শিশুকে পরনির্ভরশীল করে গড়ে তুলবেন না
প্রকাশিত : ১৫:১৮, ৭ ডিসেম্বর ২০১৮ | আপডেট: ১১:৪২, ৮ ডিসেম্বর ২০১৮
আমাদের চারপাশে তাকালে দেখা যায়, কিছু মানুষ আছেন যারা খুব পরিশ্রম করেন। বলা যায়, তারা কর্মঠ ও আত্মনির্ভরশীল। আবার অনেকে আছেন অলস সময় পার করছেন। তারা অন্যের উপর নির্ভরশীল। কেন এমনটি হয়? এর জন্য অনেকে অবশ্য পারিবারিক পরিমণ্ডল ও পারিপাশ্বিক অবস্থাকেই দায়ী করছেন।
আসলে সহযোগিতা ও যত্নের দোহাই দিয়ে আমরা শুরু থেকেই একটি শিশুকে পরনির্ভশীল করে গড়ে তুলছি। প্রাকৃতিকভাবেই শিশুর সহজাত প্রবণতা হল সে খুব দ্রুত স্বনির্ভর হতে চায়। মাতৃস্নেহ বা অতিশয় যত্ন বা সহযোগিতার নামে যখন শিশুকে কোনো কাজ করতে দেয়া হয় না তখন এই শিশু পরনির্ভরশীল হয়ে গড়ে উঠে। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে শিশু নানা ধরনের প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবেলা করেই এগিয়ে যাবে। পথে পথে বাধা আসবে। এই বাধা অতিক্রমের দায়িত্ব শিশুরই। অথচ মা-বাবা মনে করেন- সন্তানের মঙ্গলের জন্য তাকে সহযোগিতা করছেন। কিন্তু অধিকাংশ পিতা-মাতাই এই জায়গায় ভুল করেন এবং তাদের অবর্তমানে এই শিশুরাই সবচেয়ে বেশি বিপদে পড়ে।
এক্ষেত্রে প্রথম ভুলটি আমরা করি শিশুকে খাওয়ানোর ক্ষেত্রে। শিশু খেতে দেরি করবে, জামা নষ্ট করবে, আশে পাশে খাবার ফেলে পরিবেশ নোংরা করবে-এই ভেবে শিশুকে সবসময় খাইয়ে দেয়ার চেষ্টা করি। এটি আমাদের ভ্রান্ত দৃষ্টিভঙ্গি। শিশুকে খাবার ধরা ও খাওয়া শিখিয়ে দিন, দেখবেন একসময় নিজে নিজেই খেতে পারছে। খাবার গ্রহণের ক্ষেত্রে সে স্বাবলম্বী হয়ে বড় হবে। অনেক বাবা মাকে দেখা যায়, পরিণত বয়সেও সন্তানকে খাইয়ে দেন। মা-বাবার অবর্তমানে অথবা পরিবারের গন্ডি পার হলে এসব শিশুরাই সবচেয়ে বেশি বিপাকে পড়ে।
দ্বিতীয় ভুলটি হয় শিশুর চলাচলের ক্ষেত্রে। শিশু যখন নিজের পায়ে সোজা হয়ে দাঁড়াতে শুরু করবে, হাত ধরে কিছুটা পথ হাঁটার জন্যে তাকে নিরাপদ সুযোগ করে দিতে হবে। এই সফলতার জন্যে হাততালি দিয়ে তাকে অভিনন্দন জানাতে হবে। যখন পুরোপুরি হাঁটতে শিখবে, তখন আর সহযোগিতা কিংবা হাততালি কোনটিরই দরকার নেই। এক্ষেত্রে পরিবারের সদস্যরা প্রায়শই ভুল করেন। পথ একটু বেশি হলে আমরা সাধারণত শিশুকে কোলে নিয়ে বহন করি অথবা একটি পরিবহনের ব্যবস্থা করি। আমাদের ধারণা শিশু বেশি দূর হাঁটতে পারবে না। জীবনের শুরুতেই শিশুর শারিরীক সক্ষমতাকে অস্বীকার করে তার মধ্যে হীনমন্যতা ঢুকিয়ে দেই। যে শিশু নিজে হাঁটতে চায়, তাকে অবশ্যই সেই সুযোগটি করে দিতে হবে। শিশুকে যদি সবসময় কোলে বহন করে বেড়ানো হয়, তাহলে সে ভবিষ্যত জীবনে একা চলতে পারবে না- এটাই স্বাভাবিক।
শিশুরা মাঝে মাঝে চলাফেরা কিংবা খেলাধূলা করতে গিয়ে নিচে পড়ে গেলে মায়েরা তাদের উদ্ধারের জন্যে ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠেন। এক্ষেত্রে মায়েদেরকে কিছুটা বাস্তববাদী ও কৌশলী হতে হবে। শিশু হোচট খেয়ে পড়ে গেলে যদি সামান্য ব্যাথা পায় অথবা জখম না হয়, তাহলে তাকে নিজে নিজে উঠতে দিন। উঠার পর হাততালি দিয়ে অভিনন্দন জানিয়ে তাকে কোলে তুলে নিন। এর ফলে ভবিষ্যত জীবনে কখনো পড়ে গেলে উঠে দাঁড়ানোর সময় সে কারো জন্যে অপেক্ষা করবে না। জীবনযুদ্ধে বিপর্যয় আসলে কীভাবে উঠে দাঁড়াতে হয় এবং আবার কীভাবে নতুন করে পথচলা শুরু করতে হয়, এই আত্মবিশ্বাস তার মধ্যে জাগ্রত হবে।
