৭ মার্চের ভাষণের মধ্য দিয়েই দেশ স্বাধীন হয়: লেনিন
প্রকাশিত : ১২:১১, ৭ মার্চ ২০১৮ | আপডেট: ১৩:৩৮, ১৭ মে ২০১৮
ড. নূহ-উল আলম লেনিন। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের মাসিক মুখপত্র উত্তরণ- এর প্রকাশক ও সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। ইতোপূর্বে দলটির সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য হিসেবেও রেখেছেন সফলতার স্বাক্ষর। বঙ্গবন্ধুর ৭মার্চের ভাষণের গুরুত্ব নিয়ে কথা বলেন একুশে টেলিভিশন অনলাইনের সঙ্গে। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন একুশে টেলিভিশন অনলাইন প্রতিবেদক আলী আদনান।
একুশে টেলিভিশন অনলাইন: বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ এখন আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত ভাষণ। এই ভাষণের গুরুত্ব ও মাহাত্ম্য কীভাবে মূল্যায়ন করছেন?
ড. নূহ-উল আলম লেনিন: জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি বিষয়ক সংস্থা (ইউনেস্কো) ২০১৭ সালের ৩০ অক্টোবর বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণকে ‘বিশ্ব ঐতিহ্য দলিল’ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। যা সংস্থাটির ‘মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড ইন্টারন্যাশনাল রেজিস্টারে’ অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।
১৫ সদস্য বিশিষ্ট একটি আন্তর্জাতিক উপদেষ্টা-বিশেষজ্ঞ কমিটি দু’বছর ধরে প্রামাণ্য দালিলিক যাচাই-বাছাই শেষে ইউনেস্কোর মহাপরিচালকের সম্মতিক্রমে ভাষণটি সংস্থার নির্বাহী কমিটি কর্তৃক চূড়ান্তভাবে গৃহীত হয়। দীর্ঘ ৪৬ বছর পর হলেও জাতিসংঘের মতো বিশ্ব সংস্থার এ সিদ্ধান্ত নিঃসন্দেহে একটি ঐতিহাসিক ঘটনা।
এর মধ্য দিয়ে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণটি ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ হিসেবে মানবজাতির মূল্যবান ও ঐতিহ্যপূর্ণ সম্পদ হিসেবে স্বীকৃত ও গৃহীত হল। আপনারা জানেন, ১৯৯৯ সালে ইউনেস্কো আমাদের একুশে ফেব্রুয়ারি মহান ভাষা শহীদ দিবসকে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। ফলে এখন বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীর নিজ ভাষার অধিকার সংরক্ষণের প্রতীক হিসেবে দিবসটি পালিত হচ্ছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ওই ভাষা আন্দোলনে শুধু সংগঠকের ভূমিকাই পালন করেননি, বরং তিনি ছিলেন এ আন্দোলনের প্রথম কারাবন্দিদের অন্যতম।
গ্রিক নগররাষ্ট্র এথেন্সের রাষ্ট্রনায়ক পেরিক্লিসের অপর এক নগররাষ্ট্র স্পার্টার বিরুদ্ধে যুদ্ধে নিহত স্বদেশীয় সৈন্য ও সাধারণ মানুষের স্মরণে প্রদত্ত ভাষণ (৪৩১ খ্রিস্টপূর্ব) থেকে শুরু করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগানের ১৯৮৭ সালে বার্লিনে দুই জার্মানির মধ্যকার বিভক্তির দেয়াল (বার্লিন ওয়াল) ভেঙে চূর্ণ-বিচূর্ণ করার আহ্বান সংবলিত ভাষণ পর্যন্ত আড়াই হাজার বছরের বিশ্ব ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি প্রভাব বিস্তারকারী ৪১ জন সামরিক-বেসামরিক জাতীয় বীরের বিখ্যাত ভাষণ নিয়ে ব্রিটিশ ইতিহাসবিদ Jacob F Field-এর We Shall Fight on The Beaches : The Speeches That Inspired History শিরোনামে একটি গ্রন্থ সংকলন করেন। যা ২০১৩ সালে লন্ডন থেকে প্রকাশিত হয়। এ গ্রন্থে আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট (মেসিডোনিয়া, প্রাচীন গ্রিস), জুলিয়াস সিজার (রোম), অলিভার ক্রমওয়েল (ইংল্যান্ড), জর্জ ওয়াশিংটন (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র), নেপোলিয়ন বোনাপার্ট (ফ্রান্স), জোসেফ গ্যারিবোল্ডি (ইতালি), আব্রাহাম লিংকন (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র), ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিন (রাশিয়া), উইড্রো উইলসন (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র), উইনস্টন চার্চিল (যুক্তরাজ্য), ফ্রাঙ্কলিন রুজভেল্ট (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র), চার্লস দ্য গল (ফ্রান্স), মাও সেতুং (গণচীন), হোচিমিন (ভিয়েতনাম) প্রমুখ নেতার বিখ্যাত ভাষণের পাশাপাশি স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ভাষণ অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।
এটা শুধু রাজনীতিবিদ হিসেবেই নয়; বরং জাতি হিসেবে আমাদের জন্য গর্বের। এর ফলে বিশ্বসভ্যতায় আমাদের যাত্রাপথ স্বীকৃতি পেল।
একুশে টেলিভিশন অনলাইন: ৭ মার্চের ভাষণকে বিশ্লেষণ করতে বললে আপনি একে কোন কোন দিক থেকে বিবেচনা করবেন?
