ঢাকা, মঙ্গলবার   ০৫ নভেম্বর ২০২৪

কে এই ডাক্তার সাবরিনা?

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ২০:১৮, ১২ জুলাই ২০২০ | আপডেট: ২০:৩৪, ১২ জুলাই ২০২০

ডা. সাবরিনা শারমিন হুসাইন

ডা. সাবরিনা শারমিন হুসাইন

রিজেন্ট হাসপাতাল ও জেকেজি হেলথ কেয়ারের প্রতারণা নিয়ে দেশে এখন তোলপাড় চলছে। চলমান করোনা মহামারিতে মানুষের জীবন নিয়ে নির্মম প্রতারণার অভিযোগে উঠে এসেছে সাবরিনা শারমিন চৌধুরী নামে এক চিকিৎসক ও তার প্রতারক স্বামী জেকেজির প্রধান নির্বাহী আরিফ চৌধুরীর নাম। প্রতিষ্ঠানটির ব্যাপারে বিশদ তদন্ত করতে গিয়েই মূলত উঠে আসে তাদের নাম। দুজনেই অবশ্য এখন আইনের আওতায়। রিমান্ডে নেয়ার কথা জানিয়েছে পুলিশ। অন্যদিকে, জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটের কার্ডিয়াক সার্জন ডা. সাবরিনাকে বরখাস্ত করেছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়।

পুলিশের তদন্তে পাওয়া তথ্যানুযায়ী, ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে নমুনা সংগ্রহ করে কোনো পরীক্ষা না করেই প্রতিষ্ঠানটি ১৫ হাজার ৪৬০ জনকে করোনার টেস্টের ভুয়া রিপোর্ট সরবরাহ করেছে। একটি ল্যাপটপ থেকে গুলশানে তাদের অফিসের ১৫ তলার ফ্লোর থেকে এই মনগড়া করোনা পরীক্ষার প্রতিবেদন তৈরি করে হাজার হাজার মানুষের মেইলে পাঠায় তারা। 

জেকেজির কার্যালয় থেকে জব্দ ল্যাপটপ পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর করোনা টেস্ট জালিয়াতির এমন চমকপ্রদ তথ্য মিলেছে। এতে দেখা গেছে, টেস্টের জন্য জনপ্রতি নেওয়া হয় সর্বনিম্ন পাঁচ হাজার টাকা। বিদেশি নাগরিকদের কাছে জনপ্রতি একশ' ডলার। এ হিসাবে করোনার টেস্ট বাণিজ্য করে জেকেজি হাতিয়ে নিয়েছে সাত কোটি ৭০ লাখ টাকা।

পুলিশ জানিয়েছে, জেকেজি হেলথকেয়ার থেকে ২৭ হাজার রোগীকে করোনার টেস্টের রিপোর্ট দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে ১১ হাজার ৫৪০ জনের করোনার নমুনার আইইডিসিআরের মাধ্যমে সঠিক পরীক্ষা করানো হয়েছিল। বাকি ১৫ হাজার ৪৬০ রিপোর্ট প্রতিষ্ঠানটির ল্যাপটপে তৈরি করা হয়। জব্দ করা ল্যাপটপে এর প্রমাণ মিলেছে। আরিফ চৌধুরীকে জিজ্ঞাসাবাদে পুলিশকে জানান, জেকেজির ৭-৮ কর্মী ভুয়া রিপোর্ট তৈরি করেন।

জানা যায়, জেকেজির চেয়ারম্যান ডা. সাবরিনা চৌধুরী জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটের চিকিৎসক। তার স্বামীর নাম আরিফ চৌধুরী। এই দম্পতির জীবনও রূপকথার মতো। আরিফের চতুর্থ স্ত্রী সাবরিনা। আরিফের এক স্ত্রী থাকেন রাশিয়ায়, অন্য একজন লন্ডনে। আরেকজনের সঙ্গে তার ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে। তবে ছাড়াছাড়ির পরও সাবেক ওই স্ত্রী বিভিন্ন জায়গায় আরিফের জন্য দেনদরবার করে যাচ্ছেন।