অপরদিকে, নিজে নিজে উঠার পর কোলে তুলে তাকে আদর করার ফলে তার মধ্যে নিরাপত্তাবোধ এবং মমতা জাগ্রত হবে।
তৃতীয় ভুলটি করি সন্তানের প্রয়াসকে বাধাগ্রস্থ করে। শিশু কোনো কিছু করতে চাইলে আমরা তাকে থামিয়ে দিয়ে বলি- তুমি এটা পারবে না। শিশু চেয়ার ধরে দাঁড়াতে চাইলে তাকে আমরা নিজেরা ধরে দাঁড় করিয়ে দেই। অথচ এই চেয়ারটিতে উঠাই ছিল শিশুর কাছে পর্বত আরোহণের সমান। শিশু কোনো কিছু করতে চাইলে আমাদের উচিত সরাসরি সাহায্য না করে, উৎসাহ সৃষ্টির মাধ্যমে শিশুকে পরোক্ষভাবে সাহায্য করা। অথচ আমরা প্রতিনিয়ত উল্টো কাজটি করছি। শিশুর প্রতিটি প্রচেষ্টায় আমরা সাহায্য করার চেষ্টা করি। এটাকে সহযোগিতা বলা যাবে না বরং এই সাহায্য হচ্ছে শিশুকে পরনির্ভরশীল করার একটি ভুল জীবনদৃষ্টি। আবার শিশুদেরকে আমরা কোনো জিনিসই সঠিকভাবে পর্যবেক্ষণ করতে দেই না। চারদিকে শুধু বাধা আর বাধা। শিশু কোনো কিছু পর্যবেক্ষণের জন্য হাতে নিলে, আমরা চিৎকার দিয়ে উঠি। এতে শিশু পরবর্তী সময়ে কোনো কিছু আগ্রহ নিয়ে শুরু করতে সাহস পায় না। কোনো কাজ করতে গেলে ভয় কিংবা লজ্জা পায়। এভাবেই আমরা শিশুদের ছোট ছোট প্রয়াস ও সম্ভাবনকে প্রতিনিয়ত বিনষ্ট করছি।
যে কাজটি আপনার সন্তান করতে সক্ষম, তাকে সে কাজটি করতে দিন। অভিভাবক হিসেবে সন্তানের স্কুল ব্যাগ কখনো টানতে যাবেন না। ব্যাগ তাকেই বহন করতে দিন। ব্যাগের ওজন বেশি হয়ে গেলে কিছু বই খাতা আপনার হাতে নিয়ে নিন, তারপরেও সন্তানকে ব্যাগ বহন করতে দিন। ব্যাগ বহন করে আপনার মনে হতে পারে আপনি তাকে সাহায্য করছেন। আসলে তাকে সাহায্য করছেন না। বরং তার যোগ্যতাকে আপনি অবমূল্যায়ন করছেন, তার ক্ষতি করছেন এবং তাকে পরনির্ভরশীল হিসেবে গড়ে তুলছেন।
প্রত্যেক মা-বাবার উচিত, সন্তানকে কষ্ট ও পরিশ্রম নির্ভর করে গড়ে তোলা। আমাদের সমাজে একটি কথা প্রচলিত আছে- আমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে। এটি একটি অ’বিদ্যা। আমরা সবাই সন্তানের জন্যে একটি নিশ্চিত ও সমস্যাহীন ভবিষ্যত নিশ্চিত করতে চাই। কোনো অভিভাবক যদি শিশুর জন্যে সমস্যাহীন, অতি নিরাপদ, আরামদায়ক ও পরিবর্তনহীন জীবন নিশ্চিত করেন, তা শিশুর স্বাভাবিক বিকাশের জন্যে সহায়ক নয়। এ ধরনের পরিবেশ শিশুদের সৃজনশীলতা বিকাশের অন্তরায় এবং সমস্যা মোকাবিলা করার ক্ষমতাকে বিনষ্ট করে।
আরামের মধ্যে বড় হলে শিশু জীবন সংগ্রামের অনেক বাস্তবতা থেকে দূরে থাকবে এবং চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বার বার ব্যর্থ হবে। একারণেই শিশুকে কষ্ট ও পরিশ্রম নির্ভর করে গড়ে তুলতে হবে, যাতে করে সে যেকোনো পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে পারে এবং নিজেকে খাপ খাওয়াতে পারে। শিশুকে ছোটবেলা থেকেই শেখাবেন, পৃথিবীতে যা কিছুই তুমি অর্জন করতে চাও না কেন, পরিশ্রম করেই অর্জন করতে হবে। পরিশ্রমের বিকল্প কঠোর পরিশ্রম।
এসএ/