সিনহা হত্যায় প্রদীপ-লিয়াকতের মৃত্যুদণ্ড
প্রকাশিত : ১৬:৩৫, ৩১ জানুয়ারি ২০২২ | আপডেট: ১৭:২২, ৩১ জানুয়ারি ২০২২
প্রদীপ কুমার, লিয়াকত আলী
দেড় বছর আগের আলোচিত সিনহা মো. রাশেদ খান হত্যা মামলায় টেকনাফ থানার সাবেক ওসি প্রদীপ কুমার দাশ ও বাহারছড়া তদন্ত কেন্দ্রের সাবেক পরিদর্শক লিয়াকত আলীকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে আদালত।
সোমবার (৩১ জানুয়ারি) বিকেলে ৩০০ পৃষ্ঠার রায় পাঠের সময় তাদের দুজনের সর্বোচ্চ সাজা মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা করেন কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ মোহাম্মদ ইসমাঈল।
দুপুর ২টা ২৫ মিনিটে এজলাসে এসে আদালতের কার্যক্রম শুরুর পর মামলা সম্পর্কে প্রাসঙ্গিক আলোচনা করেন বিচারক। এরপর শুরু করেন অপরাধের পর্যবেক্ষণ বয়ান।
সাক্ষ্য প্রমাণে কার কী অপরাধ সেসব তুলে ধরার পর হত্যায় সংশ্লিষ্টতার অপরাধ অনুসারে সাজা ঘোষণা শুরু করেন। এ সময় প্রধান দুই অভিযুক্তকে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডাদেশ দিয়েছেন আদালত।
সিনহাকে হত্যায় সহযোগিতা এবং ঘটনা ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টার অভিযোগে তিন পুলিশ সদস্য এবং পুলিশের তিন সোর্সকে দেওয়া হয়েছে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড।
মামলার ১৫ আসামির মধ্যে বাকি চার পুলিশ সদস্য এবং তিন এপিবিএন সদস্যকে বেকসুর খালাস দিয়েছে আদালত।
এর আগে সকালে আদালতে হাজির করা হয় মামলায় অভিযুক্ত বিতর্কিত ওসি (বরখাস্ত) প্রদীপ কুমার ও লিয়াকতসহ ১৫ আসামিকে।
(বাঁ থেকে) পরিদর্শক লিয়াকত আলী, ওসি প্রদীপ কুমার দাশ, এসআই নন্দ দুলাল রক্ষিত, লিটন মিয়া, কনস্টেবল সাফানুর করিম, কামাল হোসেন আজাদ, আব্দুল্লাহ আল-মামুন, নুরুল আমিন, মোহাম্মদ আয়াজ, নেজাম উদ্দিন, এসআই মোহাম্মদ শাহজাহান আলী, মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ, কনস্টেবল মোহাম্মদ রাজীব হোসেন, কনস্টেবল রুবেল শর্মা এবং এএসআই সাগর দেব।
আদালতের সরকারি কৌঁসুলি, বাদী পক্ষের আইনজীবী ও আসামি পক্ষের কৌঁসুলিসহ বাদী ও বিবাদীদের স্বজন এবং সংশ্লিষ্টরা এজলাসে উপস্থিত ছিলেন। রায়কে কেন্দ্র করে আদালতের চারপাশে জোরদার করা হয়েছিল নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা ব্যবস্থা।
আসামিদের বিরুদ্ধে যত অভিযোগ
এক নজরে জেনে নিই, মেজর সিনহা হত্যা মামলায় আসামিদের বিরুদ্ধে যত অভিযোগ:
প্রদীপ কুমার দাশ: প্রদীপ কুমার দাশ টেকনাফ মডেল থানার সাবেক অফিসার ইনচার্জ। তিনি মেজর সিনহা হত্যা মামলার ২ নম্বর আসামি। তদন্ত প্রতিবেদনে তার বিরুদ্ধে অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মো. রাশেদ খানকে হত্যার ষড়যন্ত্র, পরিকল্পনা, প্ররোচনা ও জড়িত থাকার অভিযোগ আনা হয়। হত্যাকাণ্ডের ঘটনাকে ধামাচাপা দিয়ে ভিন্ন খাতে নেওয়ার চেষ্টার অভিযোগও তোলা হয় তার বিরুদ্ধে।
