জাপানে কর্ম ও ভাষা দক্ষতা অপরিহার্য: তারেক রাফি ভুঁইয়া
প্রকাশিত : ২১:১৭, ৭ নভেম্বর ২০১৯
বিশ্ব অর্থনীতির দেশ জাপান। দেশটি দশকের পর দশক ধরে সমৃদ্ধ অর্থনীতির পতাকা বহন করছে। বাংলাদেশের সঙ্গে দেশটির বন্ধুত্ব বহু বছর ধরে অটুট রয়েছে। বাংলাদেশে বিভিন্নখাতে রয়েছে জাপানের বিনিয়োগ। বাণিজ্য, জনশক্তি রপ্তানি, বিনিয়োগসহ দেশটির সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে করণীয় সম্পর্কে কথা বলেছেন জাপান-বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স আ্যন্ড ইন্ডাস্ট্রির (জেবিসিসিআই) জেনারেল সেক্রেটারি তারেক রাফি ভুঁইয়া (জুন)।
তিনি একাধারে নিউভিশন সলিউশনস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক। জিনজা গ্রুপের ম্যানেজিং পার্টনার ও ক্রিমসন কাপ বাংলাদেশের কো-ফাউন্ডার। তারেক রাফি ভুঁইয়া পড়ালেখা করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের ওহিয়ো স্টেট ইউনিভার্সিটি ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্সটিটিউট অব বিজনেস অ্যাডমিনিষ্ট্রেশন (আইবিএ) থেকে।
সম্প্রতি একুশে টেলিভিশনের সঙ্গে একান্ত আলাপচারিতায় তিনি জাপানের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য বৃদ্ধির নানা সমস্যা ও সম্ভাবনা নিয়ে কথা বলেছেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ফ্রিল্যান্স উন্নয়ন প্রতিবেদক ইমদাদ হক।
একুশে টেলিভিশন: ইউরোপ আমেরিকার বাইরে জাপান বাংলাদেশি পণ্য রপ্তানির বড় বাজার হয়ে উঠছে, সম্ভাবনা কেমন দেখছেন?
তারেক রাফি ভুঁইয়া: জাপানের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য বাড়ছে। এশিয়ার সমৃদ্ধ অর্থনীতির দেশ জাপান ধীরে ধীরে বাংলাদেশের রপ্তানির বড়ো বাজার হয়ে উঠছে। সর্বশেষ ২০১৮-১৯ অর্থবছরে দেশটিতে বাংলাদেশের রপ্তানি হয়েছে ১৩৬ কোটি ৫৭ লাখ মার্কিন ডলারের। অর্থাৎ, সদ্য সমাপ্ত অর্থবছরে জাপানে রপ্তানি বেড়েছে প্রায় ২০ শতাংশ। আলোচ্য সময়ে দেশটিতে প্রধান রপ্তানি গার্মেন্টস পণ্য এক বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে। গত অর্থ বছরে সেখানে গার্মেন্টস পণ্য রপ্তানি বেড়েছে প্রায় ২৯ শতাংশ। ফলে প্রধান রপ্তানি গন্তব্য ইউরোপ ও আমেরিকার বাইরে জাপান বড় বাজার হয়ে উঠছে।
একুশে টেলিভিশন: আমদানি-রপ্তানির ক্ষেত্রে কি ধরণের সমস্যা মনে করেন? এগুলোর সমাধানে কি করা যেতে পারে?
