ঢাকা, বৃহস্পতিবার   ২৬ ডিসেম্বর ২০২৪

সন্তানকে পরাতে হবে নৈতিকতার পোশাক

আনোয়ারা সৈয়দ হক

প্রকাশিত : ১০:১১, ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২১

আমার বয়স তখন প্রায় ১০ বছর। যশোর টাউন হল মাঠে মেলা হচ্ছে। আমার কাছে আট আনা পয়সা ছিল, সেটা নিয়ে খুব জোরে দৌড়াতে লাগলাম। দৌড়াতে দৌড়াতে একসময় আমার প্রাণে শান্তি এলো—ঐ যে মেলা দেখা যাচ্ছে, কত রঙিন ফেস্টুন!

মেলায় যে-ই ঢুকতে যাব, হঠাৎ দেখি সামনে একটা রিকশা আর তার পা-দানিতে বাতাসা-গজা-জিলাপি ভর্তি হাঁড়ি। চোখ তুলে দেখি, আমার বাবা। তিনি আমাকে দেখে বিস্মিত, আমিও তাকে দেখে হতবাক। কারণ আমাকে স্কুলে পাঠানো হয় কাপড় দিয়ে ঘেরা একটা রিকশা করে। বাড়ির বাইরে আমাদের যাওয়া নিষেধ, বাইরের কারো সাথে কথা বলা নিষেধ, এমনকি সাবধান থাকতে হতো— বারান্দায়ও কেউ যেন আমাদের দেখতে না পায়। সেই আমি এসেছি মেলায়! বাবা গম্ভীর কণ্ঠে বললেন, ‘উঠে আয়’।

এরকম নানা বিধিনিষেধের মধ্যে আমরা বড় হয়েছি। তখন সমাজটাই ছিল এরকম। মনে করা হতো, মেয়েরা কেন ঘরের বাইরে যাবে? তাদেরকে লেখাপড়া শিখিয়েও কোনো লাভ নেই। কিন্তু আমার মা ছিলেন খুব একরোখা। তিনি বলতেন, আমার মেয়েরা লেখাপড়া শিখবে।

আসলে কোনোকিছুই মানুষকে দমাতে পারে না যদি তার ভেতরে বড় হওয়ার বা পরিবেশকে ছাড়িয়ে ওপরে ওঠার একটা অদম্য স্পৃহা থাকে। তবে এর জন্যে মানুষকে অনেক কাজ করতে হয়। আর এভাবেই আমাদের ভেতরে মূল্যবোধ তৈরি হয় যে, আমি কী হতে চাই বা কীভাবে আমার জীবন কাটাতে চাই।

বর্তমানে ছেলেমেয়েদের জীবনযাপন আমাদের সময়ের চেয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন। এত স্বাধীনতা, এত সুযোগ-সুবিধার পরও তরুণদের মধ্যে এখন সাংঘাতিক অস্থিরতা অবক্ষয় অবিশ্বাস আর হানাহানি। প্রায়ই দেখা যাচ্ছে, তরুণ দম্পতি বিবাহ-বহিরভূত সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ছে, একজন আরেকজনকে খুন করছে, পরিবারগুলো ভেঙে যাচ্ছে। এই অবক্ষয় খুব ধীরে ধীরে হয়েছে। কারণ আমাদের হাতে চলে এসেছে মোবাইল ফেসবুক টুইটার ই-মেইল। আমরা নিত্যনতুন প্রযুক্তি পেয়েছি কিন্তু কীভাবে সেগুলোর সদ্ব্যবহার করব তা শিখি নি।

শিশুরা এখন ইন্টারনেট সিনড্রোমে আক্রান্ত। ইন্টারনেট থেকে তারা উঠতে পারে না, ঘণ্টার পর ঘণ্টা স্ক্রিনের সামনে পড়ে থাকছে। শুধু শিশুরাই নয়, বড়রাও এখন এ রোগে আক্রান্ত। মধ্যবয়স্ক মহিলারা ফেসবুক নিয়ে ব্যস্ত। যারা ছিল পরিবারের মা বোন ভাগ্নি ভাতিজি, ইদানীং তাদের একেকটি ছবিতে যে ঝলমলে সাজ-পোশাক এবং চেহারার এক্সপ্রেশন, তাতে বোঝা দায় এটা কি বাড়ির গৃহিণী নাকি ফ্যাশন গার্ল? ফেসবুক আর ইন্টারনেট প্রতিনিয়ত মানুষের ক্ষতিকর প্রবৃত্তিগুলোকে উসকে দিচ্ছে।  

বর্তমানে সামাজিক নানা অস্থিরতায় সন্তানদের নিয়ে মা-বাবা দিশেহারা হয়ে পড়ছেন। আমি মা-বাবাদের সবসময় বলি রবি ঠাকুরের জুতা-আবিষ্কার কবিতাটির কথা। বাইরের পরিবেশ অত্যন্ত নোংরা, যা সবসময় মন্দ কাজে হাতছানি দেয়। কিন্তু রবি ঠাকুরের ভাষায়—নিজের দুটি চরণ ঢাকো, তবে/ ধরণী আর ঢাকিতে নাহি হবে। অর্থাৎ রাস্তার ধুলো-ময়লা থেকে বাঁচার জন্যে নিজের পায়ে জুতা পরতে হবে। তেমনি সমাজে যে আবিলতা নষ্টামি আছে, সেগুলো থেকে আমরা সন্তানকে রক্ষা করতে পারব—যদি তার গায়ে নৈতিকতার পোশাক পরিয়ে দেই। একমাত্র নৈতিক শিক্ষাই মানুষকে সত্যিকার সুপথে চালিত করে।

আর এজন্যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে হবে মা-বাবাকেই। ছেলেমেয়েকে বিভিন্ন সৃজনশীল কর্মকান্ডে ব্যাপৃত রাখতে হবে। পরিবারের সাথে একাত্মতা সৃষ্টির সুযোগ করে দিতে হবে। সবচেয়ে বড় কথা, ক্লাসে ফার্স্ট বা সেকেন্ড হতেই হবে—এই প্রতিযোগিতা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। এখনকার মা-বাবাদের উচ্চাশা মাত্রাহীন। কিন্তু কেন এই ইঁদুর দৌড়?

বাচ্চারা যখন স্কুলে যাচ্ছে, মায়েরা স্কুলের সামনেই বসে থাকেন। ছেলেমেয়ে স্কুল থেকে বের হলে মা দৌড়ে তাকে নিয়ে যাচ্ছেন একের পর এক কোচিংয়ে। অথচ তিনি নিজে জ্ঞানচর্চা করছেন না। খেয়াল করে দেখেছি—যে মায়েরা স্কুলের বাইরে বসে থাকেন, তাদের কারো হাতে না আছে একটা বই, না আছে একটা খবরের কাগজ। এ দৃশ্যই কিন্তু একটা সমাজকে তুলে ধরছে যে, আমরা কোনদিকে যাচ্ছি।

আমরা অধিকাংশই শুধু বৈষয়িক প্রাপ্তির জন্যে সন্তানদের লেখাপড়া করাচ্ছি। নৈতিকতা বা মনুষ্যত্ব শেখাচ্ছি না। তরুণদের বই পড়তে বলছি কিন্তু ওদের মায়েদের হাতে বই নেই!

ইংরেজি মাধ্যমে যে ছেলেমেয়েরা পড়ছে, তাদের মা-বাবা গর্ব করে বলেন, ‘ও ইংলিশ মিডিয়ামে পড়ে তো, বাংলা সেভাবে বলতে পারে না।’ পরবর্তীকালে এই মা-বাবাই দুশ্চিন্তায় পড়ে যান—কারণ সন্তান তাদের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। কিন্তু এটাই তো স্বাভাবিক। কারণ তার কাছে দেশ, দেশের ভাষা, দেশের মানুষ অর্থহীন। সে-তো আত্মস্থ করেছে বিদেশের সংস্কৃতি, বিদেশের গান, বিদেশের সবকিছু। দেশটা তার কাছে তখন ভাসা ভাসা।

আমাদের ভাবতে হবে, দেশের সাহিত্য সংস্কৃতি ঐতিহ্য মূল্যবোধের সাথে আমরা কি ছেলেমেয়েদের পরিচয় করিয়ে দিচ্ছি? জন্মভ‚মির সাথে নাড়ির যে বন্ধন, তা কি তারা কখনো অনুভব করে? বিদেশে পড়ালেখা করতে গেলে তাকে যদি বলা হয়—তোমার দেশের জাতীয় সংগীত গেয়ে শোনাও তো! সে কি পারবে?

অতএব সন্তানকে এমনভাবে তৈরি করতে হবে, যেন সে নিজের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি থেকে কখনো বিচ্যুত না হয়। একটা জাতি যখনই নিজের সংস্কৃতি ও শেকড় থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়, তখন তারা ধ্বংসের দিকে এগোতে থাকে। কারণ কোনো মূল্যবোধ তাদের ধরে রাখে না। তাদের পা আর মাটির স্পর্শ পায় না। এভাবে চলতে থাকলে একসময় দেখা যাবে, আমাদের সন্তানদেরকেই আমরা হারিয়ে ফেলেছি।

তাই শুধু বড় বড় ডিগ্রি নয়, সন্তানকে সঠিক শিক্ষা দিতে হবে। পরিবারে ভালো চিন্তা ও আচরণের চর্চা করতে হবে। মানুষকে ভালবাসা, সম্মান দেয়া, মানুষের উপকার করা, দান করা এবং শুধু নিজের পরিবার-পরিজন নয়, সমাজ ও জাতিকে এগিয়ে নেয়ার চেষ্টা—এটাই যেন হয় আমাদের মূল লক্ষ্য।

লক্ষ্য বা মনছবির কথা সবসময় বলা হয় কোয়ান্টামে। এর প্রতিষ্ঠাতা মহাজাতক সবাইকে মনছবি করতে বলেন। একটি প্রবাদ আছে—হৃদয়ে যার অস্তিত্ব নেই, চোখও তাকে দেখতে পায় না। অর্থাৎ চোখের সামনে দিয়ে হাতি চলে গেলেও আমরা দেখতে পাব না, যদি মনে এর অস্তিত্ব না থাকে। তাই যত অশান্তি আর বঞ্চনার মধ্যেই আমরা থাকি, একটি সুন্দর সুশীল সমাজ নির্মাণের লক্ষ্য বা মনছবি যেন আমাদের থাকে।                                                        
(দেশের প্রথিতযশা মনোচিকিৎসক ও সমাজ-সচেতন লেখক আনোয়ারা সৈয়দ হক। ৬ নভেম্বর ২০১৭ কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন আয়োজিত মুক্ত আলোচনার ৭০তম পর্বে তিনি প্রধান অতিথি হিসেবে আমন্ত্রিত হন। তার আলোচনার নির্বাচিত অংশ এখানে তুলে ধরা হলো। ৫ নভেম্বর ২০২০ তার ৮০ তম জন্মদিন। কোয়ান্টাম পরিবারের পক্ষ থেকে তাকে জানাই শ্রদ্ধা ও শুভেচ্ছা।)
[অনুলিখিত]


Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি