-বিড়ালকে খাওয়াইছি। সাধ্যমতো চিকিৎসাও দিয়েছি। টানা এক বছর ধরে বর্ষা, গরম, শীত আমরা লকডাউনে ক্যাম্পাসের কুকুর-বিড়ালের সাথেই কাটিয়েছি।
প্রশ্ন: কিটিক্যাট কেয়ার সেন্টার তৈরি করার তাড়না কবে থেকে?
প্রসেনজিৎ: দেখুন, স্বপ্ন বলে কিছু নেই, যা আছে তা অভাব। অভাব পূরণ হয়, স্বপ্ন কল্পনা মাত্র। সুনসান ক্যাম্পাসে থাকা কুকুর-বিড়ালের সাথেই কাটিয়েছি। এই অভাবটা তাড়না করছে গত বছর জুনের দিকে। বুল্ডুর কথাই বলি- ওর মুখে কেউ মেরেছিলো। ওর তখন মাস খানিক মাত্র বয়স। মুখের ডানপাশে চোখের নিচ থেকে সব খসে পড়েছিলো। চোয়ালের হাড়টাও নেই। তিন মাস লেগেছিলো সুস্থ করতে। বঙ্গবন্ধু হলের বিড়ালটা কোলের উপর-ই মারা গেলো! শহীদুল্লাহ কলা ভবনের সামনের কুকুরটা রাস্তায় গাড়িচাপা পড়ে চিকিৎসার অভাবে ধুঁকে-ধুঁকে মরলো!এগুলো দেখে নিজেকে আর সামলাতে পারিনি। তখন থেকেই তাড়নাটার শুরু।
প্রশ্ন: কিটিক্যাট কেয়ার সেন্টার ও শপটি কোথায় করলেন?
প্রসেনজিৎ: এসব নিয়ে কাজ করলে বাসা পাওয়া মুশকিল হয়ে পড়ে। পুরো ডিসেম্বর চলে যায় বাসা খুঁজতে-খুঁজতে। কুকুর-বিড়াল নিয়ে কাজ করবো বলে কেউ বাসা ভাড়া দিতে চায়নি। মাস খানিক পর বাসা পাই। রাজশাহী নগরীর বহরামপুর মোড়ে। সেখানেই এ কিটিক্যাট কেয়ার সেন্টার ও শপটা চালু করি।
প্রশ্ন: শপটি উদ্বোধন করলেন কবে?
প্রসেনজিৎ: গত ৩ জানুয়ারি ক্যাম্পাস ছাড়ি। আজ (১২ ফেব্রুয়ারি) একমাস দশদিন পর আমার নতুন প্রতিষ্ঠানটি উদ্বোধন করতে পারি। কিটিক্যাট (কেয়ার এন্ড কিউর) প্রতিষ্ঠানটির উদ্বোধন করেন আওয়ামী লীগের বন ও পরিবেশ উপ-কমিটির সদস্য ডা. আনিকা ফারিহা জামান অর্ণা। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রপ সায়েন্স এন্ড টেকনোলজি বিভাগের লেকচারার রিজভী আহমেদ ভুঁইয়াসহ আরও অনেকেই এতে উপস্থিত ছিলেন।
প্রশ্ন: কি ধরনের সেবা দিবেন?
প্রসেনজিৎ: সবার সাপোর্ট পেলে চব্বিশ ঘণ্টা অত্যাধুনিক ক্লিনিক সার্ভিস দেবো। ফোস্টার কেয়ার থাকবে। সেখানে চাইলেই যে কেউ সার্ভিস চার্জ দিয়ে বিড়াল রাখতে পারবে। বিভিন্ন ধরনের ক্যাটফুড, ডগফুড, খেলনা এবং প্রয়োজনীয় সামগ্রী থাকছে এখানে। উন্নত দেশে পেট সংক্রান্ত যেসব সুবিধা আছে, ধীরে-ধীরে সেসব সুবিধাও দেয়া হবে। পথকুকুর-বিড়ালের জন্য একটা শেল্টার হোম করা হবে, যেখানে ফ্রি চিকিৎসা দেয়া হবে। একটু সময় লাগবে। অবশ্যই সবার সমর্থন প্রয়োজন।
প্রশ্ন: কতটুকু সহযোগিতা পেয়েছেন?
প্রসেনজিৎ: আর্থিক সাপোর্ট বলতে এখানেও একটা রিস্ক থেকে যায়। প্রথম একজন আমাকে ওই সময়ই সবচেয়ে বেশি সাপোর্ট দেন। উনিই সর্বপ্রথম আমাকে ব্যাংকে যেতে বলেন। আমি এখানকার একটা ব্যাংকের ম্যানেজারের সাথে এটা নিয়ে কথা বলি। ব্যাংক থেকে নানান শর্ত। অনেকটা মন খারাপ করে ঘরে ফিরি। এসময় এই ভুত আরও বেশি ঘাড়ে চাপলো। ব্যাংক যত শর্ত দেয়। ততই আমার জেদ চাপে! মাস দুয়েক ঘুরে কোনও সমাধান পাইনি। এদিকে আমার নিজের যা টাকা ছিল তা দিয়ে একটা বাসা ভাড়া নিয়ে চালানোও সম্ভব না। তখন ফোস্টার কেয়ার, পেট শপ, পেট ক্লিনিকের ভুতটা আরও বেশি করে চাপলো। এগুলো মাথা ভার করে তুলছিলো। ততদিনে চাকরির পড়াশুনাও ছেড়ে দিয়েছি। অনেক ঘুরলাম, কিন্তু নতুন প্রজেক্টের কোনও সূত্র পেলাম না। হঠাৎ একদিন আমার বিভাগের বড় আপাকে জানালাম। ওইদিন রাতেই উনি একজনের নাম্বার দিলেন। পরদিন সন্ধ্যায় কাজলায় ডি-লাউঞ্জে প্রথম আলাপ হলো। প্রথম দিনেই আমার চিন্তার সাথে তারা কাজ করতে রাজী হলেন। মাস তিনেক একাই যেতাম, হতাশ হয়ে হঠাৎ যেন অভাবটা সামনে আসতেই পূরণ হতে চলেছে।
প্রশ্ন: ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কি?
প্রসেনজিৎ: জানুয়ারির ১৭ তারিখের পর মূল ডেকোরেশনের কাজ শেষ করে অবশেষে আমার অভাব অনেকটা পূরণ হয়েছে। "কিটিক্যাট কেয়ার" আমার অভাব ছিলো। এখন অনেকটা পূরণ হলো। আমি চাই একটা সময় কিটিক্যাটের নিজস্ব পেট এম্বুলেন্স থাকবে, পেট আইসিইউ এম্বুলেন্স থাকবে। এখন ডগফুড, ক্যাটফুড, টয়, ফোস্টার কেয়ার সামগ্রী- এগুলোই থাকছে।
প্রশ্ন: আপনি কি মনে করেন, তরুণ উদোক্তাদের পাশে সরকারের এগিয়ে আসা উচিত?
প্রসেনজিৎ: নতুন চিন্তা, নতুন ব্যবসা- সবকিছু মিলিয়ে আর্থিক সাপোর্ট পাচ্ছি। কিন্তু একটা উন্নত এবং আধুনিক হাসপাতাল করতে হলে অনেক অর্থ প্রয়োজন। সেক্ষেত্রে যদি যুব মন্ত্রণালয় কিংবা বাংলাদেশ সরকার যদি আমার প্রতিষ্ঠানকে বিনা সুদে ঋণ দেয়, তবে আমার সবগুলো পরিকল্পনা কয়েকমাসে সম্পূর্ণ করা সম্ভব। নয়তো আমাদের একটু হয়তো দেরি হবে। সরকারের এদিকটায় নজর দেয়া উচিত। আমি সরকারের কাছে একজন তরুণ উদ্যোক্তা হিসেবে সুযোগ চাই।
এনএস/
আরও পড়ুন