সুস্থ থাকতে নিয়মিত করুন ‘বঙ্গাসন’ ও ‘বজ্রাসন’
প্রকাশিত : ১২:২৮, ২৬ আগস্ট ২০২০ | আপডেট: ১৪:০৫, ৩১ আগস্ট ২০২০
করোনা আক্রান্ত রোগীর বেশকিছু উপসর্গের মধ্যে আতঙ্কিত হওয়ার মতো উপসর্গটি হচ্ছে শ্বাসকষ্ট। কিন্তু আমরা হয়তো অনেকেই জানিনা যে, নিয়মিত ব্যায়াম করলে শ্বাসকষ্টের সমস্যা অনেকটা রুখে দেওয়া সম্ভব। করোনাকালীন সুরক্ষায় ইয়োগা বা যোগ ব্যায়ামের বিভিন্ন আসন শরীরের ইমিউনিটি ক্ষমতা বৃদ্ধিতে বিশেষ ভূমিকা রাখতে পারে।
যদিও সারাদিনের কর্মব্যস্ততায় ব্যায়ামের জন্যে আলাদা সময় বের করা আমাদের জন্য খুবই কঠিন। তবে মনে রাখতে হবে- সুস্থ থাকতে হলে শত ব্যস্ততার মধ্যেও আপনাকে নিজের জন্যে সময় করে নিতে হবে। এ ক্ষেত্রে এমন কিছু ব্যয়াম আছে যা আমরা কাজের মাঝে, দৈনন্দিন জীবনে সব ব্যস্ততার মধ্যেও চালিয়ে নিতে পারি। আর এগুলো করলে অনেকটাই সুস্থ থাকা সম্ভব।
আমরা এখন সকলেই জানি, করোনা মহামারি মোকাবিলায় ইমিউনিটি বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই। আর এই ইমিউনিটি বাড়াতে যোগচর্চা ও মেডিটেশন কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে।
গবেষকরা মনে করছেন, ব্যায়ামই আটকে দিতে পারে করোনার থাবাকে। আপনার ইমিউন সিস্টেম যত শক্তিশালী হবে ততই আপনি সুস্থ থাকবেন। ব্যাকটেরিয়া ও ভাইরাস আপনার কাছ থেকে দূরে থাকবে। এই যোগচর্চার মধ্য দিয়ে আপনার জীবনে ইতিবাচক বিষয়গুলোর সংযুক্তি ঘটবে। নেতিবাচক বিষয়গুলো আপনার কাছ থেকে দূরে সরে যাবে। আপনি সবসময় থাকবেন নিরোগ, প্রফুল্ল ও প্রাণবন্ত।
আমেরিকার ভার্জিনিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা সামনে এনেছেন এই তথ্য। তাঁদের গবেষণা বলছে, অ্যাকিউট রেসপিরেটরি ডিসট্রেস সিনড্রোম বা এআরডিএস দূর করতে বা অন্তত কম করতে শারীরিক কসরতের বিকল্প নেই।
এবার আসুন আমরা কয়েকটি যোগব্যায়াম নিয়ে আলোচনা করি-
বঙ্গাসন
ছোট বেলায় উঠবস করেছেন নিশ্চই। এই আসনটা একদম সেরকম। শুধু পা দুটি ফাঁক করে সোজা বসে না পরে, কোমরের নিচের অংশটা একটু পিছনের দিকে ঠেলে বসতে হবে। শিরদাঁড়া থাকবে একেবারে সোজা। প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে খালি পেটে এই আসনটি করলে শরীরের নিচের অংশের কর্মক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। এছাড়া পিঠের সব রোগ কমতে শুরু করে এবং ঘার ও গোড়ালির কর্মক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। স্কোয়াট হল এমন একটা আসন যা হজম ক্ষমতার উন্নতি ঘটায়। ফলে শরীরে অতিরিক্ত মেদ জমার সুযোগই পায় না।
যোগে এটাকে মলাসন বা উৎকটাসন (বিশ্রাম অবস্থা) বলা হয়। কিন্তু এর নতুন নামকরণ করা হয়েছে বঙ্গাসন। কারণ যুগ যুগ ধরে আমাদের পূর্বপুরুষরা এভাবে বসে শুধু যে মলত্যাগ করতেন তা নয়, বসতেন, অপেক্ষা করতেন, কথা বলতেন। সবকিছু করতেন এই আসনে। কিন্তু সভ্য হতে গিয়ে আমরা মলত্যাগের জন্যে হাই কমোডের ব্যবস্থা করেছি। মাটিতে বসার বদলে চেয়ারে বা সোফায় বসার অভ্যেস করেছি। আর এসব কারণে আমরা হারাতে শুরু করেছি সুস্থতা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন- আধুনিক মানুষের যেসব রোগব্যাধি হয়, মৃত্যু হয়, তার সবচেয়ে বড় কারণগুলোর একটি হলো চেয়ারে বসা। আরাম কেদারায় বসা, সোফায় বসা। যে কারণে এখন বলা হয় সিটিং ইজ নেক্সট স্মোকিং। বা রিভলবিং চেয়ার বা সোফাকে বলা হয় কিলার চেয়ার বা খুনি চেয়ার।
অথচ আমাদের পূর্বপুরুষদের কিন্তু এত রোগবালাই ছিল না। আর কারণ এই বঙ্গাসন। বঙ্গাসন হচ্ছে- স্কোয়াট বা লো কমোডে মানুষ যেভাবে বসে, সেটি। ভর থাকবে পায়ের গোড়ালিতে। দুই পায়ের মধ্যে ফাঁকা থাকবে এবং হাত দুটো পায়ের দুই হাঁটু ঘিরে থাকবে। শরীরের ভর ছেড়ে দিতে হবে।
অনেক সময় দেখবেন ভোরবেলা রাস্তার ধারে দিনমজুররা কাজ পাওয়ার অপেক্ষায় যেভাবে বসে থাকেন। সেটিই বঙ্গাসন।
শরীরকে ফিট রাখতে এই আসনটির উপকার অনেক। আপনি যদি নিয়মিত বঙ্গাসন করতে পারেন তবে আপনার আয়ু বেড়ে যাবে। কারণ আপনার ফিটনেস বেড়ে যাবে। মলত্যাগের সময় বঙ্গাসনে বসলে রেচনের অঙ্গগুলো যে ভঙ্গিতে থাকে তা খুবই উপকারি (আসলে প্রাকৃতিকভাবেই মানুষের দেহটা সৃষ্টি এভাবে রেচনক্রিয়ার জন্যে)!
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো মহিলারা যারা নরমাল ডেলিভারির মাধ্যমে সন্তান জন্ম দিতে চান তাদের জন্যে আদর্শ হলো বঙ্গাসন। মানে কোনো তরুণী যদি নিয়মিত বঙ্গাসন করেন তাহলে মা হবার সময় তার নরমাল ডেলিভারির সম্ভাবনা বেড়ে যায়। এটা গবেষণার তথ্য। দেখা গেছে, যারা বঙ্গাসন করতে পারেন এমন মায়েদের ২০ থেকে ৩০ ভাগ ক্ষেত্রে বেশি নরমাল ডেলিভারি হয়েছে। এজন্যে নিয়মিত এই চর্চা করতে পারেন।
প্রথমেই বেশি সময় হয়তো পারবেন না। একটু একটু করে বাড়ান। প্রথমে ২০ সেকেন্ডে, তারপর ৪০ সেকেন্ড, আস্তে আস্তে ১ মিনিট, ২ মিনিট, ৩ মিনিট। যদি সম্ভব হয় তাহলে যেকোনো কাজের পরিবেশকেও এমন করে নিন যাতে বঙ্গাসনে বসে করতে পারেন। আর দিনে অন্তত ১৫ মিনিট বঙ্গাসনে বসুন। আপনি অনেক ঝরঝরে অনুভব করবেন।
বজ্রাসন
বজ্রাসন যোগব্যায়ামের সবচেয়ে সহজ আসন। অন্য ব্যায়ামগুলো ভরপেটে নিষিদ্ধ হলেও বজ্রাসনের সেই নিষেধাজ্ঞাটা নেই। সহজ ব্যায়াম হলেও এর উপকারিতা অনেক বেশি। তাই বজ্রাসনকে বলা হয় উত্তম ব্যায়াম।
উপকারিতা
প্রতিবেলা খাবার শেষে ৫ থেকে ১০ মিনিট এ আসন চর্চা করলে খাবার হজমে সমস্যা দূর হবে। নিয়মিত বজ্রাসন করলে পাইলসের সমস্যা থেকে আরোগ্য লাভ করা যায়। হাঁটু ও গোড়ালির বাত নিরাময়ে এ আসন খুব কার্যকরী। এটা নিয়মিত করলে আথ্রাইটিস হওয়ার সম্ভাবনা কমে যায়। যাদের পায়ের পাতার খিল ধরা বা অসমতা সমস্যা রয়েছে তারা আরোগ্য পেতে পারেন। ঘুমের আগে কিছু সময় এ ব্যায়াম চর্চা করতে পারেন। এতে শরীরে অক্সিজেন সরবরাহ বাড়বে ও অনিদ্রা দূর হবে।
পদ্ধতি
- প্রথমে কোনো সমতল স্থানে হাঁটু মুড়ে বসুন। এই সময় হাঁটু দুটো জোড়া অবস্থায় থাকবে এবং পায়ের গোড়ালির ওপর নিতম্ব অবস্থান করবে। এই সময় পায়ের পাতা থেকে হাঁটু পর্যন্ত মাটির সঙ্গে লেগে থাকবে।
- এবার দুই হাত হাঁটুর ওপর স্থাপন করুন। এই সময় হাতের তালু হাঁটুর দিকে ফেরানো থাকবে।
- এই অবস্থায় মেরুদণ্ড ও হাত সোজা রেখে ২ মিনিট অবস্থান করুন। এ সময়ে শ্বাস-প্রশ্বাস স্বাভাবিক রাখুন।
এ আসনটি চর্চা করার সময় খেয়াল রাখতে হবে মেরুদণ্ড সোজা আছে কি-না। এজন্য সামনের দিকে ঘাড় সোজা রেখে তাকান। ঝুঁকে বসবেন না। এ আসন চর্চা করার সময় আপনি প্রাণায়াম অনুশীলন করতে পারেন।
২ মিনিট পর কিছুক্ষণ সবাসন করুন, অর্থাৎ দুই হাত দুই পাশে রেখে চিৎ হয়ে শুয়ে বিশ্রাম নিন।
দণ্ডাসন
যোগশাস্ত্রে বর্ণিত একটি আদর্শ আসন বিশেষ। দণ্ড শব্দের একাধিক অর্থ রয়েছে। কিন্তু যোগশাস্ত্রে দণ্ড শব্দটির অর্থ হিসাবে গ্রহণ করা হয়েছে লগুড়, লাঠি। ইয়োগাতে একে তাড়াসন/দাড়াসন বলা হয়। এই আসনে ৯০ ডিগ্রী কৌণিক মানে মেরুদণ্ড ও শরীরকে উপস্থাপন করতে হয়।
উপকারিতা
- সঠিকভাবে বসার অভ্যাস তৈরি হবে।
- শরীরের ক্লান্তি দূর হয়।
- মনের একাগ্রতা বৃদ্ধি পায়।
পদ্ধতি
- কোন সমতল স্থানে, দুই পা প্রসারিত করে বসুন।
- উভয় পায়ের গোড়ালিকে একত্রিত করে, পায়ের পাতা সোজা আকাশমুখী করুন।
- এবার হাত দুটো শরীরের পাশ ঘেঁষে মাটিতে স্থাপন করুন। এই সময় হাতের তালু ও আঙুলগুলো পায়ের দিকে প্রসারিত থাকবে।
- এবার মেরুদণ্ড ও ঘাড় সোজা করে সামনের দিকে ভূমির সমান্তরালে দূরে দৃষ্টি নিক্ষেপ করুন। এই অবস্থায় শ্বাস-প্রশ্বাস স্বাভাবিক রেখে ৩০ সেকেণ্ড স্থির হয়ে বসে থাকুন।
- শবাসনে ৩০ সেকেণ্ড বিশ্রাম নিন। এরপর আসনটি আরও দুই বার করুন।
এসএ/