উচ্চ আদালত ছিল হাসিনার ‘রাজনৈতিক হাতিয়ার’
প্রকাশিত : ০৯:৩৪, ১০ অক্টোবর ২০২৪
সুপ্রিম কোর্টকে রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির হাতিয়ারে পরিণত করা হয় বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে। উচ্চ আদালতের পরতে পরতে রয়েছে এই রাজনীতিকরণের চিহ্ন। এই দলীয়করণের প্রভাব পড়েছে বিচার কাজেও।
বিশ্লেষকরা বলছেন, চরম দলীয়করণের কারণেই বিচার বিভাগে নজিরবিহীন ইতিহাস তৈরি হয়েছে। একযোগে প্রধান বিচারপতিসহ আপিল বিভাগের ছয়জন বিচারপতি পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছেন। তবে এখনো হাইকোর্ট বিভাগে দলীয় লেজুড়বৃত্তিতে জড়িত অনেক বিচারপতি তাদের পদে বহাল রয়েছেন। সে কারণে বিভিন্ন মহল থেকে তাদেরও পদত্যাগের দাবি উঠেছে।
জানা গেছে, ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর টানা ১৬ বছর ক্ষমতায় ছিলেন শেখ হাসিনার সরকার। এই পুরো সময়ে উচ্চ আদালতে যত বিচারপতি নিয়োগ হয়েছে, তার প্রায় অধিকাংশই হয়েছে রাজনৈতিক বিবেচনায়। বিচারপতি নিয়োগের কোনো নিয়মনীতি না থাকায় এই সুযোগ আরও বেশি করে কাজে লাগিয়েছে বিগত সরকার।
বিচারপতি নিয়োগ হয় মূলত সিনিয়র জেলা জজ, অ্যাটার্নি জেনারেল কার্যালয়ে কর্মরত ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল ও আইনজীবীদের মধ্য থেকে। জেলা জজদের মধ্যে যারা সরকারের অনুগত ছিলেন, তারাই উচ্চ আদালতে নিয়োগে প্রাধান্য পেয়েছেন। এ ছাড়া আইনজীবী ও ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল থেকে যাদের নিয়োগ করা হয়েছে, তাদের মধ্যে কেউ ছিলেন সরাসরি আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। আবার কারও কারও কপালে ছিল ছাত্রলীগের তিলক। অনেকে ছিলেন আওয়ামী লীগ নেতাদের আত্মীয়স্বজন ও আশীর্বাদপুষ্ট।
আদালত সূত্রে জানা গেছে, ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর পরই ওয়ান-ইলেভেনে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে দায়ের করা সব দুর্নীতির মামলায় খালাস দেন হাইকোর্ট। আর এই রায়গুলোর বেশিরভাগ দিয়েছিলেন তৎকালীন বিচারপতি শামসুল হুদা মানিক। তিনি ১৯৮৬-৮৭ সালে গোপালগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিলেন। এরপর ২০১০ সালে ১১ এপ্রিল ১৭ জনকে অতিরিক্ত বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ দেন বিগত সরকার।
১৮ এপ্রিল বিচারপতি রুহুল কুদ্দুস বাবু ও খসরুজ্জামান ছাড়া বাকিদের শপথবাক্য পাঠ করান সাবেক প্রধান বিচারপতি মো. ফজলুল করিম। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হত্যা মামলার আসামি বিচারপতি রুহুল কুদ্দুস এবং চারদলীয় জোট সরকারের আমলে ২০০৬ সালে প্রধান বিচারপতির এজলাস ও অ্যাটর্নি কার্যালয় ভাঙচুর মামলার আসামি হওয়ায় মো. খসরুজ্জামানকে সাবেক প্রধান বিচারপতি শপথ পাঠ করাননি। পরে বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক প্রধান বিচারপতির দায়িত্ব নিয়ে তাদের শপথ পাঠ করান।
বিচারপতি খায়রুল হকও ছিলেন দলীয় বিবেচনায় নিয়োগপ্রাপ্ত। তিনি বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক বিষয়ে সাবেক সরকারের পক্ষে সিদ্ধান্ত প্রদান করেন। আর এর বিনিময়ে বিগত সরকারের পতন পর্যন্ত প্রধান বিচারপতির সমান সুযোগ-সুবিধায় আইন কমিশনের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করে যান।