তারেক রাফি ভুঁইয়া: সমৃদ্ধ অর্থনীতির দেশ জাপানে রপ্তানির অফুরন্ত সম্ভাবনা রয়েছে বাংলাদেশের। তবে শুল্কমুক্ত সুবিধা পাওয়ার পরও দেশটিতে অধিক হারে রপ্তানির সম্ভাবনাকে পুরোপুরি কাজে লাগাতে পারছে না বাংলাদেশ। তৈরি পোশাক খাতে নির্ভরতা কমিয়ে পণ্য বহুমুখীকরণে মনোযোগ দিতে পারলে দেশটিতে রপ্তানি আরো বাড়ানো সম্ভব বলে আমি মনে করি। জাপানে গার্মেন্টস ছাড়াও রপ্তানি পণ্যের তালিকায় রয়েছে হিমায়িত মাছ ও খাদ্য, চামড়াজাত পণ্য, সিরামিক পণ্য। আর জাপান বাংলাদেশের গার্মেন্টস পণ্য আমদানি করে থাকে। বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের প্রতি জাপানের চাহিদা অতীতে লক্ষ্য করা গেছে। বর্তমানে এই চাহিদা আরও বেড়েছে। এছাড়াও চামড়াজাত পণ্যের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে জাপানে। যার দরুণ জাপান উল্লেখযোগ্য পরিমাণে চামড়াজাত পণ্য বাংলাদেশ থেকে আমদানি করে থাকে।
জাপানে রপ্তানির ক্ষেত্রে সম্ভাবনাময় খাত হিসেবে তথ্য প্রযুক্তির আবির্ভাব হতে পারে। বাংলাদেশে আই টি ফার্ম স্থাপন করে যুগোপযোগী এবং মানসম্পন্ন সফটওয়্যার তৈরি করে জাপানে রপ্তানি করা যেতে পারে। সেক্ষেত্রে জাপানিজ ভাষা শেখার প্রতি গুরুত্ব আরোপ করতে হবে। কেননা জাপান সব কিছুই নিজেদের ভাষাতে আশা করে। যোগাযোগের ক্ষেত্রে তাই জাপানিজ ভাষা জানা দক্ষ জনশক্তি বাড়াতে হবে বাংলাদেশকে। অবশ্য আশার কথা হচ্ছে খুব সাম্প্রতিককালে কয়েকটি জাপানি স্কুল প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। কিছু ফার্ম চেষ্টা করছে এই ঘাটতিটাকে পূরণ করতে। আশা করা যায় অদূর ভবিষ্যতে জাপানের নির্ভরশীল সফটওয়্যার রপ্তানিকারক দেশ হিসেবে নিজেদেরকে পরিচয় কারিয়ে দিতে পারব।
একুশে টেলিভিশন: পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে জাপানের চেয়ে কি চীন এখানে বেশি প্রভাব বিস্তার করছে?
তারেক রাফি ভুঁইয়া: সময়ের পরিক্রমায় বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সক্ষমতা বেড়েছে। অর্থনৈতিকভাবে বাংলাদেশ এখন এশিয়ার উদীয়মান শক্তি। আমাদের অভ্যন্তরীণ একটা বিশাল বাজার তৈরি হয়ে গেছে যেখানে মানসম্পন্ন অনুপাতে জনশক্তি জাপানে রপ্তানি করা হচ্ছে। এসএমই ক্ষেত্রে বাংলাদেশের জনগোষ্ঠীর দক্ষতা বাড়াতে জাপান আগ্রহ প্রকাশ করছে। ২০২০ সালে বিশ্বের সবচেয়ে বড় ক্রিড়া মহোৎসব অলিম্পিক গেমস অনুষ্ঠিত হবে জাপানে। টোকিওতে এ গেমস সফল করতে মহাযজ্ঞ শুরু করে দিয়েছে দেশটি। অলিম্পিক গেমসকে কেন্দ্র করে ইতোমধ্যে নানা ধরণের স্থাপনা নির্মাণ কাজে হাত দিয়েছে দেশটি। এ সকল স্থাপনা নির্মাণে প্রয়োজন প্রচুর জনশক্তি। আর এ সুযোগ কাজে লাগাতে চায় বাংলাদেশ। ইতোমধ্যে জাপানি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ থেকে শ্রমিক-কর্মী নিতে আগ্রহ দেখিয়েছে।
একুশে টেলিভিশন: আইকোসার একটি প্রতিনিধি দল সম্প্রতি বাংলাদেশ সফর করলো। নতুন বিনিয়োগ আসার ক্ষেত্রে তাদের কাছ থেকে কোনো ইতিবাচক সংবাদ আছে?