লিয়াকত আলী: ইন্সপেক্টর মো. লিয়াকত আলী। বাহারছড়া তদন্ত কেন্দ্রের সাবেক আইসি। তিনি সিনহা হত্যা মামলার ১ নম্বর আসামি। অভিযোগপত্র বলছে, পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মো. রাশেদ খানকে গুলি করে সরাসরি হত্যাকাণ্ডে অংশগ্রহণ করেন লিয়াকত আলী।
নন্দদুলাল রক্ষিত:
নন্দদুলাল রক্ষিত বাহারছড়া তদন্ত কেন্দ্রের এসআই। মামলার ৩ নম্বর আসামি তিনি। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি ইন্সপেক্টর লিয়াকত আলীর সহযোগী হিসেবে ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে সিনহা হত্যাকাণ্ডের সহযোগিতা করেছেন। ওসি প্রদীপের অবৈধ আদেশে সিনহার প্রাইভেটকার থেকে ইয়াবা ও গাজা উদ্ধার না হওয়া সত্ত্বেও ভুয়া জব্দ তালিকা করেছেন। ভিক্টিম সিনহা ও প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষী সিফাতের বিরুদ্ধে বাদী হয়ে মিথ্যা মামলা করেছেন।
নুরুল আমিন, নিজাম উদ্দিন ও আইয়াছ উদ্দিন:
নুরুল আমিন, নিজাম উদ্দিন ও আইয়াছ উদ্দিন টেকনাফ থানা পুলিশের সোর্স এবং সাজানো মামলার সাক্ষী। এই তিন জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ, ঘটনার শুরুতে তারা ওসি প্রদীপ ও লিকায়তের সঙ্গে গোপন বৈঠক করেন। সিনহাকে ডাকাত সাজিয়ে মেরে ফেলার চেষ্টা করেন। তাতে ব্যর্থ হয়ে সিনহার চলাচলের খবর লিয়াকতকে ফোনে জানিয়ে দেন। পরিকল্পনা ও যোগসাজশের মাধ্যমে তারা হত্যাকাণ্ড ঘটনা।
দেড় বছরের ঘটনাক্রম
৩১ জুলাই ২০২০: ২০২০ সালের ৩১ জুলাই রাতে কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভ সড়কের টেকনাফ উপজেলার বাহারছড়া ইউনিয়নের শামলাপুর চেকপোস্টে পুলিশের গুলিতে নিহত হন সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান।
সিনহা মো. রাশেদ খান
১ অগাস্ট ২০২০:
সিনহার সঙ্গে তথ্যচিত্র নির্মাণে যুক্ত সাইদুল ইসলাম সিফাতের বিরুদ্ধে টেকনাফ থানায় দুটি এবং শিপ্রা দেবনাথের বিরুদ্ধে রামু থানায় একটি মামলা দায়ের করে পুলিশ।
সরকারি কাজে বাধা প্রদান এবং মাদক আইনে অভিযোগ আনা হয় সিফাতের বিরুদ্ধে। শিপ্রার বিরুদ্ধে হয় মাদকের মামলা।
ঘটনার পর দেশব্যাপী আলোচনার মধ্যে ইনচার্জ লিয়াকত আলীসহ টেকনাফের বাহারছড়া তদন্তকেন্দ্রের ২০ জন পুলিশ সদস্যকে প্রত্যাহার করা হয়।
২ অগাস্ট ২০২০: ঘটনা তদন্তে ১ অগাস্ট গঠন করা উচ্চ পর্যায়ের কমিটি পরদিন পুনর্গঠন করা হয়। যুগ্মসচিব পর্যায়ের এক কর্মকর্তার নেতৃত্বে ওই কমিটিতে সেনাবাহিনী ও পুলিশের প্রতিনিধিত্বও রাখা হয়েছিল।