আপিল বিভাগের সাবেক বিচারপতি নুরুজ্জামান নোনি ও হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি মো. জাহাঙ্গীর হোসেন বাদলের বাড়ি কিশোরগঞ্জে হওয়ায় তারা সাবেক রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদের আস্থাভাজন হিসেবে পরিচিত। বিচারপতি নুরুজ্জামান নোনি ঢাকা আইনজীবী সমিতির আওয়ামী ফোরামের সভাপতি ছিলেন। আর জাহাঙ্গীর হোসেন বাদল অধস্তন আদালতের অন্তত ৬০ জন সিনিয়র জেলা জজকে ডিঙিয়ে নিয়োগ পান।
সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী ডা. মুরাদ হাসানের আপন বড় ভাই বিচারপতি মাহমুদ হাসান তালুকদার এখন হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি। সাবেক ডেপুটি স্পিকার ফজলে রাব্বী মিয়ার জামাই বিচারপতি খুরশীদ আলম সরকার। আর বিচারপতি খুরশীদ আলম সরকারের ভগ্নিপতি বিচারপতি রিয়াজ উদ্দিন খান। সাবেক বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিকের ভাতিজি জামাই বিচারপতি জাফর আহমেদ।
বিচারপতি খিজির হায়াত ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সভাপতি। এছাড়া কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ নেতা ছিলেন এমন অনেকেও রয়েছেন হাইকোর্টের বিচারপতি হিসেবে। বিচারপতি সর্দার মো. রাশেদ জাহাঙ্গীর ১৯৭৩ সালে প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী আওয়ামী লীগের এমপি সর্দার মো. জাহাঙ্গীরের ছেলে।
ব্যারিস্টার তাপসের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠজন হিসেবে পরিচিত বিচারপতি এ কে এম রবিউল হাসান। সাবেক আইনমন্ত্রী ঘনিষ্ঠজন হিসেবে পরিচিত এবং গোপালগঞ্জে বাড়ি হওয়ায় নিয়োগ পান কে এম ইমরুল কায়েস।
বিচারপতি মো. বদরুজ্জামান ছাত্রলীগের নেতা ও তার স্ত্রী সাবেক ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল জান্নাতুল ফেরদৌসী রূপা। এই রূপার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে এবং সে দুবার বগুড়া থেকে আওয়ামী লীগের নমিনেশন চেয়েছিলেন।
সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলমের ঘনিষ্ঠজন হিসেবে নিয়োগ পান বিচারপতি বিশ্বজিত দেবনাথসহ বেশ কয়েকজন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল। তাদের মধ্যে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে গত ১৬ জুলাই ৬ জনের মৃত্যুর ঘটনা তদন্তে আওয়ামী সরকার সাবেক ছাত্রলীগ নেতা ও সাবেক ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল বিচারপতি খন্দকার দিলীরুজ্জামানকে দিয়ে একটি বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশন গঠন করে। এই কমিশনকে দিয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে নিহতের তদন্ত ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার উদ্দেশ্য ছিল সাবেক সরকারের।
এদিকে গতকাল বুধবার (১০ অক্টোবর) আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল বলেছেন, সুপ্রিম কোর্টের অনেক বিচারপতি ফ্যাসিবাদী সরকারের সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করেছেন। ছাত্র-জনতার পক্ষ থেকে তাদের পদত্যাগের দাবি উঠেছে। এসব বিচারপতির বিরুদ্ধে আইনি কাঠামোর মধ্যে থেকে সুপ্রিম কোর্টের নিজেদেরই ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ রয়েছে।
সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সহ-সম্পাদক অ্যাডভোকেট সৈয়দ মামুন মাহবুব বলেন, বিগত সাড়ে ১৫ বছরের শাসনামলে শেখ হাসিনা বিচারপতি থেকে শুরু করে প্রধান বিচারপতি নিয়োগ পর্যন্ত সব নিয়োগ নিয়ন্ত্রণ করেছেন। তাদের অনেকেই এখনো উচ্চ আদালতে বহাল রয়েছেন। তাদের অনতিবিলম্বে পদত্যাগ করতে হবে।
এসএস//
আরও পড়ুন