তারেক রাফি ভুঁইয়া: আইকোসার প্রতিনিধিদল দল সম্প্রতি বাংলাদেশ সফর করে জাপানে গিয়ে একটি ফলপ্রসু রিপোর্ট তৈরি করেছে। এদিকে আমরা জেবিসিসিয়াই পরবর্তী কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করছি। বাংলাদেশে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে এই রিপোর্টে ইতিবাচক সাড়া পাওয়া গিয়েছে।
একুশে টেলিভিশন: গেল এক দশকে বাংলাদেশে জাপানি বিনিয়োগে নতুন কোম্পানির সংখ্যা বেড়েছে চারগুন। দুইটি জাপানি অর্থনৈতিক অঞ্চলও প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে। এরপর বাংলাদেশের তুলনায় ইন্দোনেশিয়া, ভারত কিংবা ফিলিপাইনে বেশি জাপানি বিনোয়োগ চলে যাচ্ছে। কি কারণ মনে করেন?
তারেক রাফি ভুঁইয়া: ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড কিংবা ফিলিপাইন আজকে যে অবস্থানে পৌঁছেছে, তার পেছনে সবচেয়ে বড় অবদান জাপানিদের। জাপানি প্রতিষ্ঠানগুলো ওই সব দেশে কারখানা করেছে, প্রযুক্তি হস্তান্তর করেছে, এতে করে তাদের স্থানীয় শিল্পের সক্ষমতা তৈরি হয়েছে। তবে আশার বিষয় হল বাংলাদেশেও জাপানি প্রতিষ্ঠানগুলোর বিনিয়োগ বাড়াচ্ছে। পাশাপাশি জাপান সরকারও বাংলাদেশে তাদের উন্নয়ন সহায়তা বাড়িয়েছে। একই সঙ্গে জাপানের বাজারে বাংলাদেশের পণ্যের রপ্তানি বাড়ছে। এতে করে জাপান বাংলাদেশের বড় বাণিজ্য ও বিনিয়োগ অংশীদার হয়ে উঠছে।
সাম্প্রতিককালে থাইল্যান্ডে সফরে আমি ১১ টি দেশের প্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে একটি আন্তর্জাতিক সেমিনারে অংশগ্রহণ করি। সেমিনারে আমি বাংলাদেশের বিনিয়োগের বিভিন্ন সুযোগ এবং সম্ভাবনাময় খাতগুলোর উপরে আলোকপাত করেছিলাম। আমি সেখানে প্রচুর সাড়া পেয়েছি। জাপানের ব্যাংকিং সেক্টরের প্রচুর ব্যক্তিবর্গ বাংলাদেশে বিনিয়োগের আগ্রহ প্রকাশ করেছে। এস এম ই খাতে বাংলাদেশের বিপুল সম্ভাবনা দেখছে জাপান।
আমার মনে হয়েছে বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান দক্ষ জনগোষ্ঠী, উৎসাহী যুবসমাজের স্পৃহা এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ফলে বিশাল এক বাজার হিসেবে দেখা দিয়েছে জাপানের কাছে। বাংলাদেশের উন্নয়নের জন্য অপার সম্ভাবনা নিয়ে তৈরি আছে জাপান। জাপানি বিনিয়োগকারীদের জন্য নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজারে প্রতিষ্ঠা করা হচ্ছে জাপানি অর্থনৈতিক অঞ্চল। অর্থনৈতিক অঞ্চলে বিনিয়োগের মাধ্যমে জাপান বাণিজ্যিক দিক দিয়ে আরও নিবিড়ভাবে বাংলাদেশের সাথে জড়িয়ে যাচ্ছে।
এসি
আরও পড়ুন