৪ অগাস্ট ২০২০: প্রধানমন্ত্রী কার্যালয় জানায়, সিনহার মা নাসিমা আক্তারকে ফোন করে সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচারের আশ্বাস দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
৫ অগাস্ট ২০২০: ২০২০ সালের ৫ অগাস্ট টেকনাফ থানার ওসি প্রদীপ কুমার দাশ এবং বাহারছড়া পুলিশ তদন্তকেন্দ্রের তৎকালীন ইনচার্জ লিয়াকত আলীসহ ৯ জন পুলিশ সদস্যকে আসামী করে কক্সবাজার আদালতে মামলা করেন নিহত সিনহার বড় বোন শারমিন শাহরিয়ার ফেরদৌস।
আদালত মামলাটি নথিভুক্ত করার নির্দেশ দেয়। এ মামলার পাশাপাশি পুলিশের দায়ের করা তিন মামলারও তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয় র্যাবকে।
৫ অগাস্ট ২০২০: সিনহা নিহত হওয়ার পর ব্যাপক আলোচনার মধ্যে কক্সবাজারে বিরল এক সংবাদ সম্মেলনে আসেন তৎকালীন সেনাপ্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদ ও আইজিপি বেনজীর আহমেদ। ঘটনাস্থল শামলাপুর চেকপোস্ট এলাকা পরিদর্শনেও যান তারা।
৫ অগাস্ট ২০২০: ব্যাপক আলোড়নের মধ্যে ঢাকায় সংবাদ সম্মেলনে করে রিটায়ার্ড আর্মড ফোর্সেস অফিসার্স অয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন (রাওয়া)। সেখানে সিনহা নিহতের ঘটনায় দায়ী সব পুলিশ সদস্যকে গ্রেপ্তারের দাবি তোলেন সশস্ত্র বাহিনীর সাবেক কর্মকর্তারা।
৬ অগাস্ট ২০২০: এদিন সকালে মামলাটি নথিভুক্ত করে টেকনাফ থানা। বিকালে মামলায় এজাহারভুক্ত ৯ জন আসামীর মধ্যে ওসি প্রদীপসহ সাত জন পুলিশ সদস্য আদালতে আত্মসমর্পণ করেন। বাকি ছিলেন এসআই টুটুল ও কনস্টেবল মোহাম্মদ মোস্তফা। প্রদীপ-লিয়াকতসহ তিনজনকে রিমান্ডে পাঠায় আদালত।
৭ অগাস্ট ২০২০: ওসি প্রদীপ, পরিদর্শক লিয়াকত, এসআই নন্দলাল রক্ষিত, কনস্টেবল সাফানুর করিম, কনস্টেবল কামাল হোসেন, কনস্টেবল আবদুল্লাহ আল মামুন ও এএসআই লিটন মিয়াকে সাময়িক বরখাস্ত করে পুলিশ।
৯ অগাস্ট ২০২০: আদালত থেকে জামিন পেয়ে গ্রেপ্তারের ৯ দিন পর কক্সবাজার কারাগার থেকে মুক্ত হন সিনহার সহযোগী শিপ্রা দেবনাথ।
১০ অগাস্ট ২০২০: শিপ্রার মুক্তির পরদিন দুই মামলায় জামিন পেয়ে কক্সবাজারের কারাগার থেকে মুক্তি পান সিনহার সহযোগী সাইদুল ইসলাম সিফাত।
১১ অগাস্ট ২০২০: তদন্ত চলার মধ্যে এদিন পুলিশের দায়ের মামলার তিন সাক্ষী টেকনাফের মারিশবুনিয়া এলাকার নুরুল আমিন, মোহাম্মদ আয়াজ ও নিজাম উদ্দিনকে আদালতে সোপর্দ করে র্যাব।
১৮ অগাস্ট ২০২০: প্রথম দফায় সাত দিনের রিমান্ডে নেওয়া হয় ওসি প্রদীপকে। মোট চার দফায় তাকে টানা ১৫ দিন রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করেন তদন্তকারী কর্মকর্তা।
৩০ অগাস্ট ২০২০: হত্যায় জড়িত থাকার স্বীকারোক্তি দিয়ে আদালতে জবানবন্দি দেন মামলার প্রধান আসামী লিয়াকত আলী। জবানবন্দিতে হত্যাকাণ্ডের পেছনে নিজের ও অন্যদের ভূমিকা বিস্তৃতভাবে তুলে ধরেন তিনি। তদন্ত চলাকালে আসামীদের মধ্যে ওসি প্রদীপ ও কনস্টেবল রুবেল শর্মা ছাড়া অন্য ১২ জনই আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন।
১০ সেপ্টেম্বর ২০২০: হত্যা মামলায় কক্সবাজারের তৎকালীন এসপি এবিএম মাসুদ হোসেনকে আসামী হিসেবে অন্তর্ভুক্তির আবেদন করেন সিনহার বোন মামলার বাদী শারমিন শাহরিয়া ফেরদৌস, যা খারিজ করে দেয় আদালত।
১৩ ডিসেম্বর ২০২০: প্রদীপ-লিয়াকতসহ মোট ১৫ জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা র্যাব-১৫ এর জ্যেষ্ঠ সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) খাইরুল ইসলাম। পাশাপাশি সিফাত ও শিপ্রার বিরুদ্ধে তিন মামলায় চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করে র্যাব জানায়, অভিযোগের কোনো সত্যতা তারা পায়নি।
অভিযুক্তদের মধ্যে ১৪ জন কারাগারে থাকলেও টেকনাফ থানার কনস্টেবল সাগর দেব পলাতক ছিলেন। অভিযোগপত্রে সাক্ষী করা হয় ৮৩ জনকে।
২১ ডিসেম্বর ২০২০: অভিযোগপত্র গ্রহণ করে আদালত। পলাতক আসামী কনস্টেবল সাগর দেবের বিরুদ্ধে জারি করা হয় গ্রেপ্তারি পরোয়ানা।
৩১ ডিসেম্বর ২০২০: সিনহার বোনের করা মামলার কার্যক্রম জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম তামান্না ফারাহের আদালত থেকে জেলা ও দায়রা জজ মোহাম্মদ ইসমাইলের আদালতে স্থানান্তর করা হয়।
৩১ ডিসেম্বর ২০২০: ঘটনার পরপর পুলিশের দায়ের করা তিনটি মামলায় চূড়ান্ত প্রতিবেদন গ্রহণ করে সিফাত ও শিপ্রাকে মামলা থেকে অব্যাহতি দেন বিচারক।
২৭ জুন ২০২১: ১৫ আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেন বিচারক। সেই সঙ্গে সাক্ষ্যগ্রহণের জন্য ২৬ থেকে ২৮ জুলাই পর্যন্ত দিন ধার্য করেন।
২৩ অগাস্ট ২০২১: করোনাভাইরাস মহামারীর কারণে আদালতের বিচার কার্যক্রম স্থগিত থাকায় আগের ধার্য দিনগুলোতে সাক্ষ্যগ্রহণ হয়নি। এদিন থেকে সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়। আদালতে ১ ডিসেম্বর পর্যন্ত ৮৩ জন সাক্ষীর মধ্যে ৬৫ জনের সাক্ষ্য ও জবানবন্দি গ্রহণ করা হয়।
৬ ও ৭ ডিসেম্বর, ২০২১: ফৌজদারী কার্যবিধি ৩৪২ ধারায় আদালতে জবানবন্দি দেন আসামীরা।
৯ জানুয়ারি ২০২২: চলতি বছরের ৯ জানুয়ারি আদালতে আইনজীবীদের যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শুরু হয়, যা চলে ১২ জানুয়ারি পর্যন্ত।
১২ জানুয়ারি ২০২২: যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষে আলোচিত এই মামলার রায় ঘোষণার জন্য ৩১ জানুয়ারি দিন ঠিক করে দেন বিচারক মোহাম্মদ ইসমাইল।
এসবি/
আরও পড়ুন