ড. নূহ-উল আলম লেনিন: বঙ্গবন্ধুর এ ভাষণটা অলিখিত ভাষণ। এটা পৃথিবীর ইতিহাসে বড় ব্যতিক্রম ঘটনা। এবং সেই ভাষণ তিনি ছন্দের মত করে দিয়ে গেছেন। তেইশ মিনিটের ভাষণটিতে আমরা পেয়েছি আঠার মিনিট। এখানে এলোমেলো, অগোছালো কোন কথা নেই। অসঙ্গতিপূর্ণ কোন কথা কেউ খুঁজে বের করতে পারেন। কোন কথাটার পর কোন কথাটা বলা দরকার তা তিনি ভালো করেই বুঝেছেন। প্রথমে তিনি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তানের সামগ্রীক পরিস্থিতি পর্যালোচনা করেছেন। এরপর তিনি তার নিজ ভূমিকা ও অবস্থান ব্যাখ্যা করেছেন। তারপর তিনি পশ্চিম পাকিস্তানি রাজনীতিকদের ভূমিকা তুলে ধরেছেন। এতটুকু পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু তার ভাষণে পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করেছেন। তারপরের অংশ নির্দেশনামূলক। এখানে বঙ্গবন্ধু সামরিক আইন প্রত্যাহারের আহ্বান জানিয়েছেন। অত্যাচার ও সামরিক আগ্রাসন মোকাবেলার হুমকি দিয়েছেন। দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তানে সার্বিক হরতাল বা অসহযোগের ডাক দিয়েছেন। সবশেষে প্রতিরোধের ডাক দিয়েছেন।
একটা বিষয় খেয়াল করলে দেখবেন, তিনি কিন্তু হঠাৎ করেই অসহযোগের আহ্বান জানাননি বা প্রতিরোধের ডাক দেননি। অসহযোগের আহবান তিনি এমন এক জায়গায় এসে করেছেন বা প্রতিরোধের ডাক তিনি এমন জায়গায় এসে দেন, যখন সেটাই যুক্তিযুক্ত।
একুশে টেলিভিশন অনলাইন: দেশ স্বাধীন হওয়ার ক্ষেত্রে ৭ মার্চের ভাষণের কী ভূমিকা আছে বলে মনে করেন?
ড. নূহ-উল আলম লেনিন: বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চের ভাষণেই স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন। ৭ মার্চ থেকে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট পর্যন্ত দেশ চলেছে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে। ওই বিবেচনায় ৭ মার্চ আমাদের স্বাধীনতা দিবস।
একুশে টেলিভিশন অনলাইন: কিন্তু এ ৭ মার্চের ভাষণে তো তিনি সরাসরি স্বাধীনতা ঘোণণা দেননি।
ড. নূহ আলম লেলিন: সেটা বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক বিচক্ষণতা। তিনি যদি সরাসরি স্বাধীনতা ঘোষণা দিতেন তাহলে তা রাজনৈতিক ও প্রশাসনিকভাবে অগ্রহণযোগ্য হতে পারত। সমাবেশ চলাকালীন সময়ে মাথার উপর পাকিস্তানি বিমান চক্কর দিচ্ছিল। বঙ্গবন্ধুর মতো একজন বড় মাপের নেতা সেখানে রাজনৈতিক বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়েছেন, যা ইতিহাসে লিখা থাকবে।
তিনি সেই বিচক্ষণর পরিচয় না দিলে রাজনৈতিক পরিস্থিতি বাঙালিদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে যেত! দ্বিতীয়ত, বঙ্গবন্ধু তাঁর বক্তৃতায় যে অসহযোগ ও প্রতিরোধের ডাক দিয়েছেন, পরের দিন থেকে দেশ ঠিক সেভাবেই চলেছে। চুল পরিমাণ এদিক ওদিক হয়নি।
এটাই স্বাধীনতার ঘোষণা।
একুশে টেলিভিশন অনলাইন: আপনাকে ধন্যবাদ। আমাদেরকে সময় দেওয়ার জন্য।
ড. নূহ-উল আলম লেনিন: আপনাকেও ধন্যবাদ।
আরও পড়ুন