৩০ বছরেও হয়নি চট্টগ্রাম গণহত্যার বিচার
প্রকাশিত : ১৩:২৭, ২৪ জানুয়ারি ২০১৮
আজ ২৪ জানুয়ারি। চট্টগ্রাম গণহত্যা দিবস। এদিন চট্টগ্রামের লালদীঘি ময়দানে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী আওয়ামী লীগ সভাপতি জননেত্রী শেখ হাসিনার জনসভায় পুলিশ নির্বিচারে গুলি চালিয়ে ৩০ জনকে নির্মমভাবে হত্যা করে। ওই হত্যাকাণ্ডের তিন দশক পেরিয়ে গেলেও আজও শেষ হয়নি বিচার।
হত্যাকাণ্ডের চার বছর পর ১৯৯২ সালের ৫ মার্চ আইনজীবী শহীদুল হুদা বাদী হয়ে চট্টগ্রামের তৎকালীন পুলিশ কমিশনার কাজী রকিবুল হুদা এবং কোতোয়ালী জোনের পুলিশ পরিদর্শক (পিআই) গোবিন্দ্র চন্দ্র মণ্ডলসহ মোট ৪৬ জনকে আসামী করে মামলা করেন।
কিন্তু প্রায় তিন দশক পেরিয়ে গেলেও এ ঘটনার কোনো বিচার হয়নি। সাক্ষীর অভাবে থমকে আছে বিচারকাজ। এ নিয়ে নিহতদের স্বজনরা হতাশা ও ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।
জানা গেছে, সাক্ষীরা হাজির না হওয়া, পুলিশের গাফলতি এবং রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীদের উদাসীনতায় ২০০৯ সালের ১০ আগস্টের পর গত সাড়ে সাত বছরে আর কোনো সাক্ষীকে আদালতে হাজির করা সম্ভব হয়নি। অভিযোগ রয়েছে, মামলাটি দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য দ্রুতবিচার ট্রাইব্যুনালে পাঠাতেও কোনো আগ্রহ দেখাচ্ছেন না রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীরা। বর্তমানে মামলাটি চট্টগ্রামের প্রথম অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালতে বিচারাধীন আছে। রাষ্ট্রপক্ষে মামলা পরিচালনাকারী কৌসুলী অ্যাডভোকেট শুভ প্রসাদ বিশ্বাসের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করে তাকে পাওয়া যায়নি।
এ মামলার রাষ্ট্রপক্ষের আরেক কৌসুলী অ্যাডভোকেট অশোক কুমার দাশ বলেন, মামলাটি দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে পাঠাতে আমাদের কোনো সমস্যা নেই। এখন সাক্ষীদের হাজির করতে আদালত বারবার নির্দেশনা দিলেও পুলিশ তাদের হাজির করতে ব্যর্থ হচ্ছে। এ পর্যন্ত ১৬৮ জন সাক্ষীর মধ্যে ৩৫ জন সাক্ষী আদালতে সাক্ষ্য দিয়েছেন।
সর্বশেষ ২০১৫ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি হাজিরার দিন ধার্য থাকা সত্ত্বেও সাক্ষী ডা. মিজানুর রহমান আদালতে উপস্থিত হন নি। যে কারণে মামলার অগ্রগতি তথা কবে নাগাদ বিচারকাজ শেষ হবে এ ব্যাপারে মন্তব্য করা কঠিন। তবে আশা করছি আর দুয়েকজন সাক্ষীর সাক্ষ্য গ্রহণ করার পর মামলার অগ্রগতি হবে। তবে আসামীপক্ষের আইনজীবী প্রদীপ কুমার ধর বলেন, মামলার চার্জশীটভুক্ত আটজন অভিযুক্তের মধ্যে ইতোমধ্যে সাতজনই জামিনে মুক্ত। তাছাড়া রাষ্ট্রপক্ষ সাক্ষীদেরও হাজির করা হচ্ছে না। এমতাবস্থায় মামলাটি ঝুলে আছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ২০০৯ সালের ৯ মে আটজনের বিরুদ্ধে আদালত অভিযোগ গঠন করে। এরা হলেন- নগর পুলিশ কমিশনার মির্জা রকিবুল হুদা, কোতয়ালী জোনের পিআই গোবিন্দ্র চন্দ্র মণ্ডল, হাবিলদার প্রদীপ বড়ুয়া, কনস্টেবল মমতাজ উদ্দিন, মোস্তাফিজুর রহমান, শাহ আবদুল্লাহ, বশির আহমেদ ও আব্দুস সালাম প্রমুখ। এদের মধ্যে গোবিন্দ্র চন্দ্র ঘটনার শুরু থেকেই পলাতক রয়েছেন। আর প্রদীপ বড়ুয়া, মমতাজ উদ্দিন, মোস্তাফিজুর রহমান, শাহ আবদুল্লাহ এবং মির্জা রকিবুল হুদা ২০০৩ সাল থেকে জামিনে রয়েছেন বলে জানা যায়।
অন্যদিকে বশির আহমেদ ও আবদুস সালাম জামিনে থাকা অবস্থায় মারা যান। এদিকে কেবল সাক্ষীর উপস্থিতির অজুহাতে দীর্ঘদিন এমন একটি আলোচিত মামলা ঝুলে থাকা কোনমতেই কাম্য নয় বলে মন্তব্য করেছেন গণহত্যার শিকার স্বপন চৌধুরীর নিকটাত্মীয় আইনজীবী শিবুচন্দ্র মজুমদারবলেন, কেবল ২৪ জানুয়ারি আসলে সবাই গণহত্যার শহীদ পরিবারের খোঁজ করেন। নতুবা সারাবছর কেউ খবরও নেয় না। কি রকম নিগৃহীত জীবন যাপন করছে ওরা তা বলা বাহুল্য।
আমরা চাই সরকার আসামীদের বিচারের আওতায় আনার পাশাপাশি ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের সহায়তায় এগিয়ে আসুক।
কী হয়েছিল সেদিন
১৯৮৮ সালের ২৪ জানুয়ারি। চট্টগ্রামের ঐতিহাসিক লালদীঘির ময়দানে তিল ধারণের ঠাঁই নেই। স্বৈরাচারী দুঃশাসনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়তে মুখিয়ে ছিলো সারাদেশ। তৎকালীন ১৫ দলীয় জোট নেত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার আগমনের প্রহর গুনছিল হাজার হাজার ছাত্র, শ্রমিক ও পেশাজীবী জনতা । বেলা দেড়টার দিকে শেখ হাসিনার গাড়ি কোতোয়ালী থানা হয়ে পুরনো বাংলাদেশ ব্যাংক ভবন অতিক্রম করছিল।
এ সময় স্বৈরশাসকের পেটোয়া বাহিনী মুক্তিকামী জনতার গণজোয়ার দেখে ভয়ে দিশেহারা হয়ে পরে। তাই এ সমাবেশ বানচাল করে দিতে তৎকালীন সিএমপি কমিশনার রকিবুল হুদার নির্দেশে গর্জে উঠে পুলিশ বাহিনীর রাইফেল। আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা মৃত্যুভয় উপেক্ষা করে নেত্রীকে বাঁচাতে মানববর্ম রচনা করেন।
কিছু বুঝে উঠার আগেই শুরু হয় অতর্কিত গুলি। সেদিনের সেই নারকীয় হত্যাযজ্ঞে আওয়ামী লীগ ও অঙ্গ সংগঠনগুলোর নেতাকর্মী এবং আইনজীবী, চিকিৎসকসহ অন্তত ২৪ জন বেসামরিক লোক শহীদ হন। আহত হন আরও প্রায় তিন শতাধিক ব্যাক্তি। নৃশংসতার একপর্যায়ে পুলিশের কড়া পাহারায় নিহতদের রাতের আঁধারে নগরীর অভয়মিত্র মহাশ্মশানে পুড়িয়ে ফেলা হয়। অন্যদিকে চলে লাশ গুম করার চেষ্টা।
১৯৮৮ সালের ২৪ জানুয়ারির সেই নারকীয় হত্যাকাণ্ডে নিহতদের স্মরণে চট্টগ্রাম আদালত ভবনের প্রধান ফটকে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়েছে। যেখানে নিহত ২৪ জনের নাম লিপিবদ্ধ করা আছে। এটি ১৯৯২ সালের ২৪ জানুয়ারি উদ্বোধন করেন। গণহত্যায় নিহত সেই ২৪ জন হলেন- মোহাম্মদ হাসান মুরাদ, সীতাকুন্ড ডিগ্রী কলেজ ছাত্রলীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক মহিউদ্দিন শামীম, ছাত্রনেতা স্বপন কুমার বিশ্বাস, কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ নেতা এথেলবাট গোমেজ কিশোর, স্বপন চৌধুরী, অজিত সরকার, ক্ষেতমজুর নেতা রমেশ বৈদ্য, বদরুল আলম, হোটেল শ্রমিক জি.কে চৌধুরী, ছাত্রনেতা সাজ্জাদ হোসেন, আবদুল মান্নান, সবুজ হোসেন, কামাল হোসেন, বি.কে দাশ, পঙ্কজ বৈদ্য, বাহার উদ্দিন, চান্দ মিয়া, সমর দত্ত, হাসেম মিয়া, মোহাম্মদ কাশেম, পলাশ দত্ত, আবদুল কুদ্দুস, গোবিন্দ দাশ এবং শাহাদাত প্রমুখ।
/ এআর /
আরও পড়ুন