তদন্ত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মূলত সাবরিনার হাত ধরেই করোনার স্যাম্পল কালেকশনের কাজটি হাতিয়ে নেয় অনেকটা অখ্যাত জেকেজি নামের এই প্রতিষ্ঠান। প্রথমে তিতুমীর কলেজে মাঠে স্যাম্পল কালেকশন বুথ স্থাপনের অনুমতি মিললেও প্রভাব খাটিয়ে ঢাকার অন্য এলাকা আর অনেক জেলা থেকেও নমুনা সংগ্রহ করছিলেন তারা। স্বামী-স্ত্রী মিলে করোনা টেস্ট করলেও তাদের দাম্পত্য জীবন সুখের নয়। স্ত্রীর সঙ্গে অশালীন অবস্থায় দেখতে পেয়ে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের এক চিকিৎসককে মারধর করেন আরিফ চৌধুরী। পরে এ ঘটনায় স্বামীর বিরুদ্ধে শেরেবাংলা নগর থানায় জিডি করেন ডা. সাবরিনা। এছাড়া জেকেজির এক কর্মীকে অশালীন প্রস্তাব দেওয়ার ঘটনায় গুলশান থানার আরিফ চৌধুরীর বিরুদ্ধে মামলা রয়েছে। বিএমএর নেতার পরিচয় ভাঙিয়ে চলাফেরা করেন সাবরিনা।

গত ২৪ জুন জেকেজির গুলশান কার্যালয়ে অভিযান চালিয়ে আরিফসহ ছয়জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাদের দুই দিনের রিমান্ডে নেওয়া হয়। দু'জন আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেন। জেকেজির কার্যালয় থেকে ল্যাপটপসহ বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ নথি জব্দ করে পুলিশ। এ ঘটনায় তেজগাঁও থানায় মোট চারটি মামলা দায়ের করা হয়। সন্দেহভাজন করোনা রোগীদের নমুনা সংগ্রহের জন্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সঙ্গে চুক্তি ছিল জেকেজির। পরে ওই চুক্তি বাতিল করা হয়।

জানা যায়, জেকেজিতে চাকরি করতেন নার্স তানজিনা পাটোয়ারী ও তার স্বামী হুমায়ূন কবির। তানজিনার বেতন ছিল ৩০ হাজার টাকা। ভুয়া করোনা পরীক্ষা করে কোটি কোটি টাকা কামানো দেখে তানজিনা দাবি করেন তার বেতন বাড়িয়ে দিতে হবে। বিষয়টি জেকেজির কর্ণধার আরিফ চৌধুরী জেনে তানজিনা ও তার স্বামীকে চাকরিচ্যুত করেন। পরে তারা দুজন বাসায় বসে নিজেরাই করোনার ভুয়া টেস্টের বাণিজ্য চালান।

তানজিনা নমুনা সংগ্রহ করতেন আর ঘরে বসে তার স্বামী রিপোর্ট তৈরি করতেন। ২৩ জুন রাতে তানজিনা ও তার স্বামী গ্রেফতার হওয়ার পর বেরিয়ে আসে জেকেজির প্রতারণার রহস্য। এর পর জেকেজির গুলশান অফিসে অভিযান চালিয়ে গ্রেফতার করা হয় প্রতারক আরিফ চৌধুরীসহ অন্যদের। ওই দিনই প্রতিষ্ঠানটির কিছু কর্মী আরিফকে ছাড়িয়ে নিতে তেজগাঁও থানায় জড়ো হন। তারা থানার বাইরে হট্টগোল করতে থাকেন। এ ঘটনায় পৃথক একটি মামলা হয়েছে। ওই মামলায় ১৮ জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ।

এদিকে, রেজিস্টার্ড চিকিৎসক হয়েও ডা. সাবরিনা নিজের খেয়াল-খুশিমত হাসপাতালে আসতেন বলেই জানা গেছে। নিজেকে দেশের প্রথম নারী কার্ডিয়াক সার্জন দাবি করতেন তিনি। সহকর্মীদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার, মিথ্যাচার, অনৈতিক সুবিধা নেয়াসহ নানা অভিযোগ জেকেজি চেয়ারম্যান ডা. সাবরিনার বিরুদ্ধে। যদিও এ অভিযোগের বিষয়ে কোনো কথা বলতে রাজি হননি ডা. সাবরিনা। তার কর্মকাণ্ডে বিব্রত জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট প্রশাসন। তিন দিনের মধ্যে লিখিত ব্যাখ্যা দেয়ারও নির্দেশ দেয়া হয়েছে ডা. সাবরিনাকে। তবে তার আগেই জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটের কার্ডিয়াক সার্জন ডা. সাবরিনাকে বরখাস্ত করেছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়।

বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নিজেকে বাংলাদেশের প্রথম নারী কার্ডিয়াক সার্জন হিসেবে দাবি করে আসছিলেন ডা. সাবরিনা আরিফ চৌধুরী। এমনকি এ দাবির পক্ষে অনড়ও থাকেন তিনি। যদিও তার এ দাবিকে পুরোপুরি মিথ্যা বলে আখ্যা দিলেন হৃদরোগ ইনস্টিউটিউটের কার্ডিয়াক সার্জারি বিভাগের প্রধান এবং তার অন্য সহকর্মীরাও।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক তার এক সহকর্মী বলেন, কথাটা একদমই যুক্তিসঙ্গত নয়। প্রথম নারী কার্ডিয়াক হিসেবে এই ইনস্টিউটিউট থেকে পাস করেছেন শিমু পাল আপু। তিনি এখন পরিবারসহ যুক্তরাষ্ট্র থাকেন। 

হৃদরোগ ইনস্টিটিউটের রেজিস্ট্রার চিকিৎসক হয়েও নিয়মিত দায়িত্ব পালন না করা, নিজের ইচ্ছেমত চলা, অনৈতিক সুবিধা নেয়া, এমনকি অধীনস্থদের সাথে দুর্ব্যবহার করাসহ অনেক অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। এ বিষয়ে সাবরিনার দাবি, জেকেজির সিইও আরিফ চোধুরীর সঙ্গে অনেক আগেই বিচ্ছেদ হয়েছে তার। কিন্তু প্রশ্ন দাঁড়িয়েছে, বিচ্ছেদের পরও কেন স্বামীর সাথে জেকেজির হয়ে কাজ করেছেন তিনি।

এর জবাবে সাবরিনা বলেন, ওনার সাথে আমার বনিবনা হচ্ছিলো না। গত আড়াই মাস ধরে আমি আমার বাবার বাসায় অবস্থান করছি। যদিও সাবরিনার চেম্বারে গিয়ে দেখা যায়, স্বামী আরিফের নামের সাথেই যুক্ত করেই রয়েছে তার নাম।

সাবিরনার এমন অনেক কর্মকাণ্ডের বিষয়ে বিব্রত জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটের প্রশাসন। তিন দিনের মধ্যে এসব বিষয়ে লিখিত ব্যাখ্যা দেয়ার নির্দেশও দেয়া হয়েছে। কোনো অনৈতিক কর্মকাণ্ডের দায় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ নেবে না বলেও জানিয়েছেন হৃদরোগ ইনস্টিটিউটের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক।

এদিকে, জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটের কার্ডিয়াক সার্জন ডা. সাবরিনা শারমিন হুসাইনকে বরখাস্ত করেছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। রোববার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব মো. আব্দুল মান্নান স্বাক্ষরিত আদেশে তাকে বরখাস্ত করা হয়।

বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের কার্ডিয়াক সার্জারি বিভাগের রেজিস্ট্রার ডা. সাবরিনা শারমিন হুসাইন চাকরিতে থেকেও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান জেকেজি’র চেয়ারম্যান হিসেবে কর্মরত ছিলেন। করোনা পরীক্ষার ভুয়া রিপোর্ট প্রদান ও অর্থ আত্মসাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন বলে আজ ১২ জুলাই পুলিশের হাতে তিনি গ্রেপ্তার হয়েছেন।

বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়, সরকারি কর্মকর্তা হয়ে সরকারের অনুমতি ছাড়াই বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান পদে অধিষ্ঠিত থাকা এবং অর্থ আত্মসাৎ সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা অনুযায়ী শাস্তিযোগ্য অপরাধ। তাই ডা. সাবরিনা শারমিন হুসাইনকে সরকারি কর্মচারী বিধিমালার বিধি ১২ (১) অনুযায়ী সাময়িক বরখাস্ত করা হলো। সাময়িক বরখাস্তকালীন সময়ে তিনি বিধি অনুযায়ী খোরপোষ ভাতা প্রাপ্ত হবেন। এ আদেশ অবিলম্বে কার্যকর হবে।

এর আগে ডা. সাবরিনাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তেজগাঁও বিভাগীয় উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) কার্যালয়ে ডাকা হয়েছিল দুপুরে। কয়েক ঘণ্টা জিজ্ঞাসাবাদের পর তাকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়। তেজগাঁও বিভাগের উপকমিশনারহারুন অর রশিদ আজ সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, সোমবার সাবরিনাকে নেয়া হবে আদালতে। 

ডিসি মোহাম্মদ হারুন বলেন, ডা. সাবরিনাকে জিজ্ঞাসাবাদে যেসব প্রশ্ন করা হয়েছে তিনি সেগুলোর সন্তোষজনক উত্তর দিতে পারেননি। তাই তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। মামলার তদন্তের জন্য তাকে অধিকতর জিজ্ঞাসাবাদ করতে হবে। সোমবার তাকে আদালতে পাঠিয়ে রিমান্ড চাইবে পুলিশ।

এনএস/